হিন্দু না ওরা মুসলিম ঐ জিজ্ঞাসে কোনজন, কান্ডারি বলো ডুবিছে মানুষ সন্তান মোর মা'র
রোম সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে যখন সূচীত হয়েছে অন্ধকার যুগ আর গ্রিক জ্ঞান বিজ্ঞান যখন ইউরোপীয় মনন থেকে হয়ে গেছে প্রায় বিস্মৃত তখন মুসলিম দুনিয়ায় চলছে জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এক অভুতপূর্ব কর্মযজ্ঞ। মূলত আব্বাসিয় খলিফাদের আমলে মুতাযিলা নামক যুক্তিবাদী আলেম সমাজের প্রভাব, বায়তুল হিকমা নামক পাঠাগারের প্রতিষ্ঠা, শাসক শ্রেণীর পৃষ্ঠপোষকতা এবং ব্যাপক হারে গ্রিক ও ভারতীয় পুস্তকের অনুবাদের মধ্য দিয়ে সূচিত হয়েছিল মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার এই স্বর্ণযুগের। গ্রিকদের পরই জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় নেতৃত্ত্বের পতাকা হাতে তুলে নিয়েছিল আরব ভুখন্ডের মুসলমানরা।
দর্শন এবং বিজ্ঞান চর্চায় সেকালের আরব মনিষীরা কোরআন হাদিস থেকে জ্ঞান খুঁজে বের করা দূরে থাকুক, ইসলামী ধর্মতত্ত্বের সাথে দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের সমন্বয় বিধানেও সচেষ্ট ছিলেন না, বরং যৌক্তিক এবং গানিতিক উপায়ে জ্ঞানের অনুসন্ধান করেছেন, অনেকে আবার আধুনি পর্যবেক্ষনলদ্ধ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির অনুসরণও করেছেন, ভিত তৈড়ি করে গেছেন ভবিষ্যতের ইউরোপিয় রেনেসার। মুসলিম দুনিয়ার প্রথম মহা দার্শনিক ক্ষাত আল কিন্দি আর সর্বশেষ মহা দার্শনিক ক্ষাত ইবনে রুশদ অবশ্য সচেষ্ট হয়েছিলেন দর্শন ও ধর্মের সমন্বয় বিধানে, দার্শনিক বিরোধী প্রতিক্রিয়াশীলদের বিরোধীতা মোকাবেলা করতেই এই পদ্ধতির অনুসরণ করেছিলেন তারা।
এর বাইরে আল রাজী, ইবনে সিনা, আল ফারাবী, ইবনে হাইথামরা নিজেদের দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক মতবাদ প্রচারের ক্ষেত্রে ধর্মতত্ত্বের পরোয়া করেন নাই।
চিকিৎসাবিদ্যা এবং জীববিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় মুসলিম বিজ্ঞানীরা মধ্যযুগে যে ব্যাপক কর্মযজ্ঞ চালিয়েছেন তার প্রভাব ছিল সূদুরপ্রসারী। ইবনে সিনা, আল রাজীদের জীব বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় লিখিত গবেষনা পুস্তকগুলা আধুনিক যুগের প্রারম্ভিক কাল পর্যন্ত প্রামান্য পুস্তক হিসাবে ব্যাবহৃত হতো ইউরোপে। এমন কি বিবর্তনবাদ বিষয়ক জ্ঞানের বিকাশেও গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা ভাবনা এবং গবেষণা করে গেছেন একাধিক মুসলিম বিজ্ঞানী। এইক্ষেত্রে প্রথমেই যার নাম আসে তিনি আল জাহিজ (৭৮১-৮৬৮/৮৬৯)।
আল জাহিজ এর সময়টা ছিল মুসলিম দুনিয়ায় জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চার স্বর্ণযুগ বলে ক্ষাত আব্বাসিয় খেলাফতের সময়, বিখ্যাত জ্ঞানপিপাষু খলিফা আল মামুনের শাসনামলে তিনি তার গবেষনা কর্ম পরিচালনা করেন। মুতাযিলাদের দরবারিই অবস্থান এবং বারমাইকদের পৃষ্ঠপোশকতা এবং বাইতুল হিকমার প্রতিষ্ঠা তৎকালিন আরব ভুখন্ডে রীতিমত বিপ্লব নিয়ে এসেছিল। আব্বাসিয় খেলাফতের সময়কার উপযুক্ত পরিবেশই জাহিজএর মতো একজন দাস বংশজাত এবং প্রথম জীবনে মৎস বিক্রেতাকেও শুধু জ্ঞান চর্চার সূযোগই গড়ে দেয় নাই বরং সমসাময়িক কালের একজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনিষীতে পরিণত হতে সহায়তা করেছে।
অতি উৎসাহী কারো কারো মতে আল জাহিজই হচ্ছেন প্রথম ব্যক্তি যিনি “প্রাকৃতিক নির্বাচন” তত্ত্বের প্রবর্তন করেন। কিন্তু আল জাহিজ প্রকৃত অর্থে একজন ক্রিয়েশনিস্টই ছিলেন, আল্লাহ এই দুনিয়া এবং তাবৎ প্রাণীকূল সৃষ্ঠি করেছেন এই বিশ্বাস তিনি রাখতেন।
কিন্তু শিকার এবং শিকারীর মধ্যে সম্পর্ক, টিকে থাকার প্রতিযোগিতা ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনা করেছেন তিনি তার একাধিক পুস্তকে, বিশেষ করে কিতাব আল হাইওয়ান অর্থাৎ “প্রাণী বিষয়ক পুস্তক”এ। বিবর্তনবাদ না বরং তার মূল অবদান এনভাইরনমেন্টাল ডিটারমিনেজমের ক্ষেত্রে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভিন্নতার কারণে যে প্রাণীকূলের বিভিন্ন বৈশিষ্টে পরিবর্তন আসতে পারে তার ব্যখ্যা করেন আল জাহিজ। তবে বিবর্তনবাদে সরাসরি অবদান না রাখলেও আল জাহিজই খুব সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যিনি প্রকৃতিতে বাস্তু সংস্থান প্রক্রিয়া ব্যাখ্যা করেন। মজার ব্যাপার হল কিতাব আল হাইওয়ায়নএ জাহিজ এমন কিছু দার্শনিক এবং বিজ্ঞানীদের সমালোচনা করেন যারা কিনা এক প্রাণী থেকে আরেক প্রাণীর আবির্ভাবের আজগুবি ধরণের বিবর্তনবাদী তত্ত্ব প্রচার করতেন।
মধ্যযুগীয় এইসব বিবর্তনবাদীরা এক প্রাণীর সাথে আরেক প্রাণীর সংকরায়নের মাধ্যমে নতুন প্রজাতির আবির্ভাবের তত্ত্ব প্রচার করতেন। আমাদের সময়কার হিসাবে এই ধরণের বিবর্তনবাদ অবৈজ্ঞানিক গণ্য হলেও সেই মধ্যযুগেও যে বহু মানুষ প্রাকৃতিক উপায়ে প্রাণীকূলে পরিবর্তন এবং নতুন প্রজাতির আবির্ভাব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন সেইটা বিবেচনা যোগ্য বিষয় বটে।
তবে বিবর্তনবাদ বিষয়ে অপেক্ষাকৃত সুষ্পষ্ট সমর্থন এবং আলোচনা পাওয়া যায় প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ইবনে মিসকাওয়ার রচনায় (৯৩২-১০৩০)। মিসকাওয়ার সময়টা স্বাধীন এবং প্রতিবাদী দার্শনিকদের সময়। খলিফার দরবার থেকে ততদিনে মুতাযিলাদের বিচ্যুতি ঘটেছে, হাদিসপন্থী কট্টরপন্থী আলেম সমাজ তখন ক্রমেই শক্তিশালী হচ্ছে।
অন্যদিকে ইবনে সিনা, আল ফারাবি, আল রাজির মতো দার্শনিকরা স্বাধীনভাবে নিজেদের গবেষনা কর্ম চালিয়ে যাচ্ছেন, বিরুদ্ধ মতের সাথে লড়াই করছেন, এক যায়গা থেকে আরেক যায়গায় হিজরত করছেন। কিন্তু মুতাযিলাদের পতনের পর এই সময়টায় গড়ে ওঠে নতুন এক গুপ্ত দার্শনিক সংগঠন। এই গুপ্ত সংগঠনের নাম ছিল ইখওয়ান আল সাফা, অর্থাৎ “পবিত্র ভাতৃসংঘ। এই ভাতৃসংঘের সদস্যরা মাসে তিনবার গোপনে মিলিত হতেন তাদের দার্শনিক এবং বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা বিষয়ে মতবিনিময় এবং কর্মপন্থা ঠিক করার জন্য। গোপন সংগঠন হলেও এই সংগঠনের কর্মীরা দীর্ঘ পরিশ্রমের মাধ্যমে রচনা করেন ৫২টি গবেষনা পত্র এবং এই রাসা’ইল ইখওয়ান আল সাফা নামক ৫২টি গবেষনাপত্রের একটি এনসাইক্লোপিডিয়া যা এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ব্রাদারেন অফ পিউরিটি নামে খ্যাত।
পবিত্র ভাতৃসংঘের প্রকৃত সদস্য সংখ্যা এবং সদস্যরা কে ছিলেন তা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি জানা যায় নাই। বিভিন্ন গবেষক বিভিন্ন সময়ে যেইসব মনিষীর নাম উল্লেখ করেন তাদের মধ্যে রয়েছেন আবু সুলায়মান আল-বুসিতি, আবুল হাসান আল-জাঞ্জানি, আবু আহমেদ আল-নাহারাজুরি, আল-আতফি, যায়েদ বিন রিফা, ইবনে মিসকাওয়া প্রমুখ। শরীয়া আইনের প্রভাব তখনকার মুসলিম দুনিয়ায় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, অথচ এমন সময়েই এই সংঘ শরিয়া আইনকে ভ্রান্তি ও কুসংস্কারসর্বস্ব বলে অভিহিত করেন এবং একমাত্র দার্শনিক চর্চার মাধ্যমেই আইনকে বিশুদ্ধ করা সম্ভব বলে অভিমত দেন। পবিত্র ভাতৃসংঘের ৫২টি গবেষনা পত্রের মধ্যে একটা ছিল ইবনে মিসকাওয়ার আল ফওজ আল আসগার। এই গবেষনা পত্রে ইবনে মিসকাওয়া যে অভিমত প্রকাশ করেন যে পরম সত্ত্বা থেকে বস্তুর আবির্ভাব হয়েছে।
আর এই শক্তি’র বলে এই বস্তুতে পরিবর্তন এসেছে। বস্তুতে ক্রমান্বয়ে বাস্প এবং বাস্প থেকে পানির আবির্ভাব হয়েছে। পরবর্তি পর্যায়ে আবির্ভাব হয়েছে খনিজ পদার্থের, আর এই খনিজ পদার্থ থেকেই আবির্ভাব ঘটেছে প্রবাল এবং প্রবাল থেকে বৃক্ষরাজীর। আর গাছের মধ্যে সবচেয়ে উঁচু পর্যায়ে আছে খেজুর গাছ, খেজুর গাছ হলো বৃক্ষ আর চলন্ত জীবকূলের মধ্যবর্তি প্রাণ। বৃক্ষ থেকে প্রাণী, এবং বিভিন্ন প্রাণীর মধ্য থেকে ক্রমিক বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বানরকূলের আবির্ভাব,এবং এই বানরকূলে আদীম বণ্য মানুষের আবির্ভাব এবং এই বণ্য মানুষের বিবর্তনে আধুনিক মানুষের আবির্ভাবের পক্ষে মতামত তুলে ধরেন ইবনে মিসকাওয়া।
তিনি আরো বলেন যে মানুষ বিবর্তিত হয়ে সাধু সন্যাসী এবং নবির আবির্ভাব হয়, এর পরবর্তি পর্যায় হলো ফেরেশতা, এবং বিবর্তনের সর্বশেষ পর্যায় হলো আল্লাহ।
মিসকাওয়া পরবর্তি মুসলিম দুনিয়ায় আল খাজানি, আল বিরুনী প্রমুখ মনিষী বিবর্তনবাদ সম্পর্কৃত বিভিন্ন মতামত তুলে ধরেন। কিন্তু ১১ শতকের পরবর্তি মুসলিম দুনিয়ার জ্ঞান বিজ্ঞান চর্চায় ক্রমিক অধঃপতন এবং কট্টরপন্থার উত্থান বিবর্তন বিষয়ক চিন্তায় প্রাচ্যে নতুন কোন ধারণা তৈরিতে ব্যর্থ হয়। তবে প্রাচ্য যখন ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারে, পাশ্চাত্য তখন মুসলিম দার্শনিক ও বিজ্ঞানীদের গবেষনা সংরক্ষন এবং পাঠের মাধ্যমে অব্যাহত রেখেছে জ্ঞান চর্চার ধারাবাহিকতা, মানব সভ্যতার বিকাশ। যার ধারাবাহিকতায় আমরা এক পর্যায়ে পেয়েছি চার্লস ডারউইন এবং প্রাকৃতিক নির্বাচন।
তবে সেইখানেই শেষ না, ডারউইনের সময়ে অনেক অমিমাংসিত প্রশ্নের উত্তর এখন পাওয়া যাচ্ছে আধুনিক জিন তত্ত্বে, ডকিন্সের মিম তত্ত্বে। এনাক্সিমেন্ডার, মিসকাওয়া, ডারউইন কিংবা ডকিন্স এরা বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন ভুখন্ডের বিচ্ছিন্ন মানুষ হতে পারেন, কিন্তু মানব জ্ঞানের ক্রমবিকাশের ধারায়, কাল নিরপেক্ষ মানবতায় এরা এক অবিচ্ছিন্ন মানব সভ্যতার অংশমাত্র। মিসকাওয়া অথবা ডারউইন তাই আমাদের কোন দুরবর্তী ব্যক্তি নন, আমাদের অস্তিত্ব এবং জ্ঞান খন্ডের পরিচয়। মানব জ্ঞানের ধারাবাহিক ক্রমবিকাশের ওপর এই আস্থাটুকু রাখলে আমরাও পরিনত হতে পারি কাল নিরপেক্ষ মানবতার অংশে।
[ লেখাটি গতকাল ডারউইন দিবস উপলক্ষে আয়োজিত পাঠচক্রের জন্য লিখিত প্রবন্ধের অংশবিশেষ।
]
তথ্যসূত্রঃ
মুসলিম ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন - ডঃ আমিনুল ইসলাম, পৃঃ ১৬৫ এবং পৃঃ১১৪-১১৯
http://en.wikipedia.org/wiki/Al-Jahiz
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।