আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শেখ সাহেবের গপ্পো

জাদুনগরের কড়চা
নাহ, ইনি শেখ মুজিব নন, কিংবা তেলের সাগরে ভাসা আরব শেখও নন -- ইনি হলেন শেখ দীন মুহাম্মদ। আর এই গল্পের সূচনা আজ থেকে প্রায় আড়াইশ বছর আগে। ‌‌ শ্যাম্পু শব্দটি আজ ইংরেজি ভাষার একেবারে নিজের শব্দের মতো বনে গেছে। সানসিল্ক কিংবা আরো দামি নানা শ্যাম্পুর বিজ্ঞাপণে ভর্তি থাকা টিভি/পত্রিকা দেখে কিন্তু বোঝার অবকাশ নাই, এই শ্যাম্পুর সাথে শেখ সাহেব আর বাংলার সম্পর্কটা কী। চলুন ফেরা যাক আজ থেকে আড়াইশ বছর আগের ভারতবর্ষে, যেখানে শেখ সাহেবের মাত্র জন্ম হয়েছে।

শেখ দীন মুহাম্মদের জন্ম ১৭৫৯ সালে, "বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা"র নবাবী আমল তখন মাত্র ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি আর লর্ড ক্লাইভের হাতে ধরাশায়ী। এক বাঙালি মুসলিম পরিবারে দীন মুহাম্মদের জন্ম, নিবাস ছিলো পাটনায়, যা এখন বিহারে পড়েছে। দীন মুহাম্মদের আত্মজীবনী অনুসারে তার পূর্বপুরুষেরা মুগল সম্রাটদের প্রশাসনে কাজ করতেন, আর বাংলার নবাব পরিবারের সাথেও তাদের ছিলো লতায় পাতায় আত্মীয়তা। দীন মুহাম্মদের যখন জন্ম, নবাবী আমল প্রায় শেষ, মীর জাফর, মীর কাসিম এরা নামে মাত্র নবাব বনে আছেন। মুগল সম্রাটও প্রায় ক্ষমতাহীন।

বড় হতে হতে দীন মুহাম্মদ শিখে ফেললেন মুগল আমলের সব রসায়ন বিদ্যা, সাবান, সুগন্ধি, তেল সবকিছু বানাবার কৌশল। সাথে উপরি হিসাবে কিছু চিকিৎসাবিদ্যাও। নবাবী আমলও নেই, দরবারও নেই, তাই দীন মুহাম্মদ যোগ দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ফৌজে, শিক্ষানবিশ চিকিৎসক হিসাবে। খুব অল্প বয়সেই যোগ দিয়েছিলেন, আর ইঙ্গ-আইরিশ অফিসার ক্যাপ্টেন গডফ্রি ইভান বেকারের সাথে কাজ করতেন। ১৭৮২ সালে ক্যাপ্টেন বেকার সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন, কেউ কেউ বলে করতে বাধ্য হন, আর ফিরে যান ব্রিটেনে।

দীন মুহাম্মদ তার এই ক্যাপ্টেন সাহেবের সাথে সাথে চলে আসেন বিলেতে। বেকার পরিবারের সাথেই তিনি ১৭৮৪ সালে চলে যান আয়ারল্যান্ডের কর্কে। ইংরেজি শেখার জন্য ভর্তি হন স্কুলে, সেখানে পরিচয় আইরিশ কিশোরী জেইন ডেলির সাথে। সুন্দরী জেইনের প্রেমে পড়ে যান দীন মুহাম্মদ, কিন্তু জেইনের পরিবার অমত করায় পালিয়ে যান দুজনে পাশের শহরে ১৭৮৬ সালে, বিয়ে করেন। ততোদিনে দীন মুহাম্মদ খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষা নিয়েছেন।

নানাদেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাকে নিয়ে দীন মুহাম্মদ ১৭৯৪ সালে The Travels of Dean Mahomet বা দীন মুহাম্মদের সফর নামা নামের বই লিখেন। ভারতবর্ষ নিয়ে ইউরোপে তখন কৌতুহলের কমতি নেই, তাই বইটি বেশ জনপ্রিয়তা পায়। দীন মুহাম্মদের গল্পের পরের অধ্যায় লন্ডনে। ১৮১০ সালে সেখানে মুহাম্মদের পরিবার চলে আসার পরে একটা রেস্তোরা খুলেন দীন মুহাম্মদ। এটাই ছিলো ইংল্যান্ডের প্রথম ভারতীয় খাবার দাবারের রেস্তোরা।

লন্ডনের জর্জ স্ট্রিটে খোলা হিন্দুস্তান কফি হাউজ নামের এই দোকানটি অবশ্য খুব ভালো চলেনি, অল্পদিন পরেই লোকসানের চোটে বন্ধ হয়ে যায়। দুশো বছর পরে ভারতীয় তথা বাঙালি খাবারের কী জয়জয়কার হবে ইংল্যান্ডে, শেখ দীন মুহাম্মদ জানতে পারেননি, লালবাতি জ্বেলে রেস্তোরার ব্যবসা বাদ দিয়ে লন্ডন ছেড়ে চলে যান। (জর্জ স্ট্রিটে সম্প্রতি স্থাপিত স্মারক ফলক) লন্ডনে রেস্তোরার ব্যবসাতে সাফল্য না পেলেও দীন মুহাম্মদের ভাগ্য ফিরে যায় ব্রাইটনে। ১৮১৪ সালে সপরিবারে এই শহরে বসতি স্থাপনের পর দীন মুহাম্মদ খুলে বসেন তার স্নানাগার। সেসময়কার একটি স্থানীয় পত্রিকায় তার দোকানের বিজ্ঞাপন দেয়া হয় এভাবে - The Indian Medicated Vapour Bath (type of Turkish bath), a cure to many diseases and giving full relief when every thing fails; particularly Rheumatic and paralytic, gout, stiff joints, old sprains, lame less, aches and pains in the joints এই সুগন্ধি স্নানাগারে খদ্দেররা পেতেন দীন মুহাম্মদের তৈরী করা মাথার চুলে মাখাবার তেল -- সেই তেল দিয়ে খদ্দেরদের চুলে মাথায় মালিশ করে দেয়া হতো।

তেল মালিশের এই কাজটাকে হিন্দুস্তানী ভাষায় বলায় হতো চ্যাম্পু করা, আর সেই শব্দটিই সাগর পেরিয়ে মুহাম্মদের স্নানাগারে গিয়ে হয়ে যায় শ্যাম্পু। (দীন মুহাম্মদের শ্যাম্পু স্নানাগার) ইংরেজদের কাছে এই শ্যাম্পুর দোকান অভিনব ঠেকেছিলো, তাই দীন মুহাম্মদের দোকান Mahomed's Steam and Vapour Sea Water Medicated Baths ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় উনবিংশ শতকের ইংল্যান্ডে। দূর দূরান্ত থেকে লোকজন কেবল দীন মুহাম্মদের দোকানে শ্যাম্পু করাতে ছুটে আসতো। শ্যাম্পু করে রোগবালাই দূর হয়, এই বিশ্বাসে হাসপাতাল থেকে রোগীদের পাঠানো হতো ব্রাইটনে। আর তেল মালিশ করে করেই দীন মুহাম্মদ পেয়ে যান ড: ব্রাইটন খেতাব।

জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌছে যাওয়া এই মালিশ-চিকিৎসার সুবাদে খোদ ইংল্যান্ডের রাজা ৪র্থ জর্জ ও ৪র্থ উইলিয়ামের "শ্যাম্পু সার্জন" হিসাবে মুহাম্মদ নিয়োগ পান। ১৮৫০ এর পরে তেলের বদলে সুগন্ধি সাবান দিয়ে চুল ধোয়ার রীতি চালু হয়, কিন্তু রয়ে যায় শ্যাম্পু নামটি। (১৮১৮ সালে "শ্যাম্পু সার্জন শেখ দীন মুহাম্মদ") দীন মুহাম্মদ মারা যান ১৮৫১ সালে, নব্বইয়ের কোঠায় পৌছে। জেইনের সাথে দীন মুহাম্মদের সংসারে এসেছিলো ছয়টি সন্তান - রোসানা, হেনরি, হোরেশিও, ফ্রেডেরিক, অ্যামেলিয়া, ও আর্থার। এর মাঝে ফ্রেডেরিক বাপের পেশায় যোগ দেন।

ফ্রেডেরিকের ছেলে ফ্রেডেরিক হেনরি হোরেশিও আকবর মুহাম্মদ (বাপরে, বাপ দাদা সবার নামের সমাস!!) চিকিৎসক হিসাবে আন্তর্জাতিক খ্যাতি লাভ করেন। লন্ডনের গাইস হাসপাতালে কাজ করার সময়ে উচ্চ রক্তচাপের উপরে গবেষণা করে আবিষ্কার করেন অনেক নতুন তথ্য। (দীন মুহাম্মদের স্ত্রী জেইন) দীন মুহাম্মদের কথা ইতিহাস ভুলে যায় ধীরে ধীরে। বিস্মৃতির আড়ালে একশো বছর কাটাবার পরে সত্তর ও আশির দশকে আস্তে আস্তে ঐতিহাসিকরা আবার খুজে পান শেখ দীন মুহাম্মদের সেই কাহিনী, বাংলা থেকে ব্রাইটন অবধি এই বঙ্গসন্তানের অভিনব জীবনগাথা। ইংরেজদের ভারতীয় খাবার ধরাতে দীন মুহাম্মদ পারেননি, দেউলিয়া হয়ে গেছিলেন, কিন্তু আজ দুশো বছর পরে সেই খাবার ছড়িয়ে গেছে সেখানে।

আর শ্যাম্পু? শেখ সাহেবের সেই শ্যাম্পুর দোকান থেকে শুরু হওয়া শ্যাম্পু করার ধারা ছড়িয়ে আছে বিশ্বজুড়েই। আর এভাবেই শেষ কিংবা শুরু সেই শেখ সাহেবের গপ্পো ... সূত্র # উইকিপিডিয়া # Mahomet, Dean. The Travels of Dean Mahomet: An Eighteenth-Century Journey through India. Berkeley: University of California Press, c1997 1997. http://ark.cdlib.org/ark:/13030/ft4h4nb20n/ ছবিগুলো শেখ দীন মুহাম্মদের রচনা এবং উপরোক্ত বই থেকে নেয়া।
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।