আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফিল্মকে আমি উপলব্ধি বা বিমূর্ত কল্পনার উপর দাঁড় করিয়েছি; বর্ণনা, চরিত্র বা ঘটনা দিয়ে নয় : কার্লোস রেগাদাস (৬ষ্ঠ কিস্তি)

বুকের ভেতর বহু দূরের পথ...
(গত বইমেলায় (২০১০) ঐতিহ্য থেকে প্রকাশিত রুদ্র আরিফ ও বিজয় আহমেদ সম্পাদিত ‌‌ফিল্মমেকারের ভাষা বইটিতে একটি অধ্যায় অনুবাদ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বইটি দশজন বিখ্যাত ল্যাটিন আমেরিকান চলচ্চিত্রকারের জীবনী ও বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত সাক্ষাৎকারের সংকলন। আমার অনূদিত অধ্যায়টি ছিলো মেক্সিকান ফিল্মমেকার কার্লোস রেগাদাস কে নিয়ে। সামু ব্লগাদের জন্য কিস্তি আকারে অনুবাদটা প্রকাশ করলাম। এ পর্বে থাকছে নিজের তিনিটি ফিচার ফিল্ম সম্পর্কে কার্লোসের বক্তব্য) কিস্তি ১ কিস্তি ২ কিস্তি ৩ কিস্তি ৪ কিস্তি ৫ বিষয়: নিজের নির্মিত ফিচার ফিল্ম জাপান ও ব্যাটেল ইন হ্যাভেন : পর্ব ৩ সাক্ষাৎকারক : ব্যাটেল ইন হ্যাভেন ফিল্মে দেখা যায় মার্কোস নিজের ছায়া থেকেও নিজেকে লুকানোর চেষ্টা করছে, এবং নিজের ভাগ্যের মুখোমুখি হতেও ভয় পাচ্ছে।

সে তার চশমা হারিয়ে ফেলে এবং মাথাকে হুড দিয়ে ঢেকে একটি ধর্মীয় শোভাযাত্রায় অংশ নিচ্ছে। ফিল্মটির বিভিন্ন যৌনদৃশ্যে সে অন্য শরীরের তৃপ্তিতে নিজেকে লুকিয়ে ফেলে। কার্লোস রেগাদাস : এমনটা আমরা জীবনে প্রায়ই করে থাকি। আমরা নিজেদের কাছ থেকে মনোযোগ হারাই। এ ধরনের বিষয়ের মুখোমুখি হওয়া কঠিন, এবং মাঝে মধ্যে যদি আপনি চেয়েও থাকেন, তবু আপনার মনোযোগ বা শক্তি থাকে না।

আর মার্কোস এটাই করতে চেয়েছিল। নিজের মুখোমুখি হওয়ার মুহূর্তকে সে যেভাবেই হোক স্থগিত করে দিতে চাইতো। যদিও সে স্থগিত করে দিতে চাইতো, কিন্তু সময়কে তো আর থামানো যেতো না। ফলে ব্যাপারটি তার ভেতরে ক্রমাগত কাজ করছিল। সাক্ষাৎকারক : এ ফিল্মে মার্কোসের সঙ্গে আনার শারীরিক সম্পর্কের দৃশ্যটি খুবই ভালো লেগেছে; কারণ, এ দৃশ্যের ভাবনা ও চিত্রায়ন ছিল স্পষ্ট ও চমৎকার।

তারা নিজেদের আদর করার মধ্য দিয়ে মুরু করে, তারপর পরস্পরের যথেষ্ট কাছাকাছি চলে আসে। ঠিক তখনই ক্যামেরা রুমের বাইরে চলে যায়। ধীরলয়ে আশেপাশের প্রকৃতিকে ধারণ করে অন্যান্য ঘরবাড়ির জানালা অতিক্রম শেষে আবার তাদের বিছানায় ফিরে আসে। সেখানে শরীর দু’টিকে পাশাপাশি পড়ে থাকতে দেখা যায়। শরীর দু’টি অত্যন্ত করুণ ও অপ্রতিকার্য বস্তুনিষ্ঠভাবে এবং পারস্পরিক অনেক দূরবর্তীভাবে ফুটে ওঠে।

কার্লোস রেগাদাস : হ্যাঁ, তাই। এর কারণ, যদিও মার্কোসের যথেষ্ট কাছাকাছি পৌঁছায় আনা, তার সঙ্গে মজা করে, তাকে স্পর্শকাতর নামে ডাকতে পারে; কিন্তু আমার লক্ষ্য ছিল, তাদের যৌনসম্পর্কের প্রতিনিধিত্ব করা। তা সত্ত্বেও আমরা বাইরে ছাদে চলে আসি এবং আবার বস্তুনিষ্ঠতা দেখাই, এবং যখন আমরা ফিরে আসি, তখন নিশ্চিত যে, তাদের মধ্যে একটা বিশাল প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। তারা দু’টি ভিন্ন জগত থেকে এসেছে। যদি তারা শারীরিকভাবে একে অপরকে স্পর্শ করে, যা ইচ্ছে তা-ই করতে পারে।

কিন্তু সত্যিকার অর্থে অভ্যন্তরীন, আন্তরিক, মানসিক দিক থেকে তাদের মধ্যে বিস্তর ফারাক। আর এজন্যই অন্ততঃ মার্কোসের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তারা তাদের শক্তিতে শুধু ভিন্ন একটি মাত্রায় ভাগাভাগি করতে পারে। সাক্ষাৎকারক: অভিনেতাদের কাছাকাছি যাওয়ার ব্যাপারটা একইভাবে আপনার পর্যবেক্ষণে বিশ্বাস এই তত্ত্বের উপর ভবিষদ্বাণী করা যায়। কয়েকদিন আগে অ্যানাপোলা মুসকেডিজের (আনা) সঙ্গে দেখা করি এবং শুনে অবাক হই, তিনি যতবারই এই ফিল্ম দেখেছেন, তার অভিনয় করা ‘আনা’ চরিত্রটি নিয়ে প্রতিবারই ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন! এর মানে মনে হয়েছে, তিনি আসলে মানসিকভাবে চরিত্রটির মধ্যে ছিলেন না। নয়তো বা আপনি খুব রহস্যময়ভাবে তাকে এ ফিল্মে উপস্থাপন করেছেন।

কার্লোস রেগাদাস : এটা আসলে আমি ইচ্ছে করেই করেছি। লোকজন বলছে, আনা চরিত্রটি অনেক ধনী, একইসঙ্গে বিতৃষ্ণ সেজন্য সে নিজেকে পতিতাবৃত্তিতে জড়িয়েছে। আমি মনে করি, এ হলো কে আসলে কী সেটা তার বাহ্যিক রূপ দেখে বোঝার চেষ্টা করার একটা পথ। আমি আরো মনে করি, মানুষের অস্তিত্বই তার শক্তিকে নিঃশেষিত করার একমাত্র কারণ। এবং এই অস্তিত্ব সবসময়ই এক; কিন্তু আমরা আমাদের এবং অন্যেরটা অবহিত হই, অন্যরা অবহিত করে, সবসময়ই কোনো নির্দিষ্ট চলকের উপর নির্ভর করে।

আর আমি এটাই চেষ্টা করেছি। আমি ফিল্মটিকে উপলব্দি বা বিমূর্ত কল্পনার উপর দাঁড় করিয়েছি; ভবিতব্য কোনো বর্ণনা কিংবা কোনো চরিত্রের নিকটবর্তী কোনো ঘটনা নিয়ে নয়। আর আমি এটা বিশ্বাস করি, এগুলো থিয়েটার এবং বাজে ফিল্ম ছাড়া ভালো ফিল্মের উপকরণ নয়। বাস্তব জীবনেরও না। আমি সবসময় দ্ব্যর্থকভাবে মানুষের উপস্থিতি বা তার অস্তিত্বকে উপলব্দি করতে চেয়েছি।

আসলে দ্ব্যর্থকভাবে না, আমি দুঃখিত...! আমি এটা বুঝাইনি। এই উপস্থিতি বা বিদ্যমান থাকাটা সবসময়ই পরিবর্তনশীল। আমি আসলে ‘দ্ব্যর্থকভাবে’ কথাটা ব্যবহার করতে চাইনি। কারণ, যখন অস্পষ্ট অনুভব করবেন এবং মাঝে মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো পথে অনুভব করবেন, তখন সেখানে অনিশ্চিত কোনো বিষয় থাকবে না। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বা পরবর্তী দিনে আপনি হয়তো একই ব্যক্তির কথা ভাববেন, তবে ভিন্নভাবে একই তীব্রতা অনুভব করবেন।

তাই এটা অনিশ্চিত নয়, বরং তারচেয়ে স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত চরিত্রের পরিবর্তে পরিবর্তনশীল উপলব্দি বা বিমূর্ত কল্পনা। সাক্ষাৎকারক : আপনি যা বললেন, তা রবার্তো ব্রেসেঁর (ফরাসী ফিল্মমেকার) কথা মনে করিয়ে দেয়। কার্লোস রেগাদাস : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি যা বলছি, তা আমার মৌলিক ধারণা নয়। ব্রেসঁ একে একটি প্রক্রিয়ার মতো গড়ে তুলেছেন।

তিনি নিজেও এটা উদ্ভাবন করেননি। কিন্তু এ বিষয়ে তত্ত্ব প্রদানকারীদের অন্যতম। এজন্য এর কৃতিত্ব তার। আমি তার মতো একই প্রক্রিয়া অবলম্বন করেছি। পার্থক্য শুধু এক জায়গায়।

তিনি তার অভিনেতাদের বলতেন, ‘নিরপেক্ষ থেকো’; আর এটাই আমি চাই না। আমি যা চাই, তা হলো, তারা যা, তা-ই যেন উঠে আসে। এবং এটা ভিন্ন একটা ব্যাপার। উদাহরণ হিসেবে আমি তাদের বাইরে তাকাতে বলবো। তারা যদি হাসতে থাকে, ব্রেসঁ হলে বলতেন, ‘হাসি থামাও।

সোজা সামনের দিকে তাকাও, এবং নিরপেক্ষ থাকো। ’ আমি কিন্তু তাদের হাসতে দিতাম। আর এটাই পার্থক্য। আমার ব্যক্তিগত উপলব্দি হলো, আপনি যখন ব্রেসেঁর ফিল্মগুলো দেখবেন, বিশেষ করে তার শেষ ফিল্মটি, দেখবেন তিনি তার চরিত্রগুলোকে প্রচণ্ডভাবে একদম একই পদ্ধতিতে ব্যবহার করেছেন। তাদেরকে রোবটের মতো মনে হয়।

কারণ, ব্রেসেঁর মতে, অভিনেতারা তার ধারণার মডেল মাত্র যেটা আমাকে খুবই অবাক করে। আমি একই সময়ে একই রকম কিছু করতে চাই; কিন্তু সেটা চরিত্রকে প্রতিনিধিত্ব করে এমন একজনের জীবনীশক্তিকে নষ্ট করে না। আমার মনে হয়, আমার ফিল্মের চরিত্রগুলো অনেক জীবন্ত এবং স্বকীয়। আর এজন্যই ‘জাপান’-এর সেই মহিলাটি অপূর্ব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। একইভাবে আনা, মার্কোস এরাও প্রত্যেকে ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিত্বের মানুষ।

আর এজন্য আমি ধন্যবাদ পাবো না; কেননা, আমি কেবল তাদের শক্তিকে একাত্ম করে দিয়েছি। সাক্ষাৎকারক : ফিল্মটিতে ধর্মের উপস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন? কার্লোস রেগাদাস : আমি মনে করি ধর্মের ব্যাপারে ফিল্মটিতে দু’টি রূপ আছে। আত্মিকতা যা সবকিছুর মূলে রয়েছে এবং সর্বদা বিদ্যমান; কিন্তু এটি দ্বিতীয় অংশ। আর রয়েছে ধর্মের প্রথাগত দিক। মনে হয় এজন্যই লোকজন ফিল্মটিকে বেশিমাত্রায় মেক্সিকান ভাবছে।

কিন্তু আমি মনে করি, এটা আসলে আমাদের জন্য প্রথাই শুধু। যখন আপনি খারাপ কিছু করেছেন বলে ভাবছেন, এই প্রথা তা থেকে আপনাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে। মেক্সিকোতে এ ধরনের ঐতিহ্যবাহী তীর্থযাত্রা এখনো চলছে। আর তারা এসব করছে ক্ষমা পাওয়ার জন্য। এটাই মার্কোস খুব আপন করে নিতে পারছে না।

কিন্তু তার স্ত্রী পারছে এই নিয়মকে মেনে নিতে। সাক্ষাৎকারক : আপনার আনুষ্ঠানিক যাত্রা এ প্রথার অবসান ঘটানোর সম্ভাব্য ধারণা দেয়; কিন্তু প্রয়োজনীয়ভাবে প্রতিপাদ্য সূচিত করে না, তা রবার্তো রোসেলিনিকে (ইতালিয়ান ফিল্মমেকার) মনে করিয়ে দেয়। কার্লোস রেগাদাস : রোসেলিনির চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আমি জানি না। কখনো পড়িওনি কিছু। তবে তার ফিল্ম দেখে আমি এ সম্পর্কে কিছু আসক্তি লক্ষ্য করেছি।

কিন্তু আমি এটাও মনে করি, তিনি এর অবসান ঘটানোর শক্তিকে অনেক নিকটে থেকে অনুধাবন করেছেন; আর আমি এ থেকে যথেষ্ট দূরেই থেকেছি। আমি মার্কোসের সঙ্গে নিজের ঘনিষ্ঠতা অনুভব করি; রোসেলিনি হয়তো মার্কোসের স্ত্রীর মানসিকতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বোধ করতেন। (চলবে...................)
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।