বাংলা ব্লগে লেখার অগ্রহ অনেক দিনের, তাই লিখছি ।
ডুবসাঁতার
একটি ডিজিটাল মুভি
পরিচালনাঃ নুরুল আলম আতিক
ইমরান দাবা খেলা শেষে তুমুল বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে যায়। অথবা অমোঘ নিয়তি সেই রাত্তিরে তাকে বাইরে ডেকে নেয়। ঠিক ওই মুহূর্তে ভাতচোর এসে উঁকি দেয় জানালায়। টের পেয়ে চেঁচামেচি জুড়ে দেয় রেণুর ছোট ভাই রেহান।
তারপর হুড়োহুড়ি, হইহল্লা। মহা উৎসাহে চোর ঠ্যাঙানোর কাজে নেমে পড়ে পাড়াত ইভ টিজার কিংবা পাতি মাস্তানের পাল। ঠিক এইখানটায় এসে, এতক্ষণ রেণু নামের মেয়েটার নিত্যদিনকার টানাপোড়েন আর অযাচিত মাতৃত্বের সংকট পেটে নিয়ে এগোচ্ছিল যে ছায়াছবি, সেটা অকস্মাৎ অভাবনীয় এক মোচড় খায়। ওস্তাদ সাঁতারু যেভাবে সাঁতার-পুকুরের শেষ মাথায় গিয়ে জলের মধ্যে ডিগবাজি খেয়ে পরবর্তী চক্করের জন্য তৈরি হয়, ডুবসাঁতারও ঠিক সেই ভাবে জেগে ওঠে। হতবিহ্বল দর্শককুল আচম্বিতে আবিষ্কার করে, এতক্ষণ তারা যাকে স্রেফ নেশাখোর উচ্ছনে যাওয়া ‘ধনীর দুলাল’ বলে ভাবছিল, সেই তরুণের জন্য তাদের হূদয়ে রক্তক্ষরণ! নির্মাতার শক্তিমত্তা সম্ভবত একেই বলে।
শুরুটা অবশ্য কেমন যেন ঢিমেতালে। সেই চিরচেনা নিম্ন-মধ্যবিত্ত জীবনের টানাপোড়েন, দু-চার টাকার জন্য খ্যাচখ্যাচ, মায়ের সেলাই মেশিন চালনা, মা কর্তৃক জোয়ান ছেলেকে চপেটাঘাত, আলু-রুটি ভাজির নিত্য প্যানপ্যানানি—সবকিছু বড্ড ক্লিশে লাগে। জোড়া ইলিশ, চতুর্থ মাত্রা কিংবা সাইকেলের ডানার যে নুরুল আলম আতিককে আমরা চিনি, তার হদিস পাওয়া দায় হয়ে দাঁড়ায় ছবির বিপুল অংশ পেরিয়ে যাওয়ার পরও।
ডুবসাঁতার-এর কাহিনি আদতে তরুণী রেণুকে (জয়া আহসান) ঘিরে। রেণু ছোটখাটো কোনো একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মী।
তার আয়ে চলে পুরো সংসার—দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বড় ভাই রোকন (অশোক বেপারি), বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া রেহান (শাহরিয়ার শুভ) আর মা (ওয়াহিদা মল্লিক জলি)। নেশাদ্রব্য গ্রহণকারীদের ওপর তথ্য সংগ্রহ করতে গিয়েই রেণুর পরিচয় ইমরানের (শেহজাদ চৌধুরী) সঙ্গে। ঢাকার প্রচলিত ছবিতে প্রায়ই নায়িকাকে বড় ধরনের সংকট থেকে উদ্ধারের মধ্য দিয়ে নায়কের আগমন ঘটতে দেখি। রেণুর জীবনে অবশ্য তেমন অলৌকিক কিছু ঘটে না। ইমরানের সঙ্গে আকস্মিক প্রণয় উল্টো তাকে গভীরতর সংকটের দিকে টেনে নিয়ে যায়।
মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো রেণু একদিন আবিষ্কার করে তার গর্ভে ইমরানের সন্তান এবং ইমরান বিয়েশাদির মতো লোক দেখানো ব্যাপার-স্যাপারে মোটেও আগ্রহী নয়। নেশাগ্রস্ত ইমরানের সঙ্গে রেণুও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে যেতে থাকে জটিলতর চক্রে। জীবনটা রংচঙে ঢাকাইয়া ছবি নয় আর বাস্তবতার স্বাদ প্রায়ই তেতো বলেই হয়তো।
ইমরান যেন আস্ত এক ঘূর্ণিঝড়। ক্ষিপ্র অশ্বারোহীর মতো সে দিগন্তে উদয় হয় আর দখল করে নেয় রেণুকে।
ঝোড়ো হাওয়ার মতো সে আসে, ঝড়ের বেগেই অকস্মাৎ মিলিয়ে যায়। লন্ডভন্ড করে দিয়ে যায় রেণুর গোটা জীবন। তার পরও শেষ দিকে ইমরান সম্ভবত তাদেরই ঘরের একজন হয়ে উঠছিল। কিন্তু এরই মধ্যে ঘনিয়ে আসে বিভীষিকাময় সেই রাত। রেণু আসমান থেকে পুনরায় মাটিতে ছিটকে পড়ে।
প্রচলিত ধারার ‘দ্য এন্ড’ প্রদর্শন দিয়ে হয়তো ছায়াছবির পর্দা নামে। কিন্তু ডুবসাঁতার অথবা রেণুর ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ জীবনের দিস্তান কেবল ‘দ্য এন্ড’ প্রদর্শন দিয়েই ফুরোয় না। জীবন বহিয়া চলে...
নুরুল আলম আতিকের অসাধারণ ‘ভিজুয়াল সেন্স’-এর পর ডুবসাঁতারের অন্যতম সম্পদ জয়া আহসানের আগাগোড়া দুর্দান্ত অভিনয় এবং সিনেমাটোগ্রাফার রাশেদ জামানের ক্যামেরার খেল। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী রোকন আর ভাতচোরের (দেবাংশু হোর) মতো বিচিত্র চরিত্রের দেখা এ দেশের ছবি খুব বেশি পেয়েছে বলে মনে হয় না। রেণুর ফেলে আসা শৈশবের ট্রেনে চাপা পড়া সেই সাদা রাজহংস, রাগে-ক্ষোভে রোকনের একের পর এক পটাপট ডিম ভাঙার দৃশ্য মনে থাকবে ম্যালা দিন।
‘আমি যদি ডুইবা মরি’ গানটা যেন রেণুর জীবনেরই প্রতিচ্ছবি। বিষাদ আর বেদনামাখা। গানের কথা ফুরোবার পরও মনের গহিনে তার অনুরণন চলতে থাকে নিরন্তর।
এফডিসির ব্যানারে প্রস্তুতকৃত শতভাগ দেশীয় ফর্মুলার ছবি আর বিকল্পধারার ছবি—বাংলাদেশের সিনেমা বলতে মোটা দাগে এই দুই ঘরানার ছবিকেই চিনি আমরা। একটা মুড়ি-মুড়কির মতো দেদারসে বিকোয়, অন্যটা শুধু বিশেষ এক শ্রেণীর জন্য বরাদ্দ।
ডুবসাঁতার দুই ঘরানার ছবি থেকেই বেশ খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে। আমাদের চেনা পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবির সঙ্গে ‘ডিজিটাল’ উপাধিপ্রাপ্ত ডুবসাঁতার-এর কী কারিগরি তফাত, সেই ফয়সালা আপাতত তোলা থাকল। বলে রাখি, এখন পর্যন্ত কোনো সিনেমা হলে মুক্তি পাওয়ার সৌভাগ্য হয়নি এই ছায়াছবির। মুক্তির মাধ্যম হিসেবে অগত্যা ডুবসাঁতারকে বেছে নিতে হয়েছে সেই টিভি পর্দাই। এত সব বিপত্তির মধ্যেও ডুবসাঁতার অবশ্য আসল কাজের কাজটি করতে ছাড়েনি।
শুনিয়ে দিয়েছে, এই দেশে ‘পাইপলাইনে’ অপেক্ষমাণ শত মেধাবী তরুণ নির্মাতার আগমনধ্বনি। আলগোছে উড়িয়ে দিয়ে গেছে নতুনের বিজয়কেতন।
Doob Shatar - A Digital Movie by Nurul Alam Atik
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।