টাইফয়েড একটি ব্যাকটেরিয়াঘটিত রোগ। সালমোনেলা টাইফি নামক ব্যকটেরিয়া এ রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী। যেকোন বয়সের যেকেউ যেকোন সময়ে আক্রান্ত হতে পারেন টাইফয়েডে। সারা বছর টাইফয়েড দেখা গেলেও এটা জুলাই-সেপ্টেম্বর মাসে বেশি হয়ে থাকে। প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ৬০ লক্ষ লোক টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় আর এর মধ্যে মারা যায় প্রায় ৬ লক্ষ।
বিশ্বে যত লোক টাইফয়েডে আক্রান্ত হয় ও মারা যায়া তাদের মধ্যে প্রায় শতকরা ৮০ ভাগই এশিয়ার জনগোষ্ঠী। বাংলাদেশেও টাইফয়েডের প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি। প্রতিবছর অনেকই টাইফযেডে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ও মারাও যান। এর কারণ হল, স্যানিটেশনের অভাব, স্বাস্থ্যবিধি মেনে না চলা ও বিশুদ্ধ পানির অভাব। সামান্য সচেতন হলেই টাইফয়েডের মত মারাত্মক রোগ থেকে আমরা সহজেই মুক্ত থাকতে পারি সেই সাথে রক্ষা করতে পারি আমাদের প্রিয়জনকে।
কিভাবে ছড়ায় ? টাইফয়েড রোগের জীবানু আক্রান্ত রোগীর মলমুত্র দিয়ে দেহের বাইরে বের হয়ে আসে। পরে এ জীবানু পানিতে মিশে যায়। জীবাণু দ্বারা দূষিত পানি পান করলে বা দূষিত কোন খাবার বা মাছির মাধ্যমে বাহিত জীবাণু দ্বারা দূষিত খাবার, এমনকি দূষিত পানি দিয়ে ধোয়া শাকসবজী-ফলমুল খাওয়ার মাধ্যমে দেহে ঢুকতে পারে এ জীবাণু। জীবাণু দেহে প্রবেশের ১০-১৪ দিনের মধ্যে টাইফয়েড দেখা দিতে পারে। এক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তি হঠাৎ করেই জ্বরে আক্রান্ত হন।
এ জ্বরের পরিমান দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। একসময় তা ১০৪-১০৫০ ফারেনহাইট হতে পারে। জ্বরের সাথে থাকতে পারে মাথাব্যথা, শরীর ব্যথা ও কোষ্ঠ্যকাঠিন্য। সাধারনত তাপমাত্রা বাড়লে হৃদস্পন্দন বাড়ে। কিন্তু এক্ষেত্রে তাপমাত্রা বাড়লেও হৃদস্পন্দন বাড়ে না।
দ্বিতীয় সপ্তাহে রোগীর গায়ে গোলাপী স্পট দেখা যেতে পারে। এটা সাধারনত সাদা চামড়ার অধিকারীদের ভাল বোঝা যায় কিন্তু আমাদের দেশের লোকদের ক্ষেত্রে বোঝা যায় না। এছাড়াও হতে পারে কাশি। কোষ্ঠ্যকাঠিন্য ডায়রিয়ায় রুপ নিতে পারে। সেই সাথে পেট ফুলে যেতে পরে ও পেটের ভেতর প্লীহা বা স্পীন বড় হতে পারে।
এ পর্যায় পর্যন্ত রোগীকে চিকিৎসা করালে রোগী পুরো সুস্থ হয়ে যাবেন কোন ধরনের জটিলতা ছাড়াই। কিন্তু যদি চিকিৎসা না করানো হয় তাহলে দ্বিতীয় সপ্তাহের পর রোগী প্রলাপ বকতে পারে, রোগী কমায় চলে যেতে পারে বা মারাও যেতে পারে। শুধু তাই নয় অন্ত্র ফুটা হয়ে যেতে পারে, হতে পারে রক্তপাত, এসময় রোগীর তাপমাত্রা কমে যেতে পারে। এছাড়াও আরোও অনেক জটিল সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ সমস্যাগুলো কিন্তু খুব সহজেই প্রতিরোধ করা যায় টাইফয়েড প্রতিরোধ করার মাধ্যমে।
প্রতিরোধ করুন টাইফয়েড ঃ
নিরাপদ খাবার খান ঃ সাধারনত খাবার ও পানির মাধ্যমে টাইফয়েড়ের জীবাণু ছড়ালেও এ জীবাণু কিন্তু খুব সহজেই মেরে ফেলা সম্ভব হয়। খাবার ভাল করে জ্বাল দিলেই এ জীবাণু মেরে ফেলা সম্ভব। এজন্য খাবার সঠিকভাবে রান্না করতে হবে। মাছ-মাংস ও শাকসবজী ভাল করে সিদ্ধ করে খেতে হবে। অনেকেই আছেন যারা শাকসবজী-ফলমুল, মাছ-মাংস ট্যাপের পানিতে ধুয়ে কম সিদ্ধ করেন।
এতে করে টাইফয়েড ব্যাবটেরিয়া খাবারে থেকে যেতে পারে। তাই শাকসবজী-ফলমুল পরিষ্কার ও বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। যেসব ফলমুল খোসা নেই সেগুলো খাওয়ার সময় খুব ভাল করে বিশুদ্ধ পানি দিয়ে ধুতে হবে। খোসাযুক্ত ফলমুল খাওয়ার আগে পরিষ্কার হাতে নিজেই খোসা ছাড়িয়ে নিন। লেটুসের মত সবজী খুব সহজেই দূষিত হয়ে যায় আর এগুলো ভাল করে পরিষ্কার করাও বেশ কষ্টকর।
তাই এধরনে সবজী খাওয়ার আগে সাবধান। খুব ভাল করে ধুয়ে নিয়ে তবেই খেতে পারেন। রান্না ও খাবার সরবরাহ করার সময় হাত ভাল করে সাবান-পানি দিয়ে ধুয়ে নিন। শুধু তাই নয় প্লেট, বাটি,চামচসহ বাসনকোসন, রান্না করার পাত্র ট্যাপের পানিতে না ধুয়ে ফুটানো বিশুদ্ধ পানিতে ধুয়ে নিন। আপনার তরিতরকারী কাটার জায়গাটিও সাবান পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন।
খাবার ঢেকে রাখুন। খাবারে মাছি বসলে সে খাবার খাবেন না। কারণ, শুধু টাইফয়েড নয় মাছির মাধ্যমে অনেক রোগের বিস্তার হয়ে থাকে।
পান করুন বিশুদ্ধ ও ফুটানো পানিঃ টাইফয়েড জীবানু বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দূষিত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। পানি পরিস্কার দেখালেও সেখানে থাকতে পারে টাইফয়েডের জীবাণু।
তাই খাবার পানি অবশ্যই বিশুদ্ধ করে নিতে হবে। এজন্য পানি ফুটিয়ে বা ব্লিচিং পাউডার দিয়ে জীবানুমুক্ত করতে হবে। পানি ফুটতে থাকলে কমপক্ষে ১০ মিনিট ধরে জ্বাল দিন। আবার ফুটানো পানি যদি ঠিকভাবে সংরক্ষন করা না হয় তাহলে বিশুদ্ধ পানি আবার জীবানু দ্বারা দূষিত হয়ে পড়তে পারে। তাই ফুটানো পানিকে একটি পরিস্কার পাত্রে সবসময় ঢাকনা দিয়ে রাখে ৪ ঘন্টার মধ্যে ব্যবহার করুন।
সংরক্ষন করা পানি কোন আলাদা পাত্র যেমন-মগ, বাটি, গ্লাস দিয়ে না তুলে পাত্রে ঢেলে পান করুন। বাইরের পানি পানের প্রয়োজন পড়লে বোতলজাত পানি পান করুন। ১ টাকা গ্লাসের ফিল্টার পানি পান না করাই ভাল। কারণ এগুলো কতটা বিশুদ্ধ তা নিয়ে সন্দেহ আছে। বোতলজাত পানির মধ্যে কার্বনেটযুক্ত পানি কার্বনেটবিহীন পানির চেয়ে অনেক নিরাপদ।
বাইরে যাওয়ার আগে বাসা থেকে ফুটানো পানি বোতলে ভরে নিন। এতে করে খরচও বাঁচবে সাথে বিশুদ্ধ পানি পান করতে পারবেন। পান করুন পাস্তুরাইজ করা দুধ ।
হাত ধোয়ার অভ্যাস করুন ও পরিচ্ছন্ন থাকুন ঃ আপনি কতটুকু স্বাস্থ্য সচেতন ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন তা বোঝা যায় আপনার পরিবারে কেউ টাইফয়েডে আক্রান্ত হয়েছে কিনা? টাইফয়েড থেকে বাঁচার জন্য পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন থাকুন সব সময়। শুধু হাত ধোয়ার অভ্যাসই পারে আপনাকে অনেকাংশে টাইফয়েডমুক্ত রাখতে।
সমীক্ষায় দেখা গেছে, যারা বেশি বেশি হাত ধোয়ার অভ্যাস আছে তাদের মধ্যে টাইফয়েড হওয়ার সম্ভবনা অনেক কম। তাই অবশ্যই খাওয়ার আগে ও পরে, প্রসাব-পায়খানার পর, খাবার রান্নার আগে, শিশুকে খাওয়ানোর পূর্বে অবশ্যই ভাল করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে নিন। হাতে শুধু সাবান পানি লাগালেই হবে না হাতের সামনের ও পেছনের অংশ, দুই আঙ্গুলের ফাঁকা জায়গা ও নখ ভাল করে প্রচুর পানি দিয়ে ধুতে হবে। অনেকেই নখ বড় রাখেন। নখ পরিষ্কার দেখালেও এখানে শুধু টাইফয়েডই নয় আরোও অনেক রোগের জীবাণু থাকতে পারে।
এটি হতে পারে অনেক রোগের কারণ। তাই নখ ছোট রাখুন। টয়লেট নিয়মিত পরিষ্কার করুন। যেখানে সেখানে প্রসাব-পায়খানা করবেন না। অনেকেই শিশুর পায়খানাকে খারাপ মনে না করে যেখানে সেখানে ফেলে দেন।
শিশুর পায়খানাও ছড়াতে পারে টাইফয়েডের জীবাণু। তাই শিশুর পায়খানা টয়লেটে ফেলে ভাল করে ধুয়ে ফেলুন।
বাইরের খাবার একেবারেই খাবেন না ঃ বাইরের রেস্টুরেন্টের খাবারের প্রতি বা রাস্তাঘাটের খাবারের প্রতি লোভ অনেকেরই। এটা কিন্তু আপনার স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক খারাপ হতে পারে। হতে পারে টাইফয়েডসহ জটিল জটিল রোগের কারণ।
বাইরের খাবার যতই পরিচ্ছন্ন দেখাক না কেন এগুলোতে সহজেই জীবাণুরা বাসা বাধতে পারে। আবার বিশুদ্ধ পানি দিয়ে বা ঠিকমত ধুয়ে রান্না করা হয়েছে কিনা তা কিন্তু আপনি জানেন না। রেস্টুরেন্টের সালাদ খাওয়া একেবারেই বাদ দিন। এটি খুব সহজেই পারে আপনার শরীরে জীবাণু ঢুকিয়ে দিতে। বাস্তার পাশে আখের রস, ফলমুলের রস, ঘোলসহ নানান পানীয় বিক্রি করে।
এগুলো সবই ট্যাপের পানিতে বানানো। আবার মাছিও এসবের ওপর বসে। তাছাড়া যারা এগুলো বানায় তারা মানে না নুন্যতম স্বাস্থ্যবিধান। তাই টাকা দিয়ে জীবাণু কিনে খাবেন না। রাস্তার পাশে বিক্রি করা আগে থেকেই কেটে রাখা আনারস, তরমুজসহ নানান ফলমুল কিন্তু জীবাণু ছড়াতে পারে খুব সহজেই।
গরমে হকারদেরকে ২-১০টাকার আইসক্রীম বিক্রি করতে দেখা যায়। আর অনেকেই এগুলো দেদারছে কিনে খাচ্ছেন। এসব আইসক্রিম কিন্তু বানানো হয় ট্যাপের না ফুটানো পানি দিয়ে। তাই এগুলো একদমই খাবেন না।
ভ্যাকসিন নিন ঃ টাইফয়েডের জন্য ভ্যাকসিন আছে।
৪-৬ সপ্তাহের ব্যবধানে দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিতে হয়। এ ভ্যাকসিন দিতে হবে শরীরে জীবাণু প্রবেশের আগেই। দুই ডোজ ভ্যাকসিন দিলে আপনি সাধারণত ৩ বছরের জন্য টাইফয়েড থেকে রক্ষা পেতে পারেন। এজন্য প্রতি ৩ বছর পর পর দিতে হবে বুস্টার ডোজ। গবেষনায় দেখা গেছে, টাইফয়েড প্রতিরোধে এ ভ্যাকসিন ৫০-৮০ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারে।
এজন্য শুধু ভ্যাকসিনের উপর নির্ভর করলেই হবে না। এজন্য ভ্যাকসিনের পাশাপাশি নিরাপদ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে। আবার ৬ বছরের নিচের বাচ্চাদের ও গর্ভবতী মহিলাদের ভ্যাকসিন দেয়া যাবে না।
আর এসব মেনে চলার পরও যদি টাইফয়েড হয়ে যায় তাহলে দুচিন্তা করবেন না। দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অনেক ভাল ভাল এন্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। নিয়মিত ও সঠিক সময়ে এন্টিবায়োটিক সেবন করলে আল্লাহর রহমতে দ্রুত সুস্থ্য হয়ে উঠবেন। একটা কথা মনে রাখবেন, এন্টিবায়োটিক কখনও চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া সেবন করবেন না। আর এন্টিবায়োটিকের পুরো কোর্স ঠিক সময়ে সম্পন্ন কবরেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।