মুক্তমত প্রকাশের প্লাটফর্ম ব্লগ। তাই ব্লগে বসতে ভা্ল লাগে....।
বাসা থেকে একটু তাড়াতাড়িই বের হয়ে গেলাম। গতবার অল্প একটুর জন্য ট্রেনটা মিস করেছিলাম। তাই এবার আর রিস্ক নিলাম না।
পৌনে ১টায় ট্রেন আসবে। ১০ মিনিটের যাত্রাবিরতি। তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে ট্রেন। পৌঁছাবে সকাল ৭টায়। শীতের দিন।
একটু একটু শীতও করছিল। ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে ফ্লাটফর্মের একটা দোকান থেকে সিগারেট জ্বালালাম। আশেপাশে পরিচিত কারো চোখ পড়তে পারে ভেবে একটু সামনে এগিয়ে গেলাম। ফ্ল্যাটফর্মটা অনেক বড়। তবে শেষপ্রান্তের দিকে তেমন মানুষ নেই।
কয়েকটা মানুষ জড়োসড়ো হয়ে শুয়ে আছে। কেউ কেউ আবার প্লাস্টিক দিয়ে জুপড়ির মতো অস্থায়ী বাসা বানিয়েও ঘুমাচ্ছে। সকাল হলে এসব জুপড়ি আর থাকবে না। আস্তে আস্তে হাঁটছি। জুপড়ির ভিতর থেকে হঠাৎ একটা মেয়ে বের হয়ে কোনোদিকে না তাকিয়েই সালোয়ারটা খুলে বসে পড়লো।
আশেপাশে দু’য়েকটা লোক হাঁটাহাঁটি করছে। মেয়েটার দিকে তাকাতে তাকাতে একটা বয়স্ক লোকও হেঁটে গেল। পেছনে তাকিয়ে দেখলাম দূর থেকে তিন-চারটা ছেলেও একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে মেয়েটার দিকে। কেমন যেন লেগে উঠলো। মেয়েটার কোনো অভিব্যক্তি দেখলাম না।
মূহুর্তের মধ্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল। তাকাতে ইচ্ছে করলো না ওদিকে। একটুও লজ্জা নেই মেয়েটার? নিজের মনে প্রশ্ন এলো।
একটু একটু ঘুম পাচ্ছিল। চিন্তা করলাম ট্রেনেতো ঘুমানো যাবে।
পাশ থেকে কার যেন ডাক শুনলাম। ফিরে দেখি মেয়েটা। কাউকে খুঁজেন? না! বলে আমি মুখ ফিরিয়ে নিলাম। একটু রাগ লাগলো মেয়েটাকে আবার দেখে। একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম।
পায়ের সামনে ছুটাছুটি করছে ইঁদূরের দল। বুঝা যায় দিনে এখানে এটা ওটা কেনা-বেচা হয়। একটু দূরেই মেইন রোড়। মানে বাস রোড়। এখনো বাস-রিকসা-সিএনজি চলাচল করছে।
চায়ের দোকানগুলোও কয়েকটা খোলা আছে। দু’য়েকটা দোকান সারারাতই খোলা থাকে। স্টেশানের লাল-সবুজ বাতিগুলো জেগে আছে। স্টেশানের ওপারে জব্বার মিয়ার ছোট চা দোকানে খুব ভাল চা পাওয়া যায় শুনেছিলাম। কিন্তু খাওয়া হয়নি কখনো।
চিন্তা করলাম এখন একটু চা খেয়ে নিলে মন্দ হয় না। ঘুম ঘুম ভাবটা কেটে যাবে। ফ্লাটফর্ম থেকে নেমে রেল লাইন দিয়েই হাঁটতে লাগলাম। ফ্লাটফর্মটা উচু হওয়ায় রেল লাইনে আলো আসছে না। অন্ধকারে রেল লাইনে হাঁটা ঠিক হবে না মনে করে আবার উঠে এলাম।
ফ্লাটফর্মের শেষের দিকের একটি জুপড়ি ঘর থেকে আলো বের হচ্ছিল। মনে হলো হারিকেন বা মোম জ্বালিয়ে রেখেছে কেউ। কিন্তু আলোটার সামনে একটা হাতের ছায়া দেখতে পেলাম। নাড়াচাড়া করছে হাতটা। মেহেদি লাগালে মেয়েরা যেমন করে সাবধানে হাত নাড়ায়, ওরকম নড়ছে হাতটা।
মৃদূস্বরে একটা শিশুর কান্নার আওয়াজও শোনা যাচ্ছে ওখান থেকে। আলোর সামনে একটা মেয়ে এগিয়ে এসে বসলো। ঘরে আলো থাকায় প্লাস্টিকে ছায়া পড়ছে। তাতে বোঝা গেল, এটা একটা মেয়ে নয়তো মহিলা। মনে হলো কান্না থামাতে মেয়ে/মহিলাটি খুব দ্রুত তার বুকের কাপড় খুলে একটি স্তন শিশুটির মুখে গুজে দিল।
স্তনদুটি স্পষ্টই দেখা যাচ্ছিল শরীরে আড়াল করা আলোর ছায়াতে। শিশুটির স্তন চোষার শব্দ বাইরে থেকে স্পষ্ট না হলেও বুঝতে পারার মতো শোনা যাচ্ছে। আমার পা’য়ের শব্দ শুনে হয়তো, মেয়েটা হাত দিয়ে প্লাস্টিকটা সরিয়ে ধরলো। মেয়েটার বুক যে খোলা বা আমার যে চোখ পড়লো মেয়েটির বুকে সে বিষয়ে মেয়েটির কোনো আক্ষেপ দেখলাম না। একটু যেন সিউরে উঠতে দেখলাম।
কিন্তু আমার দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একটু পরে চোখ সরিয়ে ডানে-বামে কি যেন খুঁজলো। ঠোঁটের লেপটানো লিপস্টিক আর তেল ছুপছুপ করা চুলের সিঁথি দেখে বুঝতে পারলাম মেয়েটা এতো রাতেও সেজে আছে। কিছু বুঝে উঠার আগেই মেয়েটা হাত উঁচিয়ে ইশারায় ডাক দিল। বললাম, আমি? মেয়েটা কিছু না বলে আবার ইশারা করল।
কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। মেয়েটা একটু সরে বসল। মেয়েটির দৃষ্টি অনড়। তখনও শিশুটি মেয়েটার বুকে মুখ দিয়ে আছে। আমার আর দাঁড়াতে ইচ্ছে হলো না।
চা দোকানের দিকে হেঁটে গেলাম। বৃদ্ধ বয়সী একটি লোক সারা শরীরে চাদর পেঁছিয়ে চা বানাচ্ছে। বুঝতে পারলাম এই হচ্ছে জব্বার মিয়া। কয়েকজন লোক জব্বার মিয়ার দোকানে বসে গল্প করছে। কেউ সিগারেট টানছে।
শীতের কারণে সবাই খুব জড়োসড়ো হয়েই বসে আছে। চিন্তা করলাম এদের কি ঘর-বাড়ি নেই। শীতের মধ্যে এতো রাতে এখানে বসে আছে কেন। আমি আর বসলাম না। একপাশে দাঁড়িয়ে একটা রুটি বিজিয়ে চা খেয়ে আবার ফিরে এলাম।
ফেরার পথে জুপড়িটির দিকে কেন যেন চোখ গেল। এখনো শিশুটি কান্না করছে। কিন্তু এখন মেয়েটা নেই। একটা ভেজা বস্তা বিছানো। মনে হয় শিশুটি হিসু করেছে।
তাতেই শিশুটি শুয়ে শুয়ে কান্না করছে। খুব যে শীত করছে বোঝা যাচ্ছে। কিন্তু মেয়েটাকে কিছুতেই দেখতে পেলাম না। জুপড়িতে নেই। না, আশে-পাশে কোথাও নেই।
শিশুটি পড়ে ছিল টুকরো কাগজ আর ছেড়া কাপড়ের তৈরী বিছানাটার বাইরে। হাতের মুঠোয় ধরা দুটি ছোট পাথর আর একটা সিগারেটের উচ্ছিষ্ট অংশ। একটু এগিয়ে গেলাম। মনে হলো এই মুহুর্তে শিশুটির থেকে কষ্টে কেউ নেই। খুব খারাপ লাগছিল।
আবার মায়াও হচ্ছিল। আমি আরো কাছে গেলাম। শিশুটি কান্না থামিয়ে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। দূর থেকে ষ্ট্রেশনের ঘন্টা শুনতে পেলাম। মনে পড়লো ট্রেন আসার সময হয়ে গেছে।
আবার ফ্লাটফর্মের দিকে হাটতে লাগলাম। শিশুটি আর মেয়েটির ব্যাপারে মনে মনে একটা সিদ্ধান্ত তৈরী করে নিলাম। সে হয়তো শিশুটিকে মাটিতে ফেলে রেখে প্রকৃতির ডাকে গেছে। কিংবা হাসিমুখে বেরিয়ে গেছে কারো বিকৃত রুচির কাছে আত্মসমর্পন করতে। হয়ত ফিরে এসে শিশুটিকে কোলে তুলে নিবে।
কিংবা তখন তার আর ইচ্ছে করবে না কোলে নিতে। বিছানাটা ঠিক করে পাশে নিয়ে শুয়ে পরবে।
ওদিক দিয়ে ট্রেন যাওয়ার সময় তাকালাম। জুপড়িটা চিনলাম না। সবকটি জুপড়ির বাতি নেভানো।
হয়ত ওই জুপড়িটিও অন্ধকার হয়ে গেছে তাই। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।