যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
১। ।
কল্পনাদের গলিতে কখনো কোনদিন ল্যাম্পপোস্টে বাতি জ্বলেনি।
সন্ধ্যা পার হলেই মনে হয় নিঝুম রাত। গলির মাথায় আফসারের চা’র দোকানে ছেলেদের আড্ডার কোলাহল ম্রিয়মান হতে থাকলে বোঝা যায়,রাত হচ্ছে। একটু বৃষ্টি হলেই পানি ওঠে,নর্দমা ভরে থাকে আবর্জনায়। সারা বাঙলাদেশে যদি একটি জায়গায় লোডশেডিং থাকে,সেটি হচ্ছে এই এলাকা। এমন জায়গায় সচরাচর ভদ্র মানুষেরা থাকে না।
কল্পনারা থাকে। তাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা চার। বাবা,মা,বড় ভাই-এই নিয়ে তাদের ছোট্ট সংসার। কল্পনার শ্বাস নেয়া শুরু এখানেই।
কলেজে কল্পনার বেস্ট ফ্রেন্ড সাজিয়া প্রায়ই বলে তুই আমার বাসায় চলে আয়।
যে এলাকায় থাকিস,সেখানে শুধু চোর ছ্যাচড়ের বসবাস। কল্পনা হেসে বলে,তুই আমার সাথে এসে থাক। যে বাসায় থাকিস,সেখানে শুধু যন্ত্রদের বসবাস। কথাটা শুনলে সাজিয়ার মন খারাপ হয়ে যায়,কিছুটা অপমানিত বোধ করে। এই অপমানিত হতে চাওয়ার ভেতর সাজিয়ার মনের সুপ্ত ইচ্ছে লুকিয়ে আছে।
যন্ত্রের জগত থেকে মুক্ত হবার ইচ্ছে। কল্পনার প্রতিদিন ঘুম ভাঙে মা’র ডাক শুনে। সাজিয়ারও মাঝে মাঝে মা’র ডাক শুনে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে।
বাইরে মহল্লায় যখন রাত হয়, গলিটি যখন কোলাহল শূন্য হয়ে যায় তখন কল্পনা মুগ্ধ হয়ে আকাশ দেখে তার ছোট্ট জানালা দিয়ে। রাত জাগতে ভালো লাগে তার।
নিজেকে খোঁজা যায়। মনের গভীরে লুকিয়ে থাকা স্মৃতির ধূলিকণাগুলো হাতড়ে দেখে। কবি-সাহিত্যিক যারা আছেন তাদের কাছে চাঁদের গুরুত্ব অসীম। তারা ব্যস্ত হয়ে পড়ে চাঁদের আলোয় প্রিয়তমার মুখের ভাষাকে ছন্দে রূপ দিতে। চিত্রকররা ব্যস্ত থাকে রঙ দিয়ে রঙ ছড়াতে।
আর কল্পনা কী করে? কেউ জিজ্ঞেস করলে সে নির্দ্বিধায় বলবে-আমি বসে বসে ঘোড়ার ঘাস কাটি। নিজেকে মাঝে মাঝে ঘাস মনে হয়। তখন সে ভয়ে এদিক সেদিক তাকায়,কোন ঘোড়া এল কিনা। যদি তাকে খেয়ে ফেলে!কল্পনা ভালো লিখতে পারে,তবে তা শুধু তার ডায়েরীর পাতাতে সীমাবদ্ধ। অনেক সুন্দর ছবি আকতে পারে,তবে তা মনের ক্যনভাসেই রঙ ছড়ায় চুপচাপ।
আট দশটা নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের মতোই তাদের সংসার,ঘর। দুটো রুমের একটিতে পার্টিশন দিয়ে আলাদা করা। সে ঘরে কল্পনা আর কল্পনার ভাই থাকে। কল্পনা তাকে ডাকে রি ভাই বলে। এলাকার মানুষ ডাকে পাগলা আর মা,বাবার কাছে এখনও সেই ছোট বাবু।
হঠাৎ করে কেউ যদি তাকে নাম জিজ্ঞেস করে,বাবু ভুলে যায় তার নাম কি!ডিগ্রী পাস করে একদিন চাকরীর ইন্টারভিউ বোর্ডে তাকে ডাকা হচ্ছিল,রিয়াদ হাসান,রিয়াদ হাসান। সে বোকার মত এদিক ওদিক তাকাচ্ছিল আর ভাবছিল,এই গাধাট কে?এতবার ডাকছে তাও সাড়া নেই কেন?ইন্টারভিউ বোর্ডে সেদিন থেকেও সে অনুপস্থিত!
আজ রাতে যখন মহল্লার মানুষগুলো সব ঘুমের রাজ্যে অচেতন তখন নিচে হঠাৎ হৈ-চৈ শুরু হল। একটি কথাই শুনতে পেল কল্পনা-আজ এর শেষ দেখাই ছাড়মু। অই কল্পনার রাণী বাইর হ। তরে বিয়ে করমু।
কল্পনা কিছুটা ভয় পেয়ে গেল। পার্টিশনের ওপাশ থেকে শুনতে পেল,চুপচাপ শুয়ে থাক। ভাই এর কন্ঠেও দুর্ভাবনার ছাপ।
ও কল্পনা,এটা কে রে?
মা,তুমি চুপ থাকো,আমি দেখি কাহিনি কী।
ওই,বাইর হ।
কথা কানে ঢুকে না?
রি ভাইয়া দাঁড়াও আমি দেখি। রিয়াদ সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে বলল,মাথা খারাপ!ততক্ষণে কিছু সময় পার হয়ে গেছে। কল্পনার ভয় কেটে গিয়ে সেখানে রাগ এসে উপস্থিত হয়েছে। ভাইকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ,তিন তলা বাড়ির বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াল। ছেলেটার কথা বলার ভঙ্গি নকল করে বলল,দূর হ এখান থেকে।
কী চাস?পেছনে রিয়াদ এসে হাজির। বোনের আক্রমনাত্মক মেজাজ দেখে মুগ্ধ,কিছুটা ভীত। নিচে এলাকার মাস্তান রবি আর তিন সাঙ্গোপাঙ্গ।
এ ধরনের ছেলেরা সরাসরি কথা শুনতে অভ্যস্ত না। প্রথমে কিছুটা চমকে গেলেও সামলে নিয়ে বলল,তরে চাই।
নিচে আয়।
তুই তোকারি করিস কেন?তোর বোনরে যায়ে ডাক হারামজাদা।
আশপাশের বাড়িগুলোতে লাইট জ্বলতে শুরু করেছে। এ দেশে আগ্রহী জনতার অভাব নেই। তারা এখন উপভোগ করবে।
এমন দৃশ্য সচরাচর দেখা যায় না। একটা মেয়ের মুখে প্রতিবাদের ভাষা!কজন পারে করতে? রিয়াদের বিশ্বাস হচ্ছে না,তার সামনে দাঁড়িয়ে কল্পনা কথা বলছে। রিয়াদ অরে ঘরে নিয়া আয়। মা’র চিন্তিত কন্ঠ শোনা যায়।
রবি বলল,আমি তরে বিয়া করমু।
বউ এর লগে তুই তোকারি করমু না। তোর বান্ধবীদের লগে করুম নাকি?
চেঁচামেচিতে রিয়াদের বাবার ঘুম ভেঙ্গে গেছে। তিনি এসে দাঁড়িয়ে বললেন,আমি কল্পনার বাবা। আমার সাথে কথা বল। আর কল্পনা ঘরে যাও।
বাবার কথা কখনো অমান্য করে না,কল্পনা। কপাল বেয়ে ঘাম পড়ছে। আকাশে অর্ধ চাঁদ। সব সৌন্দর্য নিমিষেই বিলীন হয়ে গেছে। যে সৌন্দর্য মানুষ তৈরী করতে পারে না,সেটাই তারা মলিন করে দিতে পারে।
আসসালামু আলাইকুম,শ্বশুর আব্বা। আমি তাইলে এখন যাই। কাল একবারে প্রস্তাব নিয়া আমুনে। চামচাগুলোকে উদ্দেশ্য করে বলল,সালাম দে বেয়াদবের দল। আব্বা কিছু মনে করবেন না এরা বেয়াদব,আপনারে চিনে নাই।
বিয়ার পর আর কেউ বেয়াদবির সাহস পাবে না।
টলতে টলতে তিনজন মাতাল দূরে অন্ধকারের দিকে মিলিয়ে গেল। আশপাশের যে বাড়িগুলোতে বাতি জ্বলছিল,নিভতে একটুও দেরি হলো না। কাল গল্প করার রসদ পাওয়া গেছে ভেবে তারা হয়ত আনন্দিত।
বাবা ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন,ছেলেটা কোন বাড়ির?
আমি জানি না।
কল্পনার চোখ ভরা জল দেখে বাবা আর কথা আর বাড়ালেন না।
কিছুক্ষণের ভেতরেই পুরো মহল্লা গভীর ঘুমের জগতে চলে গেল। কল্পনার ঘুম এল না।
২। ।
ঘুম থেকে উঠে বেড টেবিলে তাকিয়ে কল্পনা দেখল চা এসে হাজির। ঘড়ির সময় জানান দিচ্ছে কলেজ যাবার সময় পেরিয়ে গেছে।
কাল রাতে সে তার গলিতে বেড়াতে গিয়েছিল। কারো নিজের কিছু স্বপ্ন থাকে,কারো থাকে সাগর। কেঊ মন খারাপ হলে নিজের আপন নদীতে বেড়াতে যায়।
আর কল্পনার একটা গলি আছে। সেই গলিতে কষ্ট আছে কিন্তু ভালোবাসাও আছে। নিজেকে তৈরী করে নেয়ার সংগ্রামের রাস্তা আছে।
কল্পনার গলিতে কল্পনাকে প্রতিদিন তার মা ঘুম থেকে ডেকে দেয়। কল্পনার কোনদিন কলেজ মিস হয় না।
বাস্তবে কল্পনার প্রায় কলেজ মিস হয়।
গাড়িতে করে প্রতিদিন আসা যাওয়া করে সে । কেউ তাকে দেখলে শিষ বাজায় না। তাই কল্পনার আর প্রতিবাদী হয়ে ওঠা হয় না।
বাবার সাথে দেখা হয় অনেকদিন পর পর।
তাই,গলির কল্পনার মত করে তার গল্প করা হয় না।
ব্যাগ ভর্তি থাকে অঢেল টাকা। তাই কলেজে হেঁটে গিয়ে তার টাকা জমান হয় না।
কল্পনা যন্ত্রের মত ঘুরে বেড়ায়। তাই সে কখনো মানুষ হতে পারে না!
মন খারাপ হলে সে তার গলিতে চলে যায় ।
যে গলিতে ল্যাম্পপোস্টে কখনো বাতি জ্বলে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।