আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপলাল হাউসের একদিন

এখন সবাই ঘুরে বেড়ায় , এটা ভালো...

১৮৮৮সাল। ভারতের ভাইস লর্ড ডাফরিন ঢাকা সফরে এসেছেন। সরকারী সফর , ইংরেজ রাজত্ব। ইংরেজরা লর্ড ডাফরিনের সৌজন্যে বল নাচের আয়োজন করতে চাইলেন। সে জন্য তাদের দরকার সুদৃশ্য ভবন।

তবে শুধু ভবন সুদৃশ্য হলেই হবেনা। সে ভবনের ব্যাবস্থা , সুবিধা ও ভালো হতে হবে। সে রকম সুবিধা সম্পন্ন ভবন হিসাবে তিনটি বাড়ি নির্বাচিত হলো। আহসান মঞ্জিল , এখনকার বঙ্গভবন , আর রুপলাল হাউস। শেষ পর্যন্ত নান্দনিকতা আর আধুনিকতায় রুপলাল হাউস সবাইকে পেছনে ফেললো।

আমাদের এবারের গন্তব্য আদি ঢাকার সেই রুপলাল হাউস। দুই: গত পঁচিশ ডিসেম্বর আমার জন্মদিন ছিল। সে দিন আমরা নাটোর কাটিয়েছি। ঘুরে দেখেছি নাটোর রাজবাড়ি ,দিঘা পাতিয়ায় উত্তরা গন ভবন , পুঠিয়া রাজবাড়ি সহ অনেক ইতিহাস আর ঐতিহ্য সম্বৃদ্ধ এলাকা। সে সব দেখতে দেখতেই আমার মনে হলো বাড়ির কাছে রুপলাল হাউসে একবার ঘুরে আসিনা কেন! রূপলাল হাউসে আমি বহুবার গেলেও এই সময় আর যাওয়া হয়নি।

প্রতœতত্ব আধিদপ্তরের অধীন এই বাড়িটির বর্তমান অবস্থা দেখতে তাই বছরের শেষ দিনটাই বেছে নিলাম। বুড়িগঙ্গা পারের শ্যাম বাজারে রূপলাল হাউসের অবস্থান। এক সময় যান জটের জন্য পুরান ঢাকার খুব সমালোচনা হত। অনেকে পুরান ঢাকা যাবার নাম শুনলে দশবার ভাবতো। ঢাকা শহরের ভীড়-ভাট্টা ঠেলে সেখানে গিয়ে আরও বেশী ভীড়-ভাট্টাকে আলিঙ্গন করতে হবে ভেবে অনেকে সেখানে যেতেই চাইতোনা।

এখন অবস্থা পাল্টেছে। পুরো ঢাকা মহানগরই যান-জটের আখরা। সুতরাং সে সব পেছনে ফেলে পুরান ঢাকার অলিগলি খারাপ লাগবেনা। বরং ভালো লাগার পরশ ছুঁইয়েদেবে। আমি থাকি পুরান ঢাকার কলতাবাজারে।

নিজের বাড়ি , আসলে বাড়ি বলতে ওই এক কাঠা জমির ওপর পাঁচতলা আর বারোটা খুঁপড়িতে আলোহীন , বাতাস ছাড়া উদ্বিগ্নময় জীবন যাপন। সে বাড়ি থেকে বের হলে প্রথমেই কবি নজরুল কলেজ। তারপাশে রয়েছে ঢাকায় বেঁচে থাকা পানির ট্যাংক গুলোর একটি। এখান থেকে আর একটু সামনে বাহাদুরশাহ পার্ক , এক সময়ের ভিক্টোরিয়াপার্ক। এখানে স্কুল কলেজ অনেক।

আসলে সে সময় শহর বলতে এই ঢাকাকেই বোঝাতো। বাকিতো জঙ্গলে ভরা ছিল। এখানকার মুসলিম সরকারী উচ্চ বিদ্যালয় , কলেজিয়েট উচ্চ বিদ্যালয় প্রতিযোগিতায় পেছনে পড়লেও কালের সাী হয়ে এখনও দাঁড়িয়ে। আমরা মুসলিম উচ্চ বিদ্যালয় পেছনে ফেলে বাংলাবাজারের ভেতর দিয়ে শ্যামবাজার চলে আসি। আমাদের সামনে এখন বিখ্যাত লালকুঠি।

তার পর পরই ১৯০৮ সালে স্থাপিত ঢাকা অনাথ আশ্রমের অবস্থান , এরপর সেই বিখ্যাত রূপলাল হাউস। তিন: ছেলেবেলায় বাবার হাত ধরে প্রথম রূপলাল হাউসের সাথে পরিচয়। প্রায়ই বাবার সাথে সেখানে বেড়াতে যেতাম। তখন এর অবস্থা আরও ভালো ছিল। বুড়িগঙ্গার তীরে কী সুন্দর বাড়ি! এর পর বড় হয়ে একা একা গিয়েছি বহুবার।

একবার ঢাকাহেরিটেজ সংগঠনের বন্ধুদের নিয়ে গিয়েছিলাম। আজ আবার আমরা এসেছি , আমি আর শুভমিতা। ঘুরে বেড়ানো আমাদের নেশার মত , কত যায়গাতেই ঘুরে বেড়াই। কখনও প্রকৃতির টানে ছুটি আবার কখনও বা ছুটি ইতিহাস-ঐতিহ্যের টানে। মক্কার মানুষ হজ্ব পায়না , ঠিক এই প্রবাদটির মতই আমাদের এই ঢাকাতেই দৃষ্টিকারা বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা যা আমরা অনেকেই খুঁজে দেখিনা! কিছুদিন আগে ঈশ্বরদি গিয়ে কয়লা চালিত বাষ্পিয় ইঞ্জিন দেখবোই এমন পন করে বসলো শুভমিতা , অথচ ঢাকার রেলওয়ে ভবনের কাছের তেমন একটি ইঞ্জিন চলতি পথে দেখা ছাড়া সে কখনও সামনে গিয়ে দেখেনি।

তেমনি বাড়ির কাছের এই প্রাচীন আর বিখ্যাত স্থাপনা রূপলাল হাউসও তার অদেখা। আর আমি বছর চারেক আগে শেষবার এই রূপলাল হাউসে এসেছিলাম। আজ এখানে দাঁড়িয়ে আমি অনেকটা স্মৃতিকাতর হই। বাবার কথা মনে পরে! রুপলাল হাউস এখন প্রায় চারশ দোকানে ঘেরা। ছুটির দিন বলে হই-হট্টগোল , চিৎকার চেঁচামেচি কম।

মানুষের ছোটাছুটিও নেই তেমন একটা। আমরা ধীর পায়ে ভঙ্গুর প্রায় রুপলাল হাউসের ভেতর প্রবেশ করি। এমন বিশাল আর চমৎকার বাড়িটিতে এলে একসময় হয়তো চু চড়কগাছ হবার যোগাঢ় হত , আজ হয়না। আজ বুকের ভেতর কষ্টরা লাফা-লাফি করে টের পাই! প্রতœতত্ব বিভাগের সাইনবোর্ডটি এখন আর রূপলাল হাউসের প্রবেশ মুখে নেই , এর রনাবেনের দায়িত্বে কে আছে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেলনা মুল ফটকে। আমরা বাইরের অংশ ঘুরে দেখে দোতলার সিড়িতে পা রাখি।

বাড়িটিতে মানুষের বসবাস দেখে শুভমিতা বেশ অবাক হয়! এমন একটি সংরতি বাড়িতে কী করে বসবাসের অনুমতি মিলে! পরে এখানে বসবাস করা বাসিন্দাদের কাছ থেকে জানা গেল এখানে পোস্তগোলার সেনাছাউনির সিপাহীদের বসবাস , এর বাইরে এখানকার বাসিন্দারা আর কিছুই বললোনা! চার: মথুরা নাথ দাস বুড়িগঙ্গার ওপারের শুভাড্যার বাসিন্দা। তখন সে অঞ্চলের সাহা বর্নের হিন্দুদের প্রধান জীবিকা ব্যবসা হলেও মথুরা নাথের অবস্থা ভালো ছিলনা। দিন বদলের আশায় তিনি ঢাকা আসেন এবং পোদ্দারি ব্যবসা শুরু করেন। প্রতিদিন তিনি শুভাড্যা থেকে ঢাকা আসতেন এবং চট বিছিেিয় বাংলাবাজার এলাকায় মানুষের টাকা ভাঙ্গিয়ে দেয়ার ব্যবসা করতেন। অবস্থা ক্রমে উন্নতি হতে থাকলে তিনি বাংলাবাজারে জমি কিনে গদিঘর নির্মাণ করে হুন্ডির কারবার শুরু করেন।

কিছুদিনের মধ্যে তার ব্যবসা ফুলে ফেপে উঠলে তিনি ফরাশগঞ্জে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। সবজি মহল হিসাবে খ্যাত সে বাড়িটি এখনও রয়েছে। মথুরা নাথের ছোট ছেলে স্বরুপ দাস। তার তিন ছেলে রুপলালদাস , মোহিনীদাস আর রঘুদাস। তারা নিজেদেরকে সমাজে জমিদার হিসাবে পরিচিত করেন।

জমিদার রূপলালদাস স্বরূপদাসের দ্বীতিয় ছেলে। তিনি পাশ্চাত্য শিায় শিতি ছিলেন। বই পড়তে ভালোবাসতেন , তিনি সংস্কার মুক্ত একজন মানুষ এবং তার কোন রতিা ছিলনা। সম্পত্তির ভাগ বাটোয়ারার পর তিনি তার ভাই রঘুনাথসহ শ্যাম বাজার চলে আসেন। সেখানে তিনি যে বাড়িতে বসবাস শুরু করেন তা দিনে দিনে রূপবাবুর বাড়ি বা রূপলাল হাউস হিসাবে খ্যাতি লাভ করে।

রূপলাল হাউসের মুল মালিক ছিলেন আর্মেনিয়ান জমিদার আরাতুন। ঢাকা নর্মাল স্কুলের অধ্য ছিলেন তিনি। তার পছন্দের বিষয় ছিল -ঘুড়ি ওড়ানো , কবুতর ওড়ানো , আর মোরগ লড়াই। তার মৃত্যুর পর জমিদারির উত্তরাধীকারি হন , তাঁর দুই কন্যা। তারা জমিদারি বিক্রি করে কলকাতা চলে গেলে বাড়িটি ক্রয় করেন রূপলাল দাস।

১৮৪০ সালে তিনি বাড়িটি কিনে কলকাতার মার্টিন এন্ড কোং এর স্থপতিকে দিয়ে পুর্ননিমার্ণ করান। বিশাল রূপলাল ভবনের দৈর্ঘ্য ৩০০ফুট। ব্লকের সমস্ত দৈর্ঘ্য জুড়ে উত্তর ও দনি দিকে দুটি প্রশস্ত বারান্দা আছে। ইংরেজী ঊ নকশার বাড়িটির বর্ধিত তিনটি বাহুই শহরমূখি। মাঝখানের বাহুর দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ফুট।

বাড়িটি গ্রীক স্থাপত্য শৈলীর অনুকরনে নির্মিত বিশাল ডরিক কলাম-এ। অথচ এমন সুন্দর বাড়িটি এখন কেবল ভেঙ্গে পড়ার অপোয়। অবশ্য বাড়িটি একবার ১৮৯৭ সালের ভুমিকম্পে এবং আরেকবার ১৯৬৫ সালে বজ্রপাতে তি গ্রস্ত হয়। ৫০টির বেশী কবিশ্ষ্টি এই বিশাল বাড়িটির সবচাইতে আকর্ষনীয় ক হচ্ছে এর নাচ ঘর। আর এই নাচঘরটির জন্যই লর্ড ডাফরিন ঢাকা এলে ইংরেজরা রূপলাল হাউসকে বেছে নেন।

ভাড়া বাবদ দুই দিনের জন্য ২০০ টাকা দিলেও বাড়িটি বল নাচের উপযোগি করে সাজাতে রূপবাবু সে সময় ৪৫০০০ টাকা খরচ করেছিলেন বলে জানা যায়! বিশ শতকের প্রথম দিকে রুপলাল হাউস তার সৌন্দর্য্য হারায়। ১৯৪৭ সালের পর বাড়িটির উত্তরাধীকারিরা কলকাতায় চলে গেলে তা সরকারী সম্পত্তিতে পরিনত হয়। এর পরের ইতিহাস দখলদারের! বর্তমানে বাড়িটি প্রতœতত্ব বিভাগের সংরতি বাড়ির তালিকায় থাকলেও বাড়িটি ঘিরে আছে মসলার আড়ৎ। সাথে পোস্তগোলার সেনাছাউনির সিপাহীদের দখল দারিত্ব। আমাদের দেশ বলেই এসব সম্ভব! এমন চমৎকার ভবনটির সংরনের কোন ব্যবস্তা নাই দেখে অবাক হবেন যে কেউ।

পত্রিকায় কত লেখা পড়লাম , কই কিছুইতো হলোনা! বাড়িটির ভেতর বাহির সর্বত্র ধ্বংসের ছবি। এ বাড়ির বাসিন্দা ছোট্ট সুমন আমাদের ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সে সব দেখায়। সুমনের যায়গায় অন্য কেউ হলে এসব আমাদের অগোচরে থেকে যেত , দেখা সম্ভব হতোনা! আমরা খুব কসরত করে ভাঙ্গা কাঠের সিড়ি বেয়ে রূপলাল হাউসের ছাদে যাই। এখানে এলে মনে হবে ইচ্ছা করে ধ্বংস-যজ্ঞ চালানো হয়েছে। ভাঙ্গা ইটের স্তুপ , পাশাপাশি ১৯৬৫র বজ্রপাতে ধ্বংস চি‏হ্ণ! তবে এখান থেকে কাছের বুড়িগঙ্গা মনোরম।

মাত্র কয়েক হাত দুরুত্বের বুড়িগঙ্গাকে আরও ভালো লাগছিল কুয়াশার ঝাঁপসা জগতের জন্য। কী এক মাতাল করা পরিবেশ! সেখান থেকে চোখ মেলে তাকাই আবার রূপলাল হাউসে , তারপর আবার কসরত , আবার এ ঘর ও ঘর করে যেখানে আসি , সেটা এ বাড়ির নাচ ঘর। এখানে কাঠের তৈরী মেঝেতে পা দিতেই আমার কানে বেজে ওঠে রিনিঝিনি কাকণের ছন্দ। মনে লাগে দোলা , সাথে গানের সুর - বাজু বন্দ খুলে খুলে যায় সাবারিয়ানে যাদু ডারে বিশাল নাচ ঘরের ছাদ চমৎকার নকশা করা। সে ছাদে নানা বর্নের কাচের টালি যেন রোদ পড়লেই ঝলমল করে উঠবে।

আমি এখানে পা রাখার আগে কখনও কোন রংমহল দেখিনি। রূপলাল বাবু এখানে বসে নৃত্যের তালে হারাতেন। কল্পনায় আমিও নর্তকীর নৃত্যে হারালাম!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.