সাপের শরীর হয়ে আঁধারের গাছ/ কুয়াশার বন্যায় ডুবো দেবী মাছ!
কেবল লেপটা টেনে কানের কাছে নিয়ে ঘুরে শুয়েছি রুমা ঐদিকে তার ননস্টপ বাসী গল্প শুরু করে দিয়েছে। হাসান সংক্রান্ত যাবতীয় কথা বার্তার একটা সারমর্ম আমার বহু আগে থেকেই জানা।
কি আর করা তারপরও রোজ শুনছি।
: ফাজলামী পাইছে? বাপ মা তুইলা গালীগালাজ করবে মানে! আমি ওরে আগেই বলছি যা বলার আমারে বল,মানলাম আমি ভুল করেছি তাই বলে এভাবে মানুষের সামনে বলবে?
: দোস্ত আর কত?এইবার অফ যা।
: অফ যাব।
তারেও অফ কইরা তারপর কোনোকিছু।
: তোর ফোন খোলা?
: কেন?
: না মানে এখুনিতো হাসান ভাই ফোন দিব। তরে না পাইলে আবার আমারে দিব। এইটা তো শিওর!
: না দিবেনা। আমি বলে দিসি আমার বান্ধবীরে খবরদার ডিস্টার্ব করবানা।
: আলহামদুলিল্লাহ!
: লাথ্থি খাবি।
আমি এইবার তারে কদিন আগে যে পদ্মার পারে যাওয়া নিয়ে যে ঝগড়া বেধেছিল তা কিভাবে মিটেছিল এইটা জিজ্ঞেস করলাম। তারপর নিশ্চিন্ত হয়ে লেপটা আরেকটু টেনে আমার নতুন গল্পের প্লট টা নিয়ে ভাবা শুরু করলাম।
আবছা কানে আসছে রুমার কথা। এখন শুধু হু ...হ্যাঁ...তারপর.... মাঝে মাঝে বললেই হবে।
কাল রাতে গল্পটা কেবল লিখতে বসলাম আর ছোট দুই বিচ্ছু পেন্সিল নিয়া শুরু করলো তাদের ঐতিহাসিক মারামারি। আম্মা দুইটার পিঠের উপর দিল ধমাধম,আর আমাকেও ধমক লাগালো। পাশে আছি তাও ঝগড়া করছে থামাচ্ছিনা। গেল মেজাজ খারাপ হয়ে। ময়নাকে যে প্রায় প্রায় তার স্বামি সুযোগ পেলেই ধরে ধরে মারে,সেটা লিখতে বসে দু লাইন লিখলাম আর গেন্জামে পড়ে গেলাম।
ময়না আমাদের বাসায় কাজ করে। সে আগে যে বাসাটাতে কাজ করতো সেই মালিক এখন তার স্বামী। কিন্তু স্বামী না দেয় ভাত না কাপড়। খালি মাঝে মাঝে শরীরে শরীর মিলিয়ে যায়। বুড়া বাচ্চা কাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা বোধহয় শেষ।
কিন্তু একটু উলোট পালট হলেই স্বামীগিরি ফলাতে ছাড়েনা।
ময়না রোজকার কাহিনী রাগ ক্ষোভ অভিমান আম্মাকে বলে মাঝে মাঝে আমিও শুনি। হায়রে ভালবাসা!
শুয়ে শুয়ে রুমার পেনপেনানি শুনতে শেনতেই ভেবে ফেললাম গল্পে পাঠকের সিমপ্যাথিটা থাকতে হবে ময়নার উপর। এখানে ময়না ভিকটিম।
: শুনছিস? নাকি ঘুমিয়ে গেলি? ওই...
এক ঝটকায় ধপাস করে হাসান রুমার প্রেমকাননে এসে পড়লাম।
রুমা এখন সুখ স্মৃতি রোমন্থন করছে।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ''কিরে কথা বললি? সব মিটমাট হল?''
: কিসের মিটমাট! ওহ তারমানে তুই এতক্ষন আমার কথা শুনিসনি?শয়তান...
: না মানে ইয়ে হি হি হি...
রোজ এক কথা বুঝিস ই তো।
রুমার ফ্রেন্ড ছিল সুমন। সে ছেলেটি মাঝে মাঝেই ফোন করে,এটা হাসানের সহ্য হয়না। হওয়ার কথাও না।
আমিও দুদিন রুমারে ধমক দিয়েছি,'' তুই তারে ঝুলাই রাখতেসিস রুমা। এইটা ঠিক না। কথা বলা বন্ধ না করলে সে তো ভাববে তুই তাকে পছন্দ করিস। যেখানে সে প্রপোজ করসে তোরে হাজারবার। হাসান ভাইয়ের তো কোনো দোষ দেখিনা।
বেচারা! কিন্তু বাপ মা তুইলা কথা বলা ঠিক হয় নায়। ''
রুমার চোখ ছল ছল।
: নম্বর তো সবসময় ডিলিট করে দি। সকালে ফোন দিসিলো ওটা দেখেই এত কান্ড। নদীর পারে এত মানুষ তার মধ্যে দেখ ...
বলেই ফ্যাচ ফ্যাচ করে কাঁদতে লাগলো।
আমি কথা ঘুরানোর জন্য বলি,
: কোচিং এ জয়েন করছিস? তোকে যে ডাকছিল?
: না। হাসান নিষেধ করসে!
: কি? হাসান ভাইয়ের সাথে না এখন আর কোনো সম্পর্ক রাখবিনা। এখন তাইলে নিষেধ মানার দরকার কি? এহ সবাই এই সুযোগ পায় নাকি? সৃজন তো এখন নামকরা কোচিং।
: তা হোক। তবু তার যে পছন্দ না।
বড় অসহায় লাগে রুমাকে। এই মেয়েটি আমার অনার্স জীবনের একমাত্র সঙ্গী। প্রথম প্রথম ক্লাসে গিয়ে সবার সাথেই পরিচয় হল। কিন্তু ধীরে ধীরে দেখলাম, একেকজন একেকজনের সাথে ,দুজন তিনজন চারজন মিলে একেক দল। আমি আর রুমা এক দলে।
এই দলে রুমা আর কাউকে আসতে দেয়নি। আমি অবশ্য চেয়েছিলাম দলটাকে বড় করতে,সে দেখি আমার সাথে কেউ যেই একটু খাতির করতে আসে অমনি এমন ভাব করে যেন তার নিজের কিছু কেউ নিয়া যাচ্ছে। এই মেয়েটির মুখের হাসি অটুট থাকুক।
দুদিন ক্লাসে আসে নাই। ফোন দিব দিব করে দেয়া হয়নি।
হঠাৎ করে বিকেলে হাজির। হাতে চিনি ডিম হাবিঝাবি।
: কিরে? তোর খবর নাই যে! আছিস কেমন?
মুখের ঝলমলে হাসিই প্রমান করে ভাল আছে। একগাল হেসে বলে,
: চল কেক বানায়।
: ওহ!তুই কেক বানাইতে আসছিস? ভাল।
কে খাবে হাসান ভাই?
: হি হি...
শয়তান্নী! গালি দিতে দিতে সব রেডি করতে থাকি। আর শুনতে থাকি ঝগড়া মিটমাটের গল্প।
অক্লান্ত পরিশ্রমের পর দুটো কেক বানাতে সক্ষম হলাম আম্মুর সাহায্য ছাড়াই। অপেক্ষাকৃত ভালোটা হাসানের জন্য রেখে ড্রাই হয়ে যাওয়াটা আমরা মজা করে খেলাম। এখন ঐ ব্যাটা খাইয়া খুশি হইলেই হয়।
রুমার অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে গেলাম। হেন বানায় তেন বানায়। আর আমাকে খাটিয়ে মারে। আমি না হলে তার কিছু বানানো হয়না।
আমার গল্পটা এগুচ্ছেনা।
লিখতে পারছিনা। একদিন একটু ফাঁকা পেয়েই ময়নাকে জিজ্ঞেস করলাম,
: কি অবস্থা বুয়া? তোমার জামাইয়ের খবর কি?আসে টাসে? কয়দিন আগে যে শুনলাম মারছিল। ঠিক হইসে এখন?
: কাইল আসছিল আফা। হারামি বুইড়ার বৌ কুত জানি বেড়াইতে গেছে।
: আচ্ছা এই বুড়াকে বিয়ে করলা কেন বুয়া? তোমার তো বয়স কম।
: ভুল হইয়া গেছে আফা। ওর বাড়িত যখুন কাম করতাম তখনতো খালি মিষ্টি মিষ্টি কথা কইতো। তয় খালি শরীরের আরাম নিব আর বিয়া করবোনা? ফাঁসাই দিয়া বিয়া করসি আফা। এখন কয় মাইনসের বাড়িতে কাম করতে দিবনা। না করলে আমার বুইড়া বাপ মারে কে খাউয়াইবো আফা কন? সে দিব আমারে ভাত,আমার বাপরে তো দিবনা।
: তুমি তারে ভালবাসো বুয়া?
: আফা যে কি কন না?সারাদিন কাম কইরা কুল পাইনা। ভালবাসুম!তয় মাথার উপরে ছাতার মতন আছে দেইখায় পোলাপাইনে কিচু কওনের সাহস পায়না। তয় মায়া তো আছেই আফা।
: হুম..।
একটু পর বের হয়ে আসলাম বাসা থেকে।
রুমার ফোন,সামনে হাসান ভাইয়ের জন্মদিন। শার্ট কিনবে একটা। বাজারে ঘুরতে ঘুরতে সুখবরটা শুনলাম। একটা প্রাইভেট কম্পানীতে হাসান ভাইয়ের জব হইসে। বেতন ভালোই।
প্রায় পনেরো হাজারের মতন।
: এইবার তাইলে বিয়ে করে ফেল।
: হি হি করে ফেলবো দাঁড়া। আমারও আর ভাল্লাগছেনা।
ক্লাসের মধ্যে রুমার ফোন বেজে উঠলো।
ম্যাম সহ সবাই এমন করে তাকালাম!বেচারা লজ্জায় এতটুকু। বাইরে এসে কিছু বলার আগেই করুন করে বললো,বকিস না। ওর দোষ কি? আমিই সাইলেন্ট করতে ভুলে গেছিলাম।
এত ভালবাসা হায়রে!
রুমার মন খারাপ। হাসান এখন বিয়ে করতে চায়না।
কেবল চাকরি হল...
বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে পছন্দ থাকলে বল নাহলে পাত্র দেখবে। অনার্স শেষের পথে। এখন না হলে আর কবে বিয়ে করবে। হাসান বলছে বলছিতো আর দুয়েকটা বছর। এত বেশি বিয়ের জন্য পাগল লাগলে করে ফেলো।
রুমা সারাক্ষন কান্নাকাটি করে দেখতে ভাল লাগেনা। সান্তনা দি,অথচ নিজেই সান্তনা পাইনা। আবার শুনছি ছয়মাসের ট্রেনিংএ হাসান ভাইকে কম্পানী দেশের বাইরে পাঠাচ্ছে। না খেয়ে খেয়ে মেয়েটা শেষ। জোর করে বাসায় ধরে আনলাম।
আম্মা রুমাকে জিজ্ঞেস করলো কিছু হয়েছে নাকি মা?এমন দেখাচ্ছে কেন তোমাকে?''
তখনকার মত আম্মুকে থামালাম। ও চলে যাবার পর সব খুলে বলতেই ,
: আহারে এত ভাল মেয়েটা। এখনকার ছেলে গুলা এত খারাপ হয়!
: বুঝতে পারছিনা আম্মা। কি যে করবে রুমা। সারাক্ষন কাঁদছে।
অবশেষে চলে যাচ্ছে হাসান ভাই। রুমার অবস্থা পাগলের মত। আর দিন দশেকের মধ্যেই ভিসা হাতে পেয়ে যাবে। এর মধ্যে হঠাৎ হাসান ভাইয়ের ফোন। কাজী অফিসে বিয়ে করতে রাজী হবে রুমা? এখন তাহলে কাউকে জানানোর দরকার নেই।
বাইরে থেকে এসে বাবা মাকে বলবে।
রুমার পক্ষে সাক্ষী আমি। হাসান ভাই তার কিছু বন্ধুবান্ধব নিয়ে শুধু বিয়েটা সারবে।
কাজী অফিসে বসে আছি। ১১ টার মধ্যে আসার কথা।
আসছেনা। রুমার দিকে তাকালাম। এত সুন্দর লাগছে মেয়েটাকে। চোখের কোলে গাঢ় কালির দাগ কদিনের অনিয়ম আর কান্নার প্রতীক হয়ে ভেসে আছে। তবু আজ তার সুখের কথা ভেবে নতুন জীবনের কথা ভেবে আবেগে আমি জমে যাচ্ছি।
এত জেদ করে বিয়ে,হাসান ভাই সুখে রাখবেতো রুমাকে?
কোন ধরনের আশঙ্কায় ঢুকতে দিচ্ছিনা ভেতরে। কিন্তু এখনো আসছেনা কেন? রুমার দিকে তাকাচ্ছি ভয়ে ভয়ে, প্রায় ঘন্টাখানেক পেরিয়ে গেছে। কাজী অফিসে লোকজন আসছে যাচ্ছে। হঠাৎ ফোন করে বলল তুমি বাসায় চলে যাও আমি একটা ঝামেলার মধ্যে পড়ে গেছি।
রুমা ভেঙে যাচ্ছে আমি চোখের সামনে দেখছি।
আমার কিছু করার নেই। নিজেকে এর চেয়ে বেশি অসহায় লাগেনি কখনো। আমার কিছুই করার নেই। মুখে থুথু জমছে।
: শুয়োরের বাচ্চা।
চল ওঠ...
বলেই রুমার হাত ধরে টানলাম। একটা ঠান্ডা হাত বেয়ে টের পাচ্ছি বুকের হু হু কান্নার আওয়াজ। দুজনে দাঁড়াতেই দেখি দরজার সামনে হাসান ভাই হাতে এক গোছা ফুল।
হতভম্বের মত শুধু দেখলাম। রুমা এক দৌড়ে ছুটে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে,এতক্ষন ধরে রাখা কান্নায় ভেসে যাচ্ছে হাসান ভাইয়ের পান্জাবী।
অস্ফুট হয়ে কানে আসলো, ''পাগলী আমার''।
সারাদিনের নাটকীয়তায় মাঝে মাঝেই খুব অবাক লাগছে। এত কিছুর দর্শক আমি! ক্লান্তিতে দুচোখ ভেঙ্গে আসছে। একটু আগে কথা বললাম রুমার সাথে। হাসান ভাইয়ের এক ফ্রেন্ডের বাসায় বাসর হচ্ছে।
ভালবাসা কি অদ্ভুত! আজ রুমার মন ভেঙে যেতে পারতো। কিন্তু দুজন নিশ্চয়ই এখন খুনসুটিতে ব্যাস্ত!
খাতা কলমটা টেনে নিলাম। ময়নাকে নিয়ে লেখাটার আজ এস্পার ওস্পার করেই ছাড়বো। বাস্তবে তার কোনো শাস্তী না হোক আমার গল্পে তার সাজা সে পাবেই।
শাস্তী পাবার পূর্ব মুহূর্তে বুড়া সুলেমানের চেহারা ভাসছে আমার চোখের সামনে,খোঁচা খোঁচা আধা কাঁচা আধা পাকা দাড়ি,চোখ কোটরাগত ময়নার স্বামী।
তেজী ময়নার সামনে অসহায় এক পুরুষ। হুম লিখে ফেলতে হবে এখুনি .....।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।