হ্যানিম্যান
প্রথম পারমাণবিক বোমার পরীক্ষা
পারমাণবিক বোমা নির্মাণের উদ্দেশ্যে ব্রিটেনের ‘ টিউব এলয়েজ’ সংস্থা গঠিত হয় ১৯৪১ খৃষ্টাব্দে । আর একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ম্যানহাট্রান প্রকল্প প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে । এই যে এক বছরের ব্যবধান তার মধ্যে বিশ্ব পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন ঘটে । ১৯৪১ সালে যুক্তরাষ্ট্র মিত্র শক্তির অন্যতম শরিক হিসাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আসরে অবতীর্ণ হয় । যুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পরমাণু অস্ত্র সম্বন্ধে যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং অধিকাংশ আমেরিকান বিজ্ঞানীদের মনোভাব ছিল ‘ ধরি মাছ না ছূই পানি ’ এই প্রবাদ বাক্যের মত ।
কিন্তু হঠাৎ পার্ল হারবারে জাপানীদের কাছে পর্যদুস্ত হওয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্র সরকারের মনোভাবে আমুল পরিবর্তন ঘটে । তারা পারমানবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্পকে সামরিক ভিত্তিতে গ্রহণ করে এবং এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ নিয়োগ করে । যে তত্ত্বীয় ও প্রায়োগিক জটিলতার দরুণ কয়েক বছ পূর্বেও পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনায় অনেক শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানীও ছিলেন আস্থাহীন ইতি মধ্যে সেই পরিস্থিতির দ্রৃত রূপান্তর ঘটেছিল । যে সব বাধা বিপত্তির কারণে এই সব প্রাথমিক দ্বিধাদ্বন্দ দেখা দিয়েছিল ম্যানহাট্রান প্রকল্প শুরুর আগেই সেই সব বাধা বিপত্তির নিরসন হয়েছিল । সুতরাং পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে সাফল্য লাভের জন্য তখন যে দুটি প্রয়োজন মুখ্য হয়ে উঠেছিল সেগুলো হল দৃঢ় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পর্যাপ্ত সম্পদ সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান ।
ব্রিটিশ সরকার এই দুটি প্রয়োজন মেটাতে সমর্থ হয় নি । ব্রিটেন যা পারে নি যুক্তরাষ্ট্র সরকার উৎসাহের সাথেই সেই কাজটি সম্পন্ন করলেন । আর এ উদ্দেশ্যেই সৃষ্ট হল সেই বিখ্যাত অথবা কুখ্যাত প্রকল্প যার নাম ’ম্যানহাট্রান প্রকল্প ‘ । অনেক কাঠ খড় পোড়ানোর পর অবশেষে ১৯৪৫ খ্রীষ্টাব্দে পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটানোর প্রস্ততিপর্ব শেষ হয় । এখন প্রয়োজন শুধু সরেজমিনে পরীক্ষার ।
প্রথম পারমাণবিক বোমা পরীক্ষার ছদ্ননাম দেওয়া হল ট্রিনিটি । এই নাম করণ থেকেই বোঝা যায় যে ম্যানহাট্রান প্রকল্পের কর্ণধার জেনারেল গ্রোভস ও তার উপদেষ্টাদের মানবিক অন্য যে সব গুণের ঘাটতি থাক , কিন্তু রসবোধের অভাব ছিল না । খৃষ্টান ধর্ম মতে ট্রিনিটি শব্দের অর্থ পিতা, পুত্র ও পবিত্র আত্নার তিন রুপ সমন্বিত ঈশর । লস আলামাস থেকে ১২০ মাইল দুরে অবস্থিত আলামোগোরজে বিমান বেসকে এই পরীক্ষার জন্য উপযুক্ত স্থান হিসাবে অনুমোদন করলেন জেনারেল গ্রোভস । যদিও নিরাপত্তার কারণে এই স্থানটি ছিল যথেষ্ট দুরবর্তী এবং বিচ্ছিন্ন , তথাপি ইতরজনের বিভ্রান্তির জন্য একটি বানোয়াট কাহিনী প্রচার করা হল যে এই বিমান বেস এ সংরক্ষিত জিনিসপত্রে এক অপ্রত্যাশিত বিষ্ফোরণ ঘটে গেছে ।
প্রথম পারমাণবিক বোমার জন্য প্রয়োজনীয় প্লটোনিয়াম জুলাই মাসের প্রথমেই লস এলামসে পৌচ্ছেছিল । ১২ জুলাই দুপুরে মহামুল্যবান এই বস্তুটিকে আলামোগোরডোতে স্থানান্তর করা হয় । কয়েক ঘন্টা পরেই অপারমাণবিক অংশসমুহকে বহন করে এক সারি গাড়ির মিছিল গন্তব্য স্থলের দিকে রওনা হল । গন্তব্য স্থানটি হল সেই জনমানবশূণ্য মরু অঞ্চল যেখানে এই উদ্দেশ্যে একটি ১০০ ফুট ধাতব টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছিল । এই টাওয়ারের গোড়ায় স্থাপিত একটি তাবুর মধ্যে পরদিন বিচ্ছিন্ন অংশসমুহকে যথাযথভাবে সন্নিবিষ্ট করা হল ।
সন্ধ্যার মধ্যেই সব কিছুর প্রস্ততি সম্পর্ণ হল , বাকি রইল শুধু বিষ্ফোরক সলতেটি ঢোকানো । পরের দিন সকালে বোমাটিকে টাওয়ারের উপর একটি প্ল্যাটফর্মে উত্তোলন করা হল । বিকাল ৫টার মধ্যে সব প্রস্ততি সমাপ্ত হল । পরীক্ষার সময় নির্ধারিত হল ১৬ জুলাই সূর্যোদয়ের সাড়ে চার ঘন্টা পূর্বে অর্থাৎ রাত আড়াইটার সময় । ১৫ জুলাই মধ্য রাত্রির কিছু পূর্বে এই সময় পরিবর্তন করা হয় ।
রাত তিনটার সময় গ্রোভস এবং ওপেনহাইমার লক্ষ্য করলেন যে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন । যার কারণে সময় আবারও পিছিয়ে দিলেন । সময় চূড়ান্তভাবে নির্ধারিত হল সকাল সাড়ে পাঁচটা অর্থাৎ সূর্যোদয়ের এক ঘন্টা আগে । যে পাঁচজন লোক টাওয়ারে বসে শেষ মুহূর্তের কাজগুলি সমাধা করছিলেন তাদেরকে সকাল পাঁচটায় স্থান ত্যাগ করার জন্য আদেশ দেওয়া হল । প্রত্যেকেই তারা নেমে এসে নিজ নিজ গাড়িতে চড়ে বিপজ্জনক এলাকা ত্যাগ করলেন ।
টাওয়ার এবং তার উপরে অবস্থিত বস্তুটি আলোকিত করার জন্য বিরাট ফ্লাডলাইট জ্বালানো হল । টাওয়ার থেকে মাত্র সতের হাজার গজ দূরে অবস্থিত মূল শিবির । জেনারেল গ্রোভস এই শিবিরে ফিরে আসার দশ মিনিট পর চূড়ান্ত গণনা শূরু হল । সময়ের ব্যবধান যতই কমতে লাগল মিনিট থেকে এসে সেকেন্ডে ঠেকল , আশঙ্কা-উদ্বেগের পরিমাণ সেই তালে লাফিয়ে লাফিয়ে দ্রুত লয়ে বাড়তে লাগল । নিমিষের মধ্যে যা ঘটতে যাচ্ছে তার প্রলঙ্করের সম্ভাবনা সম্বন্ধে এই শিবিরের সকলেই সচেতন ছিলেন ।
বিজ্ঞানীরা অনুভব করছিলেন যে তাঁদের হিসাব নিকাস সঠিক , আর বোমাটির বিস্ফোরণ তাই অবধারিত । কিন্তু একই সাথে প্রত্যেকের মনের গহনে বেশ জোরালো সন্দেহও লুকিয়ে ছিল । রেডিওতে গণনা যখন ১০, ৯, ৮ এ ভাবে শূণ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল তখন একটি খুঁটিতে ভর করে তিনি কাঠের মত নিশ্চপ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন । নিস্তব্ধ ঘরটিতে ”এখন ” শব্দটি উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথেই কয়েকটি মধ্যাহ্ন সূর্যের আলোর সমান দ্বীপ্তিতে বিদ্যুৎ চমকের মত উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো গোটা মরুভুমি , প্রায় দু’শ মাইল পর্যন্ত দেখা গেল জলন্ত বহ্নিশিখার আলো । এটার রঙ সোনালী , রক্তবর্ণ , বেগুনী , ধুসর এবং নীল ।
এই আলো নিকটবর্তী পর্বতমালার প্রতিটি শৃঙ্গ , শৈলশিরা এবং তুষারস্তুপের ফাটলকে এমন সুস্পষ্ট ও সুষমার সাথে প্রদীপ্ত করেছিল যা অবর্ণনীয় । প্রত্যক্ষ দর্শনেই যা শুধু কল্পনীয় । মহান কবিরা যে সৌন্দর্যের শুধু স্বপ্ন দেখেছিলেন , এ সেই সৌন্দর্য । কিন্তু তাদের বর্ণনায় এ সৌন্দর্যের রুপ ধরা পড়ে নি । পৃথিবীর এই প্রথম পারমাণবিক বিষ্ফোরণ প্রত্যক্ষ করতে যে সব বিজ্ঞানীরা উপস্থিত ছিলেন তাদের সবারই মোটামুটি একই ধরণের প্রতিক্রিয়া হয়েছিল ।
ওপেনহাইমার স্মৃতিচারণ করেছেন , “উপস্থিত ব্যক্তিদের কেউ কেউ হেসেছিলেন, কয়েকজন কেঁদে ফেলেছিলেন, তবে বেশীরভাগ ছিলেন স্তব্ধ । পরবর্তী কয়েক ঘন্টায় সংগৃহীত উপাত্ত থেকে জানা গেল যে রকমটি আশা করা হয়েছিল তার চেয়ে অনেক বেশী জোড়ালো হয়েছে বিষ্ফোরণ । গ্রোভস সমরমন্ত্রী স্টিমসনকে জানালেন যে ১৫০০০ থেকে ২০০০০ টন টি. এন. টি –র সমতুল্য বিষ্ফোরণ ঘটেছে । যে ইস্পাতের টাওয়ারটির সাথে বোমাটি বেধেঁ দেওয়া হয়েছিল সেটি প্রচন্ড উত্তাপে বাষ্পীভূত হয়ে গেছে ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।