বাংলাদেশকে একটি সৃজনশীল জাতি হিসাবে দেখতে চাই।
‘বাবা, ওই লোকটা কে। ’
‘আমাদের গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ মিঞা। ’
ছোটবেলা থেকে শুনে আসছি ফয়েজ মিঞার কথা। খুব সহজ-সরল একটা মানুষ।
মানুষের উপকারে নিঃস্বার্থে যাঁর দর্পাচরণ। একাত্তরে ফয়েজ মিঞার বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। তরতাজা একটা যুবক। মা-বাবার অনেক বাধাবিপত্তি অপেক্ষা করে ছুটে গেছেন মুক্তিযুদ্ধে, দেশকে মুক্ত করতে। নিজের জীবনকে, নিজের ভবিষ্যেক, নিজের ভাবধারাকে না ভেবে আপ্রাণ যুদ্ধ করেছেন তিনি।
অপু বাবাকে বলে, ‘বাবা, মুক্তিযোদ্ধা কী?’
অপু আট বছরে পা দিয়েছে। এখন সে একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে পড়াশোনা করে। শহরে থাকে। নভেম্বরের শেষে বার্ষিক পরীক্ষা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে ঘুরতে এসেছে। সঙ্গে মা-বাবা।
অপুর বাবা সরকারি কর্মকর্তা। গ্রামে তাঁর বেশ খ্যাতি। সবাই তাঁকে মতিন সাহেব বলে ডাকে।
মতিন সাহেব ও অপু গ্রাম ঘুরে ঘুরে দেখছে। মতিন সাহেব অপুর প্রশ্নের উত্তরে বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধা হলো আমাদের দেশটা শত্রুর হাত থেকে মুক্ত করার জন্য নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিয়ে যাঁরা যুদ্ধ করেছেন, তাঁরাই মুক্তিযোদ্ধা।
’
অতশত বোঝে না অপু। ক্লাসে কখনো মুক্তিযোদ্ধা, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের কথা শোনেনি। কোনো শিক্ষকও বলেননি। আমতা আমতা করে অপু বাবাকে বলে, ‘বাবা, মুক্তিযুদ্ধটাই তো বুঝি না। ’
‘মুক্তিযুদ্ধ বোঝ না।
ক্লাসে তোমার মেম বলেনি?’
‘না, বাবা। কখনো তো মুক্তিযুদ্ধ শব্দটাই শুনিনি। ’
বাবা দুই চোখ বন্ধ করেন। মনে মনে ভাবেন, ‘আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের কথা আমরা বলতে কেন এত ভয় পাই। কেন আমরা আমাদের ভালোবাসতে পারি না।
কেন?’
অপু বাবাকে বলে, কী হলো বাবা। তুমি চুপ করে আছ যে, কথা বলছ না।
মতিন সাহেব বলেন, ‘শোন অপু। মুক্তিযুদ্ধ হলো আমাদের স্বাধীনতা। আমাদের অহঙ্কার।
আমাদের নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের ফসল। আমাদের চিন্তা-চেতনা। আমাদের সব চাওয়া-পাওয়ার অধিকারের সংগ্রাম। ’
‘সেদিন কী হয়েছিল? কবে সেটা। ’ অপু বলে।
“আমার বয়স তখন তোমার মতো। ঠিক করে বুঝতে পারতাম না। গ্রামের লোকজন মিলিটারি, যুদ্ধ—কী সব কথা বলাবলি করত। রেডিও সে সময় ছিল অন্যতম একটা মাধ্যম। কান পেতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনত।
মানুষের মধ্যে শুধু আতঙ্ক আর আতঙ্ক। তোমার দাদু ভাইয়ের একটা থ্রি ব্র্যান্ডের রেডিও ছিল। অনেক মানুষ বাড়িতে ভিড় করত খবর শোনার জন্য। ৭ মার্চ। ১৯৭১ সাল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে স্বাধীনতার ডাক দিলেন। বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। ’ মানুষের মুখে গমগম করতে লাগল। অনেকেই বলাবলি করত, দেশটা বুঝি এবার স্বাধীন হবে।
শেখ সাহেব বুঝি আমাদের মুক্তি দেবেন।
“২৫ মার্চ। কাল রাত। ঢাকা মিলিটারিরা ঘিরে ফেলে। মানুষের ওপর অত্যাচার শুরু করে।
হামলা চালায়। শত শত মানুষ প্রাণ হারায়। উঁহু, কী কষ্ট। আর বলতে পারছি না। জানো অপু, তোমার দাদিমা, দাদুভাই, আমি তোমার ফুফু সবাই সব সময় শুধু আল্লাহ আল্লাহ করে জিকির করতাম।
ভয়ে এক কোণে থাকতাম। মনে হতো এ বুঝি এল, এ বুঝি এল। এ রকমের। রেডিওয়ে খবরে শোনা গেল বঙ্গবন্ধুকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে। ভয়ে আরও আতঙ্ক।
সেদিন নাওয়া-খাওয়া এলোমেলো হয়ে যায়।
“২৭ মার্চ। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সব মানুষ যুদ্ধে যাওয়ার জন্য জেগে উঠল। কৃষক, শ্রমিক, জেলে, তাঁতি, চোর-ডাকাত, যুবক-কিশোর কেউ বাকি রইল না।
সবাই মুক্তিযুদ্ধে গেল। এভাবে কাটে নয় মাস। এ নয় মাসে আমাদের প্রাণ দিতে হয় ৩০ লাখ। ১০ হাজার নারীর সম্ভ্রম। তারপর আমাদের কাছে বাবুই পাখির বাসার মতো এল স্বাধীনতা।
পতপত করে আকাশে উড়তে লাগল স্বাধীন বাংলার লাল-সবুজের পতাকা। ”
অপু বলে, ‘বাবা, এত কষ্টের স্বাধীনতা!’
হ্যাঁ, বাবা। এত কষ্টের।
হাঁটতে হাঁটতে চলে আসে মুক্তিযোদ্ধা ফয়েজ মিঞার বাড়ির কাছে। মতিন সাহেব বলেন, ‘ওই যে দেখছ বাড়িটা।
কাঁচা রাস্তার পর কয়েকটা আমের গাছ। কয়েকটা বাড়ি। যে বাড়িটা খড়ের ছাউনি। একপাশে ছাউনির খড় নেই। ছোট একটা কুঁড়েঘর।
সেটাই ফয়েজ মিঞার ঘর। সেখানে তিনি থাকেন। ’
অপু বলে, ‘তিনি দেশের জন্য এত কষ্ট করেছেন। আর কিনা তাঁর ঘরবাড়ি ভাঙা! বাবা, এমন কেন?’
মতিন সাহেব বলেন, ‘তুই বুঝবি না। বড় হলে সব বুঝবি, সব।
ফয়েজের মতো ভালো মানুষের জন্য আজও আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি। না হলে কবেই...। থাক। ’
অপু বলে, ‘বাবা। রাখো তো তোমার পণ্ডিত মার্কা কথা।
তুমি বলো, কেন তাঁর ঘরবাড়ি এমন। ’
ছোট অপু। বাবার কাছে তার বায়না। বলতেই হবে কেন ফয়েজ মিঞার ঘর ভাঙাচোরা। কেন?
নিশ্চুপ করে বলে বাবা।
‘আমরা যারা স্বাধীনতা ভোগ করছি, যারা মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বড় বড় কথা বলছি, আসলে ৩৮ বছর ধরে তাদের জন্য কতটুকুই বা করতে পেরেছি। নিজের স্বার্থে শুধু মরেছি। নিজেকে বোকার মতো সবচেয়ে বুদ্ধিমান মনে করেছি। ’ কথা বলতে বলতে মতিন সাহেব অন্য রকম হয়ে গেলেন। চোখ থেকে টপটপ করে জল পড়তে লাগল।
অপু বলে, ‘বাবা তুমি কাঁদছ। তোমার চোখে পানি। ’
মতিন সাহেব বলেন, ‘হ্যাঁ বাবা। আমি কাঁদছি। ফয়েজের মতো মানুষদের জন্য কাঁদছি।
এত বয়স হলো কোনো কিছুই তাঁদের জন্য করতে পারিনি। তোমাকে একটা ছোট আবদার করে গেলাম। তুমি কোনো মুক্তিযোদ্ধার দেখা পেলে সালাম করবে। যতটুকু পারো সাহায্য করবে। ’
কথা শেষ হতে না হতে পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন ফয়েজ মিঞা।
মতিন সাহেবের দেখা পেয়ে ঘুরে দাঁড়ান। অপু তাঁকে সেনাবাহিনীর মতো দাঁড়িয়ে সেলুট করে। এরপর থেকে যখনই অপু কোনো মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে, তখনই সেলুট। প্রাণভরে সেলুট। এতটুকুই...।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।