আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এরপরের আরেকটা চ্যাপ্টার

মাথায় অনেক গল্প আসে; কিন্তু লেখার মত পর্যাপ্ত ধৈর্য-শ্রম-অধ্যবসায় নেই। গল্পগুলোকে তাই ছোট করে কবিতা বানাই...

৯. ঝুমু'র ঘুম ভাঙল চুয়েট ক্যাম্পাসে পৌঁছার পর। ঘুমের ভাণ করে থাকতে থাকতে ঝুমু একসময় সত্যি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিল। মাঝে নোয়াপাড়া 'পথের হাট'-এ ভাল একটা জ্যাম পড়ল। তাই বেশ এক ঘুম দিয়ে একদম তাজা হয়ে উঠল ঝুমু।

চোখ খুলে দেখে অনিম হাসিমুখে তাকিয়ে, - "ম্যাডাম, আপনার ঘুম ভাল হল?" একদম অপ্রস্তুত হয়ে ঝুমু আশেপাশে তাকাল, "কতক্ষণ হল এসে পৌঁছেছি?" - "তা ধরেন, ঘন্টাখানেক তো হবেই!" ঝুমু অনিমের কাঁধে চড় বসিয়ে বলল, "আচ্ছা! আর ট্যাক্সিওলা ঘন্টাখানেক আমার ঘুম ভাঙার অপেক্ষায় বসে ছিল, না?" - "রাজকন্যার ঘুম বলে কথা !", অনিম হাসতে লাগল, "এখন নাম, ট্যাক্সিতে বসেই গল্প করতে এসেছিস নাকি?" চুয়েট গেট দিয়ে ঢুকতেই ঝুমু বলে উঠল, "ওমা ! এত সবুজ আর এত শান্ত! আমার তো ছুটতে ইচ্ছা হচ্ছে !", হঠাৎ ছোটার সিদ্ধান্ত মুলতবি করে আঙুল তুলে একদিকে দেখিয়ে বলল, "ওটা কী?" অনিম তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, "ওটা শহীদ মিনার" - "শহীদ মিনার? এমন কেন?" - "ওটা এখনও শহীদ মিনার হয়নি গাধী! হবে, আরও ন'বছর লাগবে" - "নয় বছর!", ঝুমু'র চোখ কপালে উঠল, "বল কি! এতদিন কেন?" - "সম্রাট শাজাহান বানাচ্ছে তো, তাই...." - "উফ, তুমি সবসময় এভাবে কথা বল কেন?", ঝুমুকে যেন খানিকটা আহত মনে হল, "বল না সত্যি কাহিনীটা কী?" - "কাহিনী আর কিছু না, ওটা বানাতে সরকারের বাজেট নাকি এক কোটি দশ লাখ। এখন প্রতি বছর নাকি দশ লাখ টাকা করে গ্রান্ট হয়। সে হিসাবে এগার বছর লাগার কথা। এখন তো মোটে দু'বছর হল। " - "এবারও ঠাট্টা করছ, না?" ঝুমু'র চোখে সন্দেহ।

- "না, পত্রিকায় এমনটাই পড়লাম", একটু থেমে অনিম বলল, "আচ্ছা, তোর কি মনে হয়, আমি সবসময় ঠাট্টা করি?" - "মনে হবে কেন? তুমি তো আসলেই সবসময় ঠাট্টা কর" দু'জনেই কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর ঝুমু বলে উঠল, "পত্রিকায় যেটা পড়েছ বললে, সে কারণটা যদি সত্যি হয়, তাহলে এর চেয়ে হাস্যকর কারণ আর কিছু হতে পারে বলে আমার মনে হচ্ছে না!" দু'জনই শব্দ করে হাসল বেশ কিছুক্ষণ। অনিম হঠাৎ সরাসরি ঝুমু'র দিকে তাকিয়ে বলল, "আচ্ছা ঝুমু, আমি যদি তোকে কখনও সিরিয়াস কিছু বলি, তোর কি সেটাও ঠাট্টা মনে হবে?" ঝুমু মুখ নিচু করে খুব আস্তে আস্তে বলল, "তুমি আবার সিরিয়াস কী বলবে? তুমি সিরিয়াসলি কিছু ভাবতে পারো?" - "ও", অনিম আর কিছু বলল না। কিন্তু এই নীরবতা ঝুমু'র অসহ্য লাগল, - "কই, বললে না?" - "কী?" - "তোমার সিরিয়াস কথা?" - "না", অনিম দূরে তাকাল, "আমার আবার সিরিয়াস কথা কী?" ঝুমু'র হঠাৎ খুব কান্না চলে আসল। আজ কেন জানি কথায় কথায় তার চোখ ভিজে যাচ্ছে। শুধু আজকের দিনটায় কি অনিম তার সাথে ভালভাবে কথা বলতে পারত না? ঝুমু চুপ করে থাকল কিছুক্ষণ।

এখন কিছু বলতে গেলেই গলা কাঁপবে। তাই একটু সময় নিয়ে বলল, - "রাগ করলে?" অনিম হঠাৎ যেন আকাশ থেকে পড়ল! যেন এতক্ষণের কোন কথাই তার খেয়াল নেই, - "রাগ করব? রাগ করব কেন বল তো? কি করেছিস তুই?" ঝুমু আর অনেকক্ষণ অনিমের দিকে তাকাতে পারবে না। অনিমকে কিছুতেই তার ভেজা চোখ দেখতে দেয়া যাবে না! দু'জনের দু'টি মন দু'টি ভিন্ন পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূর চলে যাচ্ছে। শুধু দু'জনের কেউ জানে না অন্যজনের পথের খবর। ঝুমু শুধু জানে, অনিমকে কিছুতেই তার ভেজা চোখ দেখতে দেয়া যাবে না! ******************************************************************** চুয়েটে গোল-চত্ত্বর থেকে টিচার্স কোয়ার্টার পর্যন্ত যে লম্বা রাস্তাটা গিয়েছে, অনিম তার নাম দিয়েছে 'রানওয়ে'।

রাস্তাটা পুরোপুরি স্ট্রেট লাইন, আর তার উপর দিয়ে যখন চুয়েট বাসগুলি স্পীড বাড়াতে বাড়াতে আসে, তখন মনে হয় 'রানওয়ে'টা পার হয়েই উড়াল দিবে! এই 'রানওয়ে'র মাঝেই একটা জায়গা অনিমের খুব প্রিয়। সেখান থেকে দূরে দিগন্তের কাছাকাছি পাহাড়চূড়া আর আকাশকে এক হতে দেখা যায়। শেষ বিকেলের সোনাঝরা আলোয় সে এক দৃশ্য! ঝুমুকে নিয়ে সেদিকটায় যাচ্ছিল অনিম। পথে হঠাৎ সিভিলের আরিফের সাথে দেখা। এ সময় আরিফ হল-এ? অনিম ডাক দিতেই আরিফ ছুটে এল, খুব ব্যস্ত মনে হল তাকে।

- "কি রে আরিফ, এই সময় হল-এ? বাড়ি যাস নি?" - "না রে দোস্তো, তিনটা ব্যাকলগ আছে! এই শর্ট-টার্মে ক্লিয়ার করতে হবে!" - "ও, গুড লাক। তা দৌড়ে কই যাস?" - "শাহ হল। এক বড় ভাইয়ের রুমে 'চোথা' আনতে। যাইরে দোস্তো, ভাই আবার বাইরে যাবে..." - "ওকে দোস্ত" যাওয়ার আগে আরিফ হঠাৎ ঝুমুকে দেখে থামল, অনিমের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, "দোস্তো কে রে? ভাবী নাকি?" যত আস্তেই বলুক, ঝুমু'র কান এড়াল না। লজ্জায় সে মুখ নিচু করে মাটির সাথে মিশে যেতে চাইল।

তার মনে হচ্ছে তার বুকের ঢিবঢিব আওয়াজ সবাই শুনতে পাচ্ছে! কি লজ্জার ব্যাপার ! জাস্ট এক সেকেন্ডের ব্যাপার। ঝুমু'র ষোল বছরের জীবনে মনে রাখার মত একটা সেকেন্ড! সারাটা জীবন মনে রাখার মত একটা সেকেন্ড। তার পরেই তার হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে গেল। অনিম নির্লিপ্ত গলায় বলছে, "কে? এই পিচ্চি? শালা, এটা আমার ছোট বোন!" ঝুমু'র দিকে তাকিয়ে আরিফ স্যরি বলেছে, সেটা ঝুমু'র কানে গেল না। আরিফ যেভাবে দৌড়ে এসেছিল, সেভাবে ছুটে পালাল, সেটাও ঝুমু'র চোখে পড়ল না।

তার চোখ জ্বলছে। মাথাটা খুব ঘুরছে। গত তিনদিন ধরে ঝুমু'র জ্বর, সেটা আবার বাড়ছে বোধহয়। ঝুমু'র মনে হচ্ছে সে ব্যালেন্স রেখে একটা পা-ও ফেলতে পারবে না এখন। অনিম তাকে দু'বার ডাকল, সেটা পর্যন্ত সে শুনল না।

তার কানে শুধু একটা কথাই বাজছে, "এটা আমার ছোট বোন"। চারপাশে যেন অসংখ্য দেয়ালে কথাটা প্রতিধ্বনিত হচ্ছে! অনিম হঠাৎ তার দু'বাহু ধরে ঝাঁকি দিল, "এই ঝুমু, কী হয়েছে তোর?" এর আগে অনিমের স্পর্শ পেলেই তার চোখ ভিজে আসত। এখন অনিমের দু'হাতের মাঝে থেকেও ঝুমু পুরো শুকনো চোখে তাকিয়ে বলল, - "আমি বাসায় যাব" ******************************************************************** ফেরার পথে ট্যাক্সিতে ঝুমু একটা কথাও বলল না। অনেক প্রশ্ন করেও কোনও জবাব না পেয়ে অনিমও চুপ হয়ে গেল। শেষটায় ঝুমু'র চোখের দিকে তাকিয়ে অনিম আঁতকে উঠল! এত লাল! কপালে হাত দিয়ে দেখে বেশ জ্বর! খুব বেশিই! হু হু করে হাওয়া ঢুকছে।

অনিম বুঝতে পারছেনা কি করবে। - "ঝুমু, খুব বেশি খারাপ লাগছে?" ঝুমু নিশ্চুপ। - "খুব খারাপ লাগলে আমার কাঁধে মাথা রাখ?" এতে ঠিক কী লাভ হবে বোঝা গেল না, তবে ঝুমু বাধ্য বালিকার মত কথা শুনল। অনিম আর কী বলবে খুঁজে পেল না। নীরবতাটা খুব বেশি অস্বস্তিকর ঠেকছে।

হঠাৎ তার খেয়াল হল, সারাটা দিন একসাথে তবু একবারও বলা হয়নি! অনিম ঝুমু'র কপাল থেকে চুল সরিয়ে বলল, "হ্যাপি বার্থডে টু ইউ, পাগলী" ঝুমু ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল। ******************************************************************** সেদিন সন্ধ্যায় ঝুমু'র জ্বর খুব বাড়ল। গত তিনদিন ধরে জ্বর, তবে এত বেশি ছিল না। রাতের খাবার না খেয়েই ঝুমু শুয়ে পড়ল। কারও কথা না শুনে শোবার আগে খালি পেটেই দু'টা প্যারাসিটামল খেল।

রাত দেড়টা-দু'টার দিকে টগরের ঘুম ভেঙে গেল। হালকা সুরে কোথায় যেন গান বাজছে। কিছুক্ষণ সময় লাগল তার বুঝতে। Cranberries-এর গান, "Dying in the sun". অনিম ভাইয়ের খুব প্রিয় গান। ভাইয়া বলে, এটা রাতের গান।

দিনের বেলা শুনলে তেমন ভাল লাগে না অনেকসময়, কিন্তু রাতের অন্ধকারে শুনলে সেইরকম 'ফিল' আসে। টগর হঠাৎ খেয়াল করল, গানে কোনও মিউজিক নেই, শুধু কন্ঠ শোনা যাচ্ছে। ব্যাপারটা কী? মাথা তুলে দেখল, ঝুমু আপু বারান্দায়। চাঁদের আলোয় বসে। তার না জ্বর? টগর হঠাৎ বুঝতে পারল, গানটা সিডি-প্লেয়ারে বাজছে না।

ঝুমু আপু গাইছে! আশ্চর্য, অবিকল আসল গায়িকার মত ভয়েস! নাকি তার চেয়েও ভাল! টগর অবাক হয়ে একটা অপার্থিব দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে রইল... বারান্দাটা চাঁদের আলোয় মাখামাখি। গতকাল পূর্ণিমা ছিল। আজও চাঁদের রোদে পুরো শহরটা ভিজে যাচ্ছে। রূপালী আলো'র কি অসহ্য মায়া! কনকনে শীতে ঝুমু কেঁপে কেঁপে উঠছে, কিন্তু তার গলা কাঁপছে না। তার অদ্ভূত কন্ঠস্বর ছড়িয়ে যাচ্ছে দূর থেকে আরও দূরে --- "Will you hold on to me I am feeling frail Will you hold on to me We will never fail I wanted to be so perfect, you see I wanted to be so perfect......."


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।