আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

৫২ পার্সেন্ট সত্য ঘটনার উপর নির্ভর করে লেখা গল্পচৌধুরী আমজাদ খার কবর থেকে উঠে আসার পর

যে মুখ নিয়ত পালায়......। ।

চৌধুরী আমজাদ খাঁ সাহেব আজ তিনদিন হল কবর থেকে উঠে এসেছেন। তিনদিন মানে বাহাত্তর ঘন্টা,মিনিটের হিসেবে ৪হাজার তিনশত বিশ মিনিট আর সেকেন্ডের হিসেবে দুই লক্ষ উনষাট হাজার দুইশত সেকেন্ড। এত সময় ধরে তিনি এই পৃথিবীতে আছেন।

তার মৃত্যু হয় গত ৪ঠা অক্টোবর ২০১০ ইংরেজি, বাংলা ১৯ সে আশ্বিন ১৪১৭ সালে এক পড়ন্ত দুপুরে। বেশ ভালভাবেই মৃত্যু হয় বলা যায়। সুস্থ সবল মানুষ হঠাৎ করেই মারা যান। এরকম মরাকে বলা হয় টুপ করে মরা। চোধুরী আমজাদ সাহেব এইভাবে টুপ করে মরে গিয়েছিলেন ওইদিন।

তারপর যথারীতি ধর্মীয় বিধি মোতাবেক তাকে রাখা হয় কবরে। কিন্তু কবরে একদিন যেতে না যেতেই তিনি বের হয়ে আসলেন। বের হয়ে আসলেন একেবারে জলজ্যান্ত অবস্থায়। এত কম সময়ে কবর কেন তার কাছে অসহনীয় হয়ে উঠল তা বলা মুশকিল। তিনি বিধাতার দূতদের প্রশ্নের পর প্রশ্নের কারনে বিরক্ত হয়ে অথবা অক্সিজেনের অপ্রতুলতার কারনে কিংবা অন্য কোনকারনেও চলে আসতে পারেন।

এটা তার ব্যাপার। তবে এই তিনদিন পৃথিবীতে থেকে তিনি নিজেই বিরক্ত হয়ে পড়েছেন। মরার পূর্বে যখন পৃথিবীতে ছিলেন তখন এরকম বিরক্তি আর অনুভব করেছেন বলে তার মনে হয় না। বিরক্তির প্রধান কারন মানুষের ব্যবহার। চৌধুরী সাহেব অনেক বিষয় ভৈববের মালিক ছিলেন উত্তরাধিকার সুত্রেই।

তার উপর তার স্বভাব ছিল সঞ্চয়ী। অতিমাত্রায় সঞ্চয়মনা মানুষ ছিলেন। তাই পৈত্রিক ভাবে প্রাপ্ত ধনসম্পত্তির উত্তরোত্তর উন্নতিও ঘটিয়েছিলেন প্রচুর। এই ধনসম্পত্তির কারনেই হোক অথবা প্রাচীন বংশগৌরবের কারনেই হোক গ্রামে উনার যথেষ্ট সম্মান ছিল। দূর থেকে দেখলে লোকে হাত তুলে সালাম দিত।

কিন্তু কবর থেকে উঠে আসার সময় পথে দু একজন চাষাশ্রেনীর লোকের দেখা পেয়েছিলেন। তারা এমনভাব দেখাল যে তাকে দেখতেই পায় নি। এই বিষয়টাই চৌধুরী আমজাদ খাঁ সাহেবের বিরক্তির প্রধান কারন। চৌধুরী সাহেব মনে মনে ভেবেছিলেন কবর থেকে উঠে এসে সবাইকে চমকে দিবেন। প্রথমে মানুষকে ভয় দেখাবার একটু ইচ্ছাও তার ছিল।

তাই লোকজন যাতে দেখতে না পায় এমনভাবে হেঠে সোজা চলে এলেন তার বাড়ির পাশে। দিনের বেলা লুকিয়ে থাকলেন বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়ের পিছনে। চৌধুরী সাহেব বিয়ে করেছিলেন তিনটা। কোন এক বিচিত্র কারনে সুন্নতের কোটা পূরন করতে পারেন নি। একটা খালি রয়ে গেছে।

এ জন্য অবশ্য তার জীবিত থাকতে অর্থাৎ প্রথমবার মরার পূর্বে কোন আফসোস ছিল না কিন্তু এখন হচ্ছে। চৌধুরী সাহেবের প্রথম বউ ছিলেন অতি উচ্চ বংশীয় মহিলা। তিনি প্রায় তিনবছর ঘর করেছিলেন। তারপর চৌধুরী সাহেবকে ফেলে চলে যান। যাবার একটাই কারন চৌধুরী সাহেবের অতি সঞ্চয়ী স্বভাব।

এরপরের বউ ছিলেন শিক্ষিত ও স্মার্ট। তিনি তখনকার দিনে চৌধুরী সাহেবকে নিয়ে সিনেমায় পর্যন্ত যেতে চাইতেন। চৌধুরী সাহেব কয়েকবার শহরে সিনেমা দেখতে নিয়েও গিয়েছিলেন তাকে। অতিমাত্রায় ধর্মসচেতন চৌধুরী আমজাদ খাঁ কিন্তু সিনেমা দেখেন নি। সিনেমা আরম্ভ হলে পর্দার দিকে পিছনদিক দিয়ে মুখ উল্টিয়ে বসেছিলেন।

এই শৌখিন মহিলার হাতের কাজ ও ছিল ভাল। সুন্দর সুন্দর নকশা করে রুমাল তৈরী করতেন। চৌধুরী সাহেব তার বৃদ্ধ বয়স পর্যন্ত তার দ্বিতীয় স্ত্রীর এক খানি নকশা করা রুমাল সযত্নে রেখেছিলেন। মাঝে মাঝে বৃদ্ধ বয়সে পাশের বাড়ির ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের সাথে কথা বলে সময় কাটাতেন বৃদ্ধ আমজাদ খাঁ। তখন ওদের কাউকে কাউকে কথাপ্রসঙ্গে রুমালখানি দেখাতেন।

এতদিনের এতসময়ের আলো বাতাসের স্পর্শেও রুমালখানির যেন কিছু হয় নি। আশ্চর্য উপায়ে এটাকে সংরক্ষন করে রেখেছিলেন এই বৃদ্ধ। আমজাদ খাঁ কিন্তু তার দ্বিতীয় স্ত্রীকেও ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি চলে যান বছর দু এক ঘর করে। এক্ষেত্রেও প্রধান কারন ছিল আমজাদ খাঁ সাহেবে অতিরিক্ত সঞ্চয় প্রবনতা।

এরপর সংসার টিকানোর জন্য এক গরীব ঘর দেখে তৃতীয় স্ত্রীকে ঘরে আনেন। ঐ মহিলার ও এটা দ্বিতীয় বিয়ে। তাই মোটামোটি সংসার ভাঙ্গার কোন উপায় তেমন ছিল না। এবং ভাঙ্গেও নি। আমজাদ সাহেবের এই স্ত্রীর ঘরে জন্ম নেয় তার একমাত্র কন্যা সন্তান।

এই নিয়েই আমজাদ খাঁ সাহেবের পরিবার। আমজাদ সাহেবের ভাই ছিল না। তবে তিনজন বোন ছিল। এদের বিয়ে ও তিনি দিয়েছিলেন ভাল ঘরেই। তিন জনই স্বামীসন্তান সহ সুখেই আছেন।

আমজাদ সাহেব তিন বোনের একমাত্র ভাই ছিলেন,তাই তার মৃত্যুতে তিন বোনই ছুটে এসেছেন। একজন এসেছেন সুদূর যুক্তরাজ্য থেকে। বেচেঁ থাকতে অর্থাৎ কবরে যাবার আগে তাদের সাথে আমজাদ সাহেবের কৃপনতার জন্য মনোমালিন্য হত এমনকি মৃত্যুর দিনপর্যন্ত তার সাথে দুই বোন কথা পর্যন্ত বলতেন না। তবে সেইসব এসব টুনকো হয়ে গেছে। আমজাদ সাহেবকে তারা সত্যি ই ভালবাসেন।

তাই ছুটে এসেছেন তার বাড়িতে। বাড়ির পাশে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকা আমজাদ খাঁ সাহেবের চোখ জোড়া আনন্দে ভিজে উঠে। রাত প্রায় বারোটার মত হবে। আমজাদ খাঁ ভাবলেন এইবার একটু ঘরের দিকে যাওয়া দরকার। এতক্ষন মানুষে গিজগিজ করছিল তার বাড়িটা।

এখন অবশ্য একটু কমেছে তবে ঘরে যে বাতি জ্বলে আছে তা বোঝা যাচ্ছে। আমজাদ খাঁ আস্তে আস্তে কয়েক পা হেটে সিড়ি দিয়ে ঊঠে দরজার কাছে গিয়ে দাড়ালেন। ঘরের মধ্যে আলোচনা সভার মত পরিস্থিতি। এক পাশে বিশাল কাঠের তিনটি চেয়ারে বসেছে আছেন তার তিনবোন। তিনবোনকে একসাথে দেখে আমজাদ সাহেবের চোখে আবারো পানি আসতে চাইল আনন্দে।

তার পাশে কয়েকটা চেয়ারে বসে আছেন পাশের বাড়ির কয়েকজন মুরুব্বি,ডানদিকের কয়েকটা চেয়ারে তার চাচাত ভাইয়ের ছেলেরা,গ্রামের কয়েকজন গন্যমান্য ব্যাক্তিদের ও দেখা যাচ্ছে বসে থাকাদের সারিতে। আমজাদ সাহেব দেখলেন একপাশে এক কোনায় তার তৃতীয় স্ত্রী,এবং তৃতীয় স্ত্রীর বড় ভাই। স্ত্রীর বড় ভাই হলেও লোকটাকে আমজাদ সাহেবের কখনোই ভাল লাগত না। রাজনীতি করে মামলা হামলার মধ্যেই থাকে সারা বছর। আমজাদ সাহেব বুঝতে চেষ্টা করলেন কি হচ্ছে।

এরা কি তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশের জন্য মিলিত হয়েছে না অন্য কিছু। অন্য কিছু ঘটার সময় কই। তিনি তো মাত্র একটা দিনই কবরে ছিলেন। কবরের দাড়োয়ান ফেরেস্তার ঘুমানোর সুযোগ নিয়ে তিনি যে বেরিয়ে এসেছেন তা তো এরা জানে না। যেভাবে শোক প্রকাশ করছে তিনি কবর থেকে উঠে এসেছেন শুনলে আনন্দে এরা লাফাত আমজাদ সাহেব মনে মনে ভাবেন।

আমজাদ সাহেব ঘরের ভিতরে গিয়ে কথা বলেই ফেলতেন কিন্তু তখনি একটা কর্কশ কণ্ঠ তাকে থামিয়ে দিল। আমজাদ সাহেবের বড় বোন কথা বলছেন, বাবার সম্পত্তিতে আমাদের ও হক আছে,আমজাদ শুধু তার বউকে দিয়ে যাবে এমনটা হতে পারে না। তার মেঝ বোন ও বলে উঠেন, আমরা আমদের এক কানা কড়ি ও ছাড়ব না। দরকার হলে মামলা হবে পুলিশ হবে। আমজাদ সাহবের স্ত্রীর ভাই ও নিজের উপস্থিতি জানান দেন, মামলার ভয় আমাকে দেখাবেন না।

। আমরা মামলা কম জানি না। উপস্থিত বৃদ্ধরা দুই পক্ষকেই থামাতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু ততক্ষনে চড়ে গেছে আমজাদ খা সাহেবের তিনবোনের ক্রোধান্মত্ত গলা। তারা এক যোগে গোষ্ঠি উদ্ধার করতে লাগলেন আমজাদ সাহেবের তৃতীয় স্ত্রীর।

আমজাদ সাহেবের স্ত্রীও গলাকে যথাসম্ভব উচুঁ করে এই সমবেত জনতার সামনে স্বামীর এই বড় তিনবোনের বিরুদ্ধে অকথ্য গালিগালাজে লেগে গেলেন। । আমজাদ সাহেব হতভম্ব হয়ে দেখছিলেন। তিনি আর পারলেন না। চিৎকার করে এসে থামতে বললেন সবাইকে।

কিন্তু তাকে আশ্চর্য করে দিয়ে তারা আগের মতই চিৎকার চেচমেচির মাধ্যমে ঘরটাকে নরকের একটা অংশে পরিনত করে তুলল। আমজাদ খাঁ সাহেব বার বার চিৎকার করে থামতে বললেন,কিন্তু কেউ তার দিকে ফিরেও তাকাল না। । তারপর থেকে এই গল্প লেখার সময় পর্যন্ত তিনি তাদের থামতে বলতেই আছেন...। ।

১৩/১১/২০১০ রাত ৩ঃ২৭

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।