আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভুল পথ থেকে ফেরার গল্প ‘রানওয়ে’



কোন ধরনের কাট-ছাঁট ছাড়াই খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ পরিচালিত ও ক্যাথরিন মাসুদ প্রযোজিত নতুন ছবি ‘রানওয়ে’ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের ছাড়পত্র পায়। চলতি বছরের ২রা অক্টোবর শনিবার বিকেল ৩টায় কেন্দ্রীয় পাবলিক লাইব্রেরীর শওকত ওসমান মিলনায়তনে এই ছবির প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। এরপর পরিচালক সিদ্ধান্ত নেন চলতি বছরের শেষনাগাদ ছবিটি সারা দেশের মানুষকে দেখানোর । আর তা শুরু হবে ঢাকার বাইরে থেকে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৬ ডিসেম্বর থেকে তিনব্যাপী বন্দর নগরী চট্টগ্রামের প্রদর্শনী শেষে সিলেটে ২৩ ডিসেম্বর থেকে সিলেট অডিটরিয়ামে শুরু হয় তিনদিনব্যাপী প্রদর্শনী।

শুক্রবার বিকাল ৫টার শো শুরুর পূর্বে এ ছবিটি সম্পর্কে জানতে চাইলে খ্যাতিমান পরিচালক তারেক মাসুদ বললেন, ২০০৮-০৯ সালে চিত্রায়িত এই কাহিনীচিত্রটির পটভূমি হিসেবে এসেছে ২০০৫-০৬ সালে জাতীয় পর্যায়ে সংঘটিত কিছু ঘটনা। তিনি বলেন, ‘রানওয়ে’ ছবিটি আমার দীর্ঘ পর্যবেণের ফসল। এ ছবিতে উগ্র ধর্মীয় মতবাদ তরুণদের কিভাবে গিলে ফিলে সে চিত্রই ফুটে উঠেছে। আমাদের ধর্ম সহিষ্ণুতা ও উদারতার কথা বলে। কিন্তু ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে কীভাবে তরুণদের ভুলপথে নিয়ে আসা হচ্ছে কিংবা কি কারণে তরুণরা ওই পথের যাত্রী হচ্ছে তাই খুবই সহজভাবে এই ছবিতে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বলে উল্লেখ করেন পরিচালক তারেক মাসুদ।

তারেক মাসুদ বলেন, ‘রানওয়ে’ ছবিটি বানিয়েছি এই সময়ের তরুণ প্রজন্মের জন্য। তাদের সামনে এখন কোনো আদর্শ নেই। এই সময়টাতে তরুনরা যেসব সংকটে পড়ে তাই এ ছবির প্রধান বিষয়। রানওয়ে ছবি দেখলে তরুণদের কাছে অনেক প্রশ্নের উত্তর পরিষ্কার হয়ে যাবে। তারা বিপথগামী হবে না।

তাই তরুণদেরকে তিনি আহ্বান জানান এই ছবিটি দেখতে। সিলেট অডিটরিয়ামে চলাকালীন শোতে অধিকাংশ তরুণ দর্শক দেখে তিনি অনেক আনন্দ পেয়েছেন বলে এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন। তিনি এক কথায় বলেন, ‘আমি এতোটা আশা করিনি। আমার ইচ্ছা পূরণ হয়েছে, আশাতীত সাড়া পেয়েছি’। দর্শকপূর্ন সিলেট অডিটরিয়ামে দুপুর ৩টার শো শেষে ছবি সম্পর্কে দর্শকদের মন্তব্য জানতে চাইলে তারা এক কথায় বললেন ‘ ছবির শিল্পিত দৃশ্যায়নে আমরা মুগ্ধ’।

রানওয়ে ছবির জন্য দর্শকরা তারেক মাসুদকে ধন্যবাদ জানান। সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের শিার্থী এস এম রাশেদ নূর ও সুরাইয়া সুলতানা বলেন, রানওয়ে ছবিতে প্রচলিত ধারার ছবির মতো নাচ, গান না থাকলেও পর্দা থেকে এক সেকেন্ডের জন্য চোখ ফেরানো যায় না। ’ এই ছবিটির প্রশংসা শুনে শুক্রবার বিকাল ৫টায় ছবিটি দেখতে অডিটরিয়ামে হাজির হন অনেকেই। দর্শক সারির প্রায় শতভাগই তরুন-তরুনী। শো শেষে কথা হয় শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তিন তরুন আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, নুরুল আনাম বাবু আর বিল্লাল হোসেনের সঙ্গে।

তারা বলেন, এই ছবিটি দেখে আমাদের মতো অনেক তরুনেরই অনেক কিছু শেখার আছে। কেননা ধর্মীয় উগ্রতা কিভাবে তরুনদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে তারা এখানে স্পষ্টভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। সময়ের প্রয়োজনে যে সময়ে যে চলচ্চিত্রটি তৈরী হওয়া উচিত তারেক মাসুদ সেইরকম একটি চলচ্চিত্রই নির্মাণ করেছেন বলে তারা উল্লেখ করেন। আব্দুল্লাহ-আল-মামুন, নুরুল আনাম বাবু এবং বিল্লাল হোসেন আরো বলেন, একটি চলচ্চিত্র ভালো হয়েছে তা দেখে শুধু বাহবা কিংবা ভালো হয়েছে এ মন্তব্য পর্যন্ত সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। যে ল্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে ছবিটি বানানো হয়েছে তার দিকে খেয়াল রাখতে হবে।

মোট কথা ছবিটির মূল চেতনা প্রত্যেকের মধ্যেই ধারন করা উচিত। সারা দেশের তরুন প্রজন্মকে এ ছবিটি দেখার অনুরোধ জানান ওই তিন তরুন। তিনদিনব্যাপী প্রদর্শনীতে দেখা গেছে একই চিত্র। প্রতিটি শো শুরুর পূর্বে সিলেট অডিটরিয়ামের সামনে দর্শকদের দীর্ঘ লাইন। অডিটরিয়ামে নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না সেই লাইন।

অডিটরিয়ামের প্রবেশ মুখের বাইরেও চলে গিয়েছিল দর্শক লাইন। এক কথায় বলতে গেলে, চট্টগ্রামের মতো সিলেটেও তারেক মাসুদ পরিচালিত ও ক্যাথেরিন মাসুদ প্রযোজিত রানওয়ে দর্শকদের মন জয় করেছে। ছবিটি দেখতে দর্শকদের ঢল নেমেছিল। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, দর্শকের তালিকায় অধিকাংশ তরুন-তরুনী। জানা গেছে, ২৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় সিলেট অডিটরিয়ামে প্রথম প্রদর্শনী শুরু হয়।

একই দিনের দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রদর্শনীটি হয় বিকাল ৫টা এবং সন্ধ্যা ৭টায়। ২৪ ও ২৫ডিসেম্বরেও একই স্থানে সকাল ১১টা, বিকাল ৩টা ও ৫টা এবং সন্ধ্যা ৭টায় এর প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। এই ছবিটির পাশাপাশি ১৫মিনিটের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক প্রামাণ্য চিত্র ‘নরসুন্দর’-এরও প্রদর্শনীও হয়। প্রদর্শনীর টিকিটের মূল্য নির্ধারণ করা হয়েছে ৪০ টাকা। ’ শ্র“তিচিত্র ও প্রান্তিক পর্ষদ আয়োজিত এ প্রদর্শনীর সহযোগিতায় ছিল চোখ ও মুভিয়ানা ফিল্ম সোসাইটি।

ঢাকার বাইরে থেকে ছবিটির প্রদর্শনী শুরু হওয়া প্রসঙ্গে পরিচালক তারেক মাসুদ বলেন, ‘আমরা চাইছি এই ছবিটি সারা দেশের দর্শকরাই উপভোগ করুন। এজন্য আমাদের নিজেদের ব্যবস্থাপনায় প্রজেক্টরে ছবিটি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা করেছি। ’ তিনি বলেন, ‘আমি চাই নতুন প্রজন্ম হলে গিয়ে ছবিটি দেখুক। এজন্য তাদের মধ্যে আগ্রহ তৈরি করতে হবে। এই বিষয়টিকে মাথায় রেখেই এ ধরনের ব্যতিক্রমী আয়োজন নিয়ে ছবিটির প্রদর্শনী শুরু করা হয়েছে বলে তিনি জানান।

ছবির কাহিনী ও পাত্র-পাত্রী ঃ ‘রানওয়ে’ ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র রুহুল। আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে সংলগ্ন একচালা ঘরে রুহুল ও তার পরিবার বসবাস করে। মা, বুড়ো দাদা, রুহুলের বোন আর রুহুল এই চার জনের পরিবার। ছবির শুরুতেই উড়োজাহাজের প্রচন্ড শব্দে থরথর করে কেঁপে উঠে রুহুলদের ঘর। আর এই শব্দে ঘুম ভেঙে যায় বুড়ো দাদার।

তার চাহনিতে অনিশ্চিত জীবনের হাতছানি। এরপরও কাহিনী চলতে থাকে। রুহুলের মা রহিমা ুদ্র ঋণ সমিতির মাধ্যমে একটি গাভী কিনে দুধ বিক্রি করে সংসার চালানোর নিরন্তর প্রচেষ্টা চালাতে থাকেন। রুহুলের বোন ফাতেমা কাজ করে পোশাক রপ্তানি কারখানায়। সংসারের চাকায় গতি আনতে রুহুলের বাবা পাড়ি জমান দেশের বাইরে।

এক সময় তিনিও হয়ে যান নিরুদ্দেশ। আর মাদ্রাসায় অধ্যয়নরত দাখিল পরীায় অংশগ্রহন করতে না পারা এক টগবগে তরুন রুহুল। আদর্শবাদী এই তরুন চাকরি হাজারো চেষ্টা চালিয়ে যায়। চাকরির সুযোগ না পাওয়ায় সে হতাশ হয়ে পড়েন আর দিন কাটান উড়োজাহাজের ছায়ায়। মাঝে মধ্যে মামাকে সাইবার ক্যাফের ব্যবসায় সাহায্য করে এবং ইন্টারনেট শেখার চেষ্টা করে।

সেখানেই তার পরিচয় ঘটে আরিফের সঙ্গে। প্রযুক্তিতে দ আরিফের সাথে তার ক্রমশ: বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। আরিফ উগ্র ধর্মীয় রাজনীতির মধ্যে জীবনের অর্থ খুঁজে পেতে রুহুলকে উদ্বুদ্ধ করে। রুহুলকে টেনে নিয়ে যেতে থাকে জঙ্গিবাদের পথে। আর আরিফের কথামতো নিজের অজান্তেই এই ভুলপথে পা রাখে রুহুল।

আরিফের পরামর্শ মতো আফগানিস্তান-ফেরত মুজাহিদ দলনেতার জঙ্গি শিবিরে শরিক হয় রুহুল। সিনেমা হল আর বিচারকদের ওপর বোমা বিস্ফোরণ ঘটায় আরিফ আর তার দল। এদিকে গৃহত্যাগী রুহুলের মনে বারবার কড়া নাড়ে তার বিবেক। শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে আসে জীবনের পথে । ছবির বিষয় নির্বাচনে তারেক মাসুদ সাহসিকতার পরিচয়ই দিয়েছেন বটে।

যে সমাজ বাস্তবতাকে ‘স্পর্শকাতর’ বলে এড়িয়ে গেছেন অনেকেই তারেক মাসুদ সেই জায়গাটায় হাত দিয়েছেন। সাফল্যও পেয়েছেন তিনি। তারেক মাসুদের নতুন ছবি ‘রানওয়ে’এর বেশির ভাগ প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন নতুন শিল্পী। যাদের মধ্যে রুহুল চরিত্রে ফজলুল হক, রহিমা চরিত্রে রাবেয়া আক্তার মনি, আরিফ চরিত্রে আলী আহসান উল্লেখযোগ্য। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, নাজমুল হুদা বাচ্চু, মোসলেম উদ্দিন, নাসরিন আক্তার ও রিকিতা নন্দিনী শিমু।

এছাড়াও অতিথি শিল্পী হিসেবে একটি বিশেষ চরিত্রে অভিনয় করেছেন নুসরাত ইমরোজ তিশা। ক্যাথরিন মাসুদের সঙ্গে যৌথভাবে গল্প, চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন তারেক মাসুদ। ছবিটির চিত্রায়নে ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনীর চৌধুরীর ছেলে মিশুক মুনীর। ছবির জন্য জমি বিক্রি ঃ ছবি নির্মাণের জন্য নিজের জায়গা-জমি বিক্রি করেছেন এমন পরিচালকের দেখা মেলা ভার। কিন্তু রানওয়ে বানাতে ক্যাথরিন মাসুদের স্কলারশিপের টাকায় কেনা ঢাকার আড়াই কাঠার জমিটি বিক্রি করেছেন বলে জানান পরিচালক তারেক মাসুদ।

তারা এখন ভাড়া বাসায় থাকেন । কিন্তু ছবির জন্য তারা কোথাও সাহায্যপ্রার্থী ছিলেন না বলে জানান।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।