আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পদ্মপাতায় শিশির কালিঃকবিতা বিষয়ে আমার নোট



পদ্মপাতায় শিশির কালিঃকবিতা বিষয়ে আমার নোট দুলার সঙ্গে এখন আর বৈরাতি যায় না। বৈরাতি কাল দুলহান সময় নাই। বড়ো তাড়া। সব কিছু এতো সংক্ষেপিত যে কথা এখন সিগন্যাল। কথার কর্তাকে কথা দিয়া বোঝার উপায় নাই।

আমি অনেক পয়-পরিষ্কার, ধোপ-দুরস্ত মানুষ দেখেছি, যারা অন্ত্রে প্যাঁচ ও অন্তরে বিষ লইয়া মুখে মিষ্ট কথার মিছরির ছুরি। ভাব, অভিজ্ঞতা ও ভাষার সংমিশ্রণে সাহিত্য তৈরি হয়। আমি যেভাবে সাহিত্য বুঝি তা’ আবার একটু অন্য কিসিমের। সাহিত্য, ইতিহাস ও নৃতত্ত্ব কোন আলাদা জিনিস না। তবে কোন ভাবে কোন বচন, কোন রূপে প্রকাশ-সেই সব গূঢ় ও গুরুচন্ডালি বিষয় দূরে থাক, আমি এখন শুধু কবিতার জন্ম নিয়া খানিকাটা খোঁড়াখুড়িঁ করে দেখি যদি কিছু পেয়ে যাই।

সাত রাজার ধন, নাগিনীর পাতাল। কবিতা ছন্দে ইতিহাস সংবদ্ধ করে, জমিয়ে রাখা যায়। স্মৃতির লালন-পালনের মধ্য দিয়ে মানুষের সামাজিক, প্রাকৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস আগায়। সামাজিক ইতিহাস যতো আগে বাড়ে, রাজনৈতিক ইতিহাস ততো সামাজিক হয়ে উঠে। কবিতা মানুষের লিরিক্যাল হিস্টরি, ইতিহাস যারে কই, সাদামাটা কথায়।

পৃথিবীর সকল ভৌত অবকাঠামোর মতই ভাষার সবচে’ নান্দনিক ভৌত অভিপ্রকাশ ঘটে কাব্যে। কাব্য কিছু ভুলতে দেয় না। স্মৃতিসত্তার জীবন্ত ও সবল, সপ্রাণ ও সরল কাঠামোগত, লিরিক্যাল স্ট্রাকচারের মধ্যে, পদ ও পদকর্তার সম্পর্কের সবচে’ উৎকৃষ্ট অভিব্যক্তি কাব্য। লিরিক কেবলমাত্র কবিতার বৈশিষ্ট্য নয়, গানের, নৃত্যের, শ্রমিকতার, এমনকি সশস্ত্রতার। আদি লিরিকের নোটেশন করা কবির কাজ, বিজ্ঞানীর নয়।

কবি রাজহংসের মত। দুধ থেকে জল আলাদা করে আত্মস্থ করেন। কবি এস্কিমোদের বরফের ঘরের মত। শীতল, সাধারণ, হতশ্রী শব্দকে উত্তাপ দিয়ে দিয়ে গণমানুষকে অই শব্দের নয়া ভাবে নাড়াতে পারেন। অতএব, প্রতিনিয়ত কবি ও কবিতা শব্দের চলনসই, চালু মানে আর প্রথাগত অর্থ ওলট-পালোট করে অসংখ্য সঞ্চরণশীল শব্দের কিলবিল থেকে মানুষের ‘হৃদয়কে’ মুক্তি দেন এবং শব্দের মাথায় অর্থের নোতন তাজ পরান।

এই অর্থে কবিতা হয়ে ওঠে তখনই যখনঃ । । আলাদা একটা পদ সেটা করতে পারে না। শব্দের আলাদা আলাদা মানে অভিধানের বিষয়, কবিতার নয়। সকল পদ মিলে যখন একসঙ্গে কথা কয়ে ওঠে।

প্রতিটি পদের অর্থ রূপান্তর যখন সকল পদের উপর নির্ভর করে তখন কবিতার প্রাথমিক শর্ত তৈয়ার হয়। বাংলার কবিতা সবসময়ই এ্যান্টি-র্যা শনাল ছিল। এটাই বাংলা কবিতার অসম্ভব শক্তি। । তবে এখন এটা বলা দরকার কাব্য সবসময়ই জ্যোতির-জেল্লা।

জাদু, ঝিকিমিকি। সৎ ও সত্যিকারের কবি সব জানেন। তিনি ইঙ্গিতে, ইশারায় ভাব ও বস্তুর সম্পর্ক ও ফারাক বোঝেন ও বুঝিয়ে দেন। কবিতা ছাড়া পদার্থ বিজ্ঞান আগাতে পারে না, আগাবেও না। পদার্থ বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা হচ্ছে কবিতার ইংগিত যে প্রাকৃতিক নিয়মের সবচে’ নির্ভরযোগ্য সম্ভাব্য ব্যাখ্যা, সেটি মানার ক্ষেত্রে গড়িমসি, কৃপণতা ও আসলে বিজ্ঞান হিসাবে অক্ষমতা।

প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের সকল বিজ্ঞানীরাই এখনো পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ছাত্র। যা জানি তা জানার শুরু মাত্র। যার ভেতর দিয়ে প্রকৃতি নিজেকে সবচে’ বেশী প্রকাশ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে তার নাম কবি মানুষ। অতএব , কবি তৈরি করা যায় না,কবি হয়ে ওঠে। কেউ কেউ ভুলে এই বয়ানকে আধ্যাত্মিকতার সাথে তুলনা করলে ভুল করবেন দুইবার।

কবি লালনবাদী,ফকির-দরবেশ নয়। । । যখন কবি হয়ে উঠছেন মাত্র, লক্ষণ পরিষ্কার, তখন নিজেকে পাগল পাগল লাগে। পদ্ম পাতায় শিশির কালি দিয়ে লিখবার খায়েস হয়।

সবকিছু আউলা-ঝাউলা লাগে। কবি কাব্যের শৈশবে তার নিজের কর্তাগিরি হারায়। তাকে যেন চালিত করছে অন্য কেউ। সে-ই অন্য কেউ কোন ঈশ্বরিক শক্তি নয়, স্বর্গ ও দোজখের অধিকর্তা নয়, একটা অগ্নিকুন্ড। সেটা জরথুস্ত্রায়ান প্রাকৃতিক অগ্ন্রির ধর্মতাত্ত্বিক শিখা নয়, আরতির আরাধ্য জাগতিক শিখা নয়, মাজারের মোমবাতি নয়- সেঁজুতিও নয়- অনির্বচনীয় শিখা- দীপ্তিময় দিপালী- আমার সবকিছু দেখার সহজিয়া লালন মনশ্চক্ষু।

মানস-নয়ন। । কবির উপর সবকিছুই নাজেল হয়, আবার কোনকিছু না। নাজেলের একটা ধর্মতাত্বিক মানে খাড়া করা যায়। অভিভূত হওয়ার জন্য কিছু আবির্ভূত হতে হয়।

আবার সমাজ টিকিয়ে রাখার জন্য কিছু কিছু জিনিস গায়েবি রাখতে হয়। বাতেনি ও গায়েবের এই রুপালি রূপান্তর (ম্যাটামোরফিসিস) কবির জন্য এক জব্বর মূহুর্ত এনে দেয়। কবি বলে ওঠেন, মদের গ্লাসে ছলকে উঠে কাদম্বরি। একজন কম্যুনিস্ট কবি বলেন, গণতন্ত্র সিফিলিস। এই প্রসংগে একটি কথা মনে পড়ে গেলো।

। । আমার দাদা ডাক্তার ছিলেন। সিফিলিসের রোগিদের জন্য তিনি কী একটা ঔষধ যেন কাকে চিঠি লিখতেন, ডাকে এসে যেতো। সে-ই অষুধের ক্যামিক্যাল কম্পোজিশন জানি না।

তবে এটা মলম কিংবা মোরব্বা জাতীয় কিছু। আমার প্রসংগ এটা না। সিফিলিস যখন সামরিক কায়দায় ব্যবহার করা হয়েছিলো, কবি তখন নীরব ছিলেন না। প্রথম বায়োলোজিক্যাল ওয়্যার। কী বদমায়েশি।

মানুষ তার খোদ্গুণে কিছু নয়, প্রান মাত্র। বাকী সব গুণ মানুষ হয়ে উঠার আত্মস্থকরণ প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে অর্জিত হয়। কিন্ত মানুষের মধ্যে নিহিত প্রাকৃতিক গুণ এমনই যে আত্মস্থকরণ কেবল তার পক্ষেই সম্ভব। কাব্য সেই প্রাকৃতিক নিহিত সম্ভাবনা যা মানুষের লিরিক্যাল নিসর্গ দশা। এই ‘দশা’ থেকে ভাবে উৎক্রমণ হবে ক’জনার মধ্যে তা কিন্তু প্রাকৃতিক নির্বাচন, এক অর্থে।

কবিতারই কেবল বাণী বিকাশ ও পুনরুৎপাদনের ক্ষমতা আছে। তা-ই কবিকে শাসক শ্রেনী ভয় পায়। কবিকে দিয়ে রাজনামা, রাজস্ততি লেখাতে পারলে জনমানসে দীর্ঘজীবি হওয়া যায়। কাব্য স্মৃতির স্বরলিপি।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।