আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভিখারিনি মা’কে খুঁজছেন জুরিখের সোনা



কলকাতা, ৫ আগষ্ট- কলকাতার মেয়ে সোনা। এখন থাকেন জুরিখে। কিন্তু ভুলতে পারছেন না কলকাতায় থাকা জন্মদাত্রী ভিখারিনি মায়ের কথা। ভুলবেন কি করে- নিজেও তো সন্তানের মা। সন্তান যে কি সম্পদ তাতো হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন।

তাই এখন মায়ের সন্ধান পেতে মরিয়া জুরিখের সোনা। ‘সেই তোতাপাখির খবর তিনি রাখেন না। শিকল খুলে উড়িয়ে দিলে যে তাঁর মায়ের খবর হয়তো এনে দিতে পারে। ’ সোনা ইংরেজি, জার্মান, ফ্রেঞ্চ, ইতালিয়ান জানেন। এমনকী, তামিলও।

তবে বাংলা নয়। ফলে গানটি তাঁর জানা নেই। কিন্তু মায়ের খোঁজ না-পাওয়ার বেদনা তো ভাষার গণ্ডি মানে না! তাই ফোন ধরে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলেন সোনা। থাকেন কলকাতার বহু দূরে, সেই সুইজারল্যান্ডের জুরিখে। কিন্তু বত্রিশ বছরের ওই নারীর সঙ্গে এ শহরের নাড়ির টান।

তিন দশক আগে এ শহরের উপান্তে এক গরিব মায়ের কোলে তাঁর জন্ম। জীবনসংগ্রামে বিধ্বস্ত মহিলা চার মাসের শিশুকন্যাকে তুলে দিয়েছিলেন এক হোমের কর্মকর্তাদের হাতে, সঙ্গে ছোট্ট একটা চিঠি। তাতেই লেখা ছিল, শিশুটির নাম সোনা। চিঠির বক্তব্য, ‘ভিক্ষে করে আমার দিন চলে। স্বামী নিরুদ্দেশ।

এই মেয়েকে আমি খাওয়াতে বা মানুষ করতে পারব না। তাই ওর দায়িত্ব হোমের হাতে তুলে দিলাম। ’ নিরুপায় মা এ-ও জানান, কেউ মেয়েকে দত্তক নিলে তাঁর আপত্তি নেই। ‘আমি কোনও দিন ওকে দাবি করব না। ’ প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

চিঠির শেষে মহিলা নিজের নাম লিখেছিলেন কমলা নাথ। চিঠিটি এখন প্রবাসী মেয়ের হাতে। গত বারো বছর ধরে যিনি জন্মদাত্রী মাকে খুঁজে চলেছেন। জুরিখের বিলাসবহুল জীবনের ফাঁকে যাঁর প্রতিনিয়ত মনে হয়, মা কি আজও কলকাতার অলি- গলিতে ভিক্ষে করে বেড়াচ্ছেন? না কি কোনও অন্ধকার ঘরের কোণে বসে শেষের প্রহর গুনছেন অসহায় বৃদ্ধা? মা আদৌ বেঁচে আছেন কি না, সে সংশয়ও উঁকি দিয়ে যায়। মেয়ে বলেন, “মাতৃত্বের ঋণ তো শোধ করার নয়! তবু যদি শেষ বয়সে ওঁকে একটু সুখ দিতে পারতাম...।

” ১৯৮১-তে সুইজারল্যান্ড থেকে কলকাতায় এসে মুরান্ডি দম্পতি দত্তক নিয়ে যান সোনাকে। কলকাতার ভিখারিণী মায়ের মেয়ের ঠাঁই হয়েছিল জুরিখের ধনী পরিবারে। তবে পালক মা কিছু দিন বাদে ঘর ছাড়ায় পালক বাবা সোনাকে পাঠিয়ে দেন বোর্ডিং স্কুলে। তা নিয়ে অবশ্য সোনার আক্ষেপ নেই। কারণ তিনি জানতেন, কলকাতার এক দরিদ্র মহিলার জঠরে তাঁর জন্ম, তিনি পিতৃ-পরিচয়হীন।

বুঝতেন, পালক মা-বাবাই তাঁকে তুলে স্বচ্ছল জীবনে এনে ফেলেছেন। কৃতজ্ঞ সোনা তাই এখনও যোগাযোগ রাখেন ওঁদের সঙ্গে। ইতিমধ্যে বিয়ে করেছেন। স্বামী যশোধরন মুথুলিঙ্গম শ্রীলঙ্কার ছেলে। ২০০১-এ ওঁদের প্রথম পুত্রের জন্ম।

জুরিখ থেকে ফোনে সোনা বলেন, “ছেলেকে কোলে নিয়ে বুঝেছিলাম, মাতৃত্বের স্বাদ কী! বুকের ভিতরটা হু হু করে উঠেছিল। মুথুকে বলেছিলাম, কোথায় আমার মা? আমি যে কষ্ট সহ্য করে ছেলের জন্ম দিলাম, তিনিও তো এমনই কষ্টে আমাকে পৃথিবীর আলো দেখিয়েছেন!’’ স্থির থাকতে পারেননি। দুধের ছেলেকে শ্রীলঙ্কায় ঠাকুমা-দাদুর কাছে রেখে পরের বছরই কলকাতায় চলে আসেন স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে। শুরু করেন মায়ের খোঁজ। যে হোম থেকে মুরান্ডি দম্পতি তাঁকে দত্তক নিয়ে গিয়েছিলেন, সেখানে যান।

কিন্তু হোম-কর্তৃপক্ষ কমলা নাথের খোঁজ দিতে পারেননি। ওখানে ওঁদের প্রাপ্তি বলতে মায়ের লেখা চিঠিটি, যার ইংরেজি অনুবাদ মেয়েকে পড়িয়ে শোনানো হয়। শুনে ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল তাঁর দু’চোখ। আর পেয়েছিলেন নিজের চার মাস বয়সের একটা সাদা- কালো ফোটোগ্রাফ। চার মাসের শিশুটি এখন পূর্ণ নারী।

নীচে, বত্রিশ বছর আগে জন্মদাত্রীর লেখা সেই চিঠির অংশ। ব্যাস। আর কোনও সূত্র মেলেনি। মায়ের ঠিকানা না-পাওয়ায় পুলিশেরও দ্বারস্থ হন সোনা। কাজ হয়নি।

কলকাতা পুলিশের তদনীন্তন গোয়েন্দা- প্রধান সৌমেন মিত্রের কথায়, “ঘটনাটা মনে পড়ছে। আমরা ওঁর মাকে খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। পাইনি। ” এগারো বছর আগে সেই যে ব্যর্থ হয়ে ফিরে গিয়েছেন, আর কলকাতায় পা দেননি। কেন? ফোনে সোনা বলেন, “এখন আমার তিন সন্তান।

নিজে স্কুলে পড়াই। কলকাতা যাওয়ার ফুরসৎ মিলছে না। কিন্তু মন পড়ে রয়েছে কলকাতায়। ” তিনি হাত গুটিয়েও বসে নেই। সোনার হয়ে তাঁর মায়ের খোঁজে আপাতত কলকাতায় রয়েছেন অঞ্জলি পওয়ার।

অঞ্জলি পুণের মেয়ে, শিশুদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেন। সঙ্গে আছেন জার্মানিবাসী অরুণ ডোল। সোনার মতো তাঁকেও পুণের অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়ে গিয়েছিলেন এক জার্মান দম্পতি। অরুণ সম্প্রতি পুণেতে গর্ভধারিণীকে খুঁজে পেয়েছেন। ইন্টারনেটে যখন সোনার সঙ্গে আলাপ, তখনও অরুণ মায়ের সন্ধান পাননি।

দু’দেশের দুই নর-নারীর চোখের জল এক হয়ে গিয়েছিল। অরুণও কাজকর্ম ফেলে সোনার মাকে খুঁজছেন। লোয়ার রডন স্ট্রিটের যে প্রতিষ্ঠান থেকে সোনাকে দত্তক নেওয়া হয়েছিল, সেই টেরেডাস হোম অবশ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এত দিন বাদে মাকে ফিরে পেলে কী বলবেন? আপনার ভাষাই তো উনি বুঝতে পারবেন না? মেয়ের জবাব, “বাংলা আমার মায়ের ভাষা! আমার রক্তে মিশে রয়েছে। শিখে নিতে স্রেফ ক’টা মাস লাগবে।

” হঠাৎ যেন উচ্ছ্বল হয়ে ওঠে তাঁর গলা, “জানেন, ইন্টারনেট ঘেঁটে আমের চাটনি রাঁধতে শিখেছি! স্বামীর সাহায্যে হিন্দু রীতি-নীতি, সংস্কার সম্পর্কে ধারণা করেছি। উৎসবের দিনে কখনও- সখনও শাড়ি পরি। মায়ের মতো হয়তো হয় না। ওঁকে কাছে এনে যখন রাখব, বলব, ভাল করে শাড়ি পরাটা শিখিয়ে দাও তো!” কিন্তু কোথায় ওঁর মা? কল্পনাকে ঠেলে সরিয়ে মুহূর্তে ঘুরে দাঁড়ায় বাস্তব। “খুঁজে দেবেন আমার মাকে? জীবনভর কৃতজ্ঞ থাকব আপনার কাছে।

” সাড়ে ন’হাজার কিলেমিটার দূর থেকে ভেসে আসে মেয়ের কান্নাভেজা আর্তি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.