অঙ্ক আর কাঁটাতারের হিসেবটা আমার কাছে প্রায় একইরকম. কোনওদিন মেলেনি. ধর্মের হিসেবটাও ওরকমই. মনে পড়ে, তখন আমি ক্লাস ফাইভ কি সিক্সে পড়ি. স্কুল থেকে সবে বাড়ি ফিরেছি. খাওয়া-দাওয়া শেষ করে বাবার কাছে অঙ্ক শিখতে বসতে হত. বিকেলের শেষ আলো তখন বারান্দার কার্নিশ বেয়ে উপরে উঠে যাচ্ছে. একটু পরেই ভ্যানিশ হয়ে যাবে. আমি পিতা-পুত্রের বয়সের হিসেব আর কষে উঠতে পারছি না. বাবার রোষ ক্রমশ বেড়ে চলেছে. কিন্তু অঙ্ক আর মিলছে না. মাঝে মাঝে সেই সময় আমার পরিত্রাতা হয়ে এগিয়ে আসত বৃষ্টি. নামলেই আমার ছুটি. এখন আর তেমন বৃষ্টি নামে না. আমিও অঙ্ক থেকে পালিয়ে যেতে পারি না. ধরা পড়তেই হয়. বয়স যতই বেড়েছে, অঙ্কের চেহারাটাও বড় হয়েছে. এখন অঙ্ক আমার বাবা শেখান না, অঙ্ক শেখাতে বসেন মৃত্যুর ব্যাপারীরা. বৃষ্টি অমিল. তবে কিছুটা পরিত্রাণ দেন কবির সুমন. এখন তাঁর একটি পুরোন অ্যালবামের পুরোন গান শুনতে শুনতে ভাবনাটা চাগিয়ে উঠল. ...ধরা পড়ে যায় দেহটাই শুধু ধরা পড়বে না মন, ধরা না পড়ার হাওয়ায় দুলছে সুদূরের শালবন... আহা, কি অসম্ভব সুন্দর কথা. এমন গানের পর একটি অন্তত ভাবনা মনে দুলে না উঠলে, সেই গানটিই অর্থহীন হয়ে যায়. এমনটা ভাবতেই, মনে হল গানটা যেন শাহবাগ চত্বরে বসা আমার মতোই একঝাঁক বন্ধুদের আন্দোলনকে নিয়ে লেখা. কোথায় যেন সব মিলে গেল হঠাত্ করে. প্রতিটি শব্দ আর সুর ছুটে চলল শাহবাগের উদ্দেশে. ধর্ম নিরপেক্ষ বাংলাদেশ গড়ার জন্য বন্ধুদের আন্দোলন আমাকে এই সুদূর কলকাতায় বসে সমর্থন করতে হচ্ছে. এখানেও গানটি কত অর্থবহুল. ওই যে প্রথমেই বললাম, অঙ্ক আর কাঁটাতারের হিসেবটা আমি মেলাতে পারিনি কোনওদিন. তাই কাঁটাতার পেরিয়ে মনটাকে উড়িয়ে দিলাম শাহবাগের দিকে. আমাদের আদি ভিটে বরিশালে. তবে একাত্তরের আগেই আমার ঠাকুরদা ও তাঁর ভাইয়েরা ভারতে চলে আসেন. বাবার জন্মও ভারতে. ঠাকুরদাকে আমি দেখিনি. বাবার মুখে অল্পবিস্তর শোনা তাঁর ব্যাপারে. কিন্তু আমার বড় হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই আমি একটি বাঙালি মন পেয়েছি. আর এই মনটির শিকড় খুঁজতে গেলেই আগেভাগে উঁকি দিয়ে যায় বাংলাদেশ, উঁকি দিয়ে যায় বরিশাল. বাংলাদেশে আমার প্রজন্মের দাবি নিরপেক্ষ বাংলা, আমারও দাবি তেমনই. প্রশ্ন উঠতেই পারে কোন অধিকারে আমি এই দাবি করতে পারি. উত্তর হল ভালবাসার অধিকারে. আর এখানেই কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি লাইন আওড়াতে আমি বাধ্য, ভালবাসা পেলে আমি সব লণ্ডভণ্ড করে চলে যাব. হয়তো এই ক্রেজি ব্যাপারটার প্রয়োজন এক্ষুনি, এই মুহূর্তে. তাই কাঁটাতারের এপারে ধরা পড়ল আমার দেহ, কিন্তু মনটাকে ধরতে পারেনি কেউ, যা উড়ে চলেছে শাহবাগের দিকে. ওখানকার বাংলায় যখন আন্দোলনের নেপথ্য তৈরি হচ্ছে, তখন আমি এদেশের বাংলায় ব্যস্ত. কলকাতার রাস্তায় ধোঁয়া তোলা বাস, ট্যাক্সির জঙ্গল পেরিয়ে চলছি অফিসের দিকে, আবার দিনের শেষে একই রাস্তা দিয়ে বাড়ির দিকে. কিন্তু আশ্চর্যের কথা এই দুদিকে যাতায়াতের পথেই পড়ে কলকাতার বিখ্যাত ব্রিগেড. ব্রিগেডের দিকে চোখ পড়ে. ব্রিগেডের ওপর থেকে স্পটলাইট সরে যায়, তা গিয়ে পড়ে শাহবাগে. ওখানে বসে আছে অজস্র বন্ধু, প্রকৃত স্বাধীনতাকামী তাঁরা আমার সহযোদ্ধা. শাবাশ শাহবাগ, শাবাশ প্রজন্ম. আরও একবার শাবাশ জানাতে আমি বাধ্য, সেটা মিডিয়াকে. শাহবাগকে আমার কাছে এতো দ্রুত পৌঁছে দেওয়ার জন্য, আর আমার বার্তা শাহবাগে.
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।