যা লিখি, হয়ত কিছুই লিখি না। যা লিখব হয়ত অনেককিছুই লিখব। আসল কথা হলো, গল্প ছাড়া কিছুই লিখতে পারি না
সন্ধ্যা আর বিকেলের মাঝের সময়ে আমি বেশ উদাস হয়ে পড়ি,কখনো কখনো নিজের ভেতরে হারিয়ে যাই স্মৃতিভ্রষ্ট বৃদ্ধদের মতো। অনেকটা ঈদের অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন বিরতির মতো দীর্ঘক্ষনের জন্য মূল দৃশ্যপট থেকে গায়েব হয়ে যাই। অফিস কিংবা ঘর যেখানেই থাকি না কেন,দৈনন্দিন রুটিনের অংশ হিসেবে আমাকে হারাতে হয়।
কোথায় হারাই,কিভাবে হারাই এর উত্তর বেশ জটিল নিজের কাছেও। এই সমস্যার কথা কাছের,দূরের অনেকেই জানে। কেউ কেউ উপযাচক হয়ে উপদেশ দেয়,রিগান তুই সাইকোলজিস্ট দেখা। একদিন আমার দুই বন্ধুর ভেতর তর্ক শুরু হয়ে গেল। একজন বলে সাইকোলজিস্ট আরেকজন বলে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাতে।
আমার উর্বর মস্তিস্কে ঢোকে না দু’টো বিষয়ের পার্থক্য কি!তাদের উৎসাহ দেখে নিজের উৎসাহ শূন্য হয়ে যায়। কেউ উৎসাহী হলে হয়ত তার পাশের জনকে নিরুৎসাহিত হতে হয়। সূত্র অনুযায়ী,যদিও আমি জানি না এমন কোন সূত্র আছে নাকি-আমার নিরুৎসাহিত হওয়ার খুব সহজ ব্যক্ষা দেয়া যায়।
সাইকো শব্দটা আমার একদম পছন্দ না। শৈশবে এ নিয়ে খুব বাজে স্মৃতি আছে যা আমাকে প্রায় পীড়া দেয়।
মনে হয়,আমি কত গাধা ছিলাম। অথচ কানাকে কানা,খোঁড়া কে খোঁড়া বললেও গাধার নামকরণ বন্ধুরা করল সাইকো। কি অপমানটাই না স্যার করেছিল! অথচ তেমন কিছুই করিনি। ছাদে উঠে দড়িতে ঝোলানো মেয়েদের অর্ন্তবাস হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অচেনা জিনিষ আমার আগ্রহ হতেই পারে।
এক বন্ধু দেখে আমাকে সাইকো নামকরণ করল আর কিভাবে যেন স্যারের কানে চলে গেল।
রিগান,তুই এটা করেছিস?
স্যার যে জিনিষ সম্পর্কে জানি না,তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করা কী খারাপ?আমার কথা শুনে অনেকে ফিক করে হেসে দিল। স্যারের মুখে কোন হাসি নেই। খুব নির্মমভাবে আমাকে ভবিষ্যতের যৌন সম্রাট হিসেবে ঘোষণা দিয়ে দিলেন। সবেমাত্র,ক্লাস নাইনে উঠেছি।
তাই কৈশোরের শুরুতে এমন ঘটনা আমার জীবন বিষময় করে দিল। সবাই টিজ করা শুরু করল। যারা টিজ করত তাদের ভেতর অনেকে আবার আড়ালে অর্ন্তবাস স্পর্শের অনুভূতির কথা জানতে চাইলে আমি অবলীলায় কিছু একটা বলে দিই।
তাই এখন বন্ধুদের উৎসাহে খুব একটা উৎসাহিত হতে পারি না। আমি জানি আমার ভেতর কোন সমস্যা নেই,আগেও ছিল না।
তাই সাইকোলজিস্টের কাছে যাবার কোন কারণ খুঁজে পাই না।
এই হারিয়ে যাওয়ার সমস্যা আমার জন্ম থেকে নেই। কৈশোরে,এমনকি যৌবনের শুরুতেও এর কোন লক্ষণ ছিল না।
আচমকাই এর শুরু। অনেকটা বিপদসংকেত ছাড়া শুরু হওয়া ঘূর্ণিঝড়ের মতো।
পাশের বাড়ির সুজাতা টের পেল প্রথমে। যেহেতু,কোন পূর্বাভাস ছাড়াই এর আগমন তাই সুজাতা ঘাবড়ে গিয়ে চিৎকার শুরু করেছিল। ওর জায়গায় থাকলে আমিও করতাম,আপনারাও করতেন। সোজা ভাষায় যাকে বলে রেপের চেষ্টা করা,তাই করেছিলাম। ভাগ্যিস সুজাতারা পুলিশ ফাইল করেনি।
আমার বাবা জাদরেল উকিল-অপরাধিদের ছাড়িয়ে নেওয়ার ব্যাপারে তা বিশেষ নাম-ডাক আছে;তার ছেলের নামে পুলিশ ফাইল করে অর্থের অপচয় হয়ত তারা করতে চাননি।
যারা আমার কৈশোরের কাহিনী জানত,তারা বলে বেড়াতে শুরু করল যৌন সম্রাটের আসল খেলা শুরু হয়েছে। মোটকথা আমার দিন-রাত আবার অন্যরকম হয়ে গেল। সময়ের সাথে সাথে সমস্যা বাড়তে শুরু করল। মানুষজন-যাদের সাথে আমার ওঠা-বসা তারা আমার এই হারিয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি মেনে নিয়ে বেশ আগ্রহভরে সময়টার জন্য অপেক্ষা করে।
আমি তাদের হতাশ করি না।
আজ অফিস নেই। ছাদে দাঁড়িয়ে আছি। আবার সেই দড়ি,সেই অর্ন্তবাস। এদিকে বিকেল শেষ হয়ে আসছে।
কোন বিপদ না ঘটে যায়!কিন্তু,বাসায় যেতে ইচ্ছে করছে না।
বিকেল শেষ হয়ে আসছে,আপনি ছাদে কী করছেন?পেছন থেকে সুজাতার শঙ্কিত কন্ঠস্বর শোনা যায়।
সন্ধ্যার অপেক্ষা করছি।
এরপর টুকটাক কথা বলতে বলতে সন্ধ্যা নেমে এল।
তারপর কী হলো আমার ঠিক মনে নেই।
খালি মনে আছে,সুজাতা যাওয়ার আগে বলেছিল,আপনি একটা সাইকোপ্যাথ।
সাইকোপ্যাথ শব্দটা আমাকে নতুন করে ভাবার সুযোগ করে দিল। সাইকো মানে মানসিক সমস্যা আছে কিন্তু প্যাথ মানে কি?সুজাতাকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করব নাকি,ভাবছি। তারপর কি মনে করে আর করলাম না। সুজাতা-ই প্রথমে আমার রোগটা ধরতে পেরেছে।
এখন আবার কি বলে কে জানে!
নির্জন সন্ধ্যায়,নির্জন ছাদ থেকে ধীরে ধীরে বাসার দিকে পা বাড়াই।
২। । সন্ধ্যার আর বিকেলের মাঝের সময়ে আমি-রিগান থাকি না,অন্যকেউ হয়ে যাই। দিন-রাতের বাকি সময় খুব সাধারণভাবে কেটে যায়।
আমি শুধু সন্ধ্যা আর বিকেলের মাঝের সময়ের জন্য অপেক্ষা করি।
সারাদিন কত অন্যায় ঘটতে দেখি। কিন্তু নিজে কিছু করতে পারি না। সেই সময়ে-আমি কত কিছু করতে পারি!কেউ আমাকে কিছু বলতে পারবে না। সাইকোদের কেঊ ঘাটায় না।
ত্রিশ বসন্ত পার হয়ে গেল-আজো কেউ মমতা নিয়ে বলল না,তুমি এত একা কেন?
কি হবে সুস্থ স্বাভাবিক থেকে?
আমি একজন সাইকোপ্যাথ-ঘুম ভেঙে প্রথমে এই কথায় মনে হলো। সকাল হবে হবে করছে। মানে,প্রকৃতির আরেকটি বদলের সামনে দাঁড়িয়ে। এখন হারালে কেমন হয়?সবার সামনে থেকে নিমিষে রিগান থেকে অন্য কেউ হয়ে যাব। এদিকে মাথাটাও খুব ব্যথা করছে।
আমি কী সত্যি-ই অসুস্থ হয়ে পড়ছি?
বাইরে আলো ফুটছে একটু একটু করে। গ্রাম হলে পাখির ডাক শোনা যেত। এটা গ্রাম নয়। তারপরো দিব্যি শুনতে পারছি। বুঝতে পারলাম,আমি আসলে আমার ঘরে নেই।
কোথায় যেন চলে এসেছি। ডিম লাইটের আলোয় দেখি,যেখানে টেবিল থাকার কথা সেখানে ডালপালা ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। আমি খাটে নেই,আমার নিচে অমসৃণ পাথরের খাঁজ। সরু টিউবের মতও দেয়াল ঊঠে গেছে,অনেক উপরে। কোন জানালা নেই।
আমি আকাশ দেখতে গিয়েও ব্যর্থ হয়। স্পষ্ট বুঝতে পারছি কেঊ আমাকে কুয়োর ভেতরে ফেলে রেখে গেছে।
হাত ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতে থাকি,পারি না। দু-হাটু ভেঙে আসতে চায়। গলা থেকে চিৎকার বের হয় না।
অসুস্থতার নাটক করতে করতে সত্যি সত্যি অসুস্থ হয়ে গেলাম নাকি বুঝতে পারি না।
আমার বাবার অনেক টাকা। কতগুলো সৎ পথে এসেছে আমার জানা নেই। আমার অনেক কষ্ট। একজীবনে মানুষ কত কষ্ট পেতে পারে আমার জানা নেই।
আমার কোন বন্ধু নেই। কোন ভালোবাসার মানুষ নেই।
আমি নাহয় অসুস্থতার ভাল করে সবার মনোযোগে আসতে পারি। হারিয়ে যাওয়ার নাটক করতে পারি। সুজাতাকে জোর করে চুমু দিতে পারি।
করতে পারি আরো অনেক কিছু।
আমার অসুস্থতা দেখে মা নিজের কষ্ট ভুলে যান কিছুক্ষনের জন্য,বাবার অসৎ উপার্জন বন্ধ থাকে কিছুক্ষনের জন্য। আমার তথাকথিত বন্ধুরা মমতাপূর্ন হয়,আমিও নারীদের ছুয়ে দেখতে পারি।
তাই বলে,কুয়োর ভেতর চলে আসব কেন?
আমি কিছুই দেখতে পাই না-আমার চোখের সামনে শুধু ভেসে ওঠে দড়িতে ঝোলানো অর্ন্তবাস। কুয়ো থেকে বের হওয়ার রাস্তাও তাই চোখে পড়ে না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।