( এক )
শাল, পিয়াল আর কাজু দিয়ে মোড়া এই শহর।
গ্রীষ্মের বিকেলগুলি -তে মহুয়ার মৌতাত বাতাসকে যেন
আর-ও ভারী করে তোলে।
তার-ই মাঝে রাস্তার একপাশ ধরে মাথা নিচু করে আনমনে হেঁটে চলে ইমন। ---------------হঠাৎ, রাস্তার বাঁ-দিকের ঝুপড়ি মত একটা চায়ের দোকান থেকে কারা যেন চেঁচিয়ে বলে,- -" কি-রে, ইমন , বাবার বৌভাত কেমন খেলি?-"--------------------নীচু মাথাটা, আরও নীচু হয়ে যেন একেবারে ধূলোয় মিশে যেতে চায়।
( দুই )
------------এ আমাদের দিতির ছেলে না? এত বড় হয়ে গেছে?--
--হ্যাঁ, দিন কি আর কারুর অপেক্ষায় বসে থাকে?
--তবে, তোমরা যে বলেছিলে ছেলেটা একদম বকে গেছে? কই? দেখে তো তেমন মনে হোল না--"
--নাঃ, এখন একদম পাল্টে গেছে।
মাঝে একটু বেচাল চলছিল। গত বছর-তো শিবপুরে-ও চান্স পেয়েছে। -"
--খুব ভাল, খুব ভাল। -"--------------মনে মনে দুজনে-ই অতীতের এক বিষন্ন স্মৃতিতে তলিয়ে যায়। দিতির কথা মনে হলে এখন-ও যেন স্বপ্ন মনে হয়।
কি ভাল-ই না ছিল। কত সহজে সবার সাথে মিশে যেতে পারত। বাড়ীতে এলে বাচ্চাগুলো পর্যন্ত ওকে ছাড়তে চাইত না। -----------------জান, অনেকের-ই গান শুনি কিন্তু দিতির মত অমন মিষ্টি, সুরেলা গলা যেন আমি আর শুনতে পাই না। ওর গাওয়া সেই গান গুলো শুনলে আজ-ও আমার
গায়ে যেন কাঁটা দিয়ে ওঠে।
আমার মনে হয় কি জান, ওর ভেতরে কোন চাপা ব্যাথা লুকিয়ে
ছিল, যা, ও কখন-ই প্রকাশ করেনি। হাসি, কথা আর গান দিয়ে সব আড়াল করে রেখেছিল। "--------------------হবে, হয়তো। -"
---সব চাইতে আশ্চর্যের বিষয় ছিল, ওর কথার জন্য
কখন-ও কোন বিষয়, কোন সময়, কোন বয়স, , কিছুই যেন লাগত না। ছেলে, বুড়ো, বাচ্চা সবার
সাথে-ই কেমন মজা করে কথা বলতে পারত।
আর ওর বরটা-ই হোল কিনা একটা হুলো-মুখো বেড়াল?--"
----------এমন-ই হয়। -"
( তিন )
অনেক ঘোরা-ঘুরির পর, আজ দুদিন হোল ওকে হাসপাতালে দিয়েছি। ডাক্তাররা যদিও তেমন ভরসা দিতে পারছেন না, তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখি । যে ভুল করে ফেলেছি তার প্রায়শ্চিত্ত-তো করতেই হবে।
দূর থেকে-ই দেখতে পাচ্ছি, দিতি জানালার দিকে মুখ করে, আকাশের দিকে আপন মনে তাকিয়ে আছে।
ইচ্ছে করেই ওদিকে ফিরে আছে। জানে আমি এদিকের দরজা দিয়ে-ই ওর কাছে যাব।
পেছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি, ও ফিরে-ও তাকায় না। কিছু সময় নিয়ে বলি,
-"দিতি, আমি এসেছি, তুমি টের পাওনি?-"
মুখে কোন কথা বলে না, শুধু ঘাড় নেড়ে বুঝিয়ে দেয় ওর টের পাওয়ার কথা।
-"এদিকে তাকাও, দেখ, তোমার সব কিছু ঠিক ঠিক মত এনেছি কিনা? আজ এগুলো নিয়ে এলাম, আবার কাল কিছু নিয়ে আসব।
কতদিন থাকতে হবে কে জানে? কি হোল? ঘোর, এদিকে ফের । -
ঘুরে বসে, নিচে তাকিয়ে, সব জিনিসগুলোর ওপর একবার হাত বোলায়-------------"কিছু খাবে? কোনটা খেতে ইচ্ছে করছে বল, আমি দিচ্ছি। -"
-"থাক, রেখে দাও। আয়া এলেই দেবে। -"
-"কেন? আমি দি-না, একটু খাও।
-"
রাস্তার ভীড়, জ্যাম সাত ঝামেলা কাটিয়ে আসতে দেরী হয়ে যায়। কাল রোববার, ছুটির দিন, আসতে অসুবিধা হবে না। তারপর বুধবারেও একটা কিসের যেন ছুটি আছে। ওদিন-ও আসতে পারব। পুরো অফিস করে এসে, বাড়ী ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে যায়।
দেখি তোমার সব পরীক্ষা-গুলো হয়ে যাক, তারপর ভাবছি, কিছুদিনের ছুটি নিয়ে নেব। না-হয় পারব না। ---------------স্বামীর দিকে উঁচুতে মুখটা তুলে বলে,
-"কি দরকার? আমাকে দেখার-তো এখানে অনেকে আছে। বাচ্চা দুটো সারাদিন বাড়িতে একা থাকে, তুমি বরং ওদের দেখো। -"
-"তুমি হাসপাতালে পড়ে আছ, আমি না এসে পারি?
এ তোমার অভিমান।
-"----------------এরা যে কেন, সব সময় এরকম অভিমান, অভিমান শব্দটা বলে শব্দটাকে
এতো হালকা করে দেয়, আমি বুঝিনা।
অভিমান? কিসের অভিমান? কার ওপর অভিমান? যেদিন থেকে তুমি আমার অভিভাবক
হয়েছ, সেদিন থেকে-ই আমি অভিমান বিসর্জ্জন দিয়েছি।
-"দেখি মুখ তোল, তাকাও, সময় হয়ে গেল, এবার আমার চলে যেতে হবে। -"--------ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, ভিজিটররা-ও একে একে সব বেরোতে শুরু করে। থমথমে মুখ, চোখ ভরা জল নিয়ে একবার তাকায়।
মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলি, -"নাও, শুয়ে পড়। শুইয়ে দেব? আবার কাল আসব কেমন। -"
( চার )
-"কি-গো বৌদি, বর চলে গেল বলে মন খারাপ করছ? আমিতো দূর থেকে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে
সব দেখছিলাম। কত আদর করল, কত খাবার নিয়ে এল। দাঁড়াও, মুখটা একটু পুঁছিয়ে দি।
নাও
এই বেদানা-টুকু আস্তে আস্তে চিবোও, দেখবে মুখে
কেমন স্বাদ হবে।
---------হাতে বেদানার বাটি দিয়ে, আয়া পেছনে দাঁড়িয়ে চুল বেঁধে দিতে দিতে ওর মনে ও গল্প করে চলে. আর, আমার মুখে একেকটা বেদানার দানা যেন ফোঁটা-ফোঁটা অশ্রূ হয়ে ঝরে
পড়ে। বিদ্যুতের গতিতে মন ছুটে চলে পেছন পানে। মনে পড়ে। শুধু মনে পড়ে।
কত কথা যে মনে পড়ে।
--------যেদিন আমি তোমার দিকে তাকিয়ে-ছিলাম, সেদিনতো আমায় দেখার তোমার সময় ছিল না।
কত ছলে, কৌশলে তোমার আশেপাশে ঘুরঘুর করেছি
যদি একবার-ও একটু কাছে ডাক-------তার-ও তোমার প্রয়োজন হয়নি। তারপর নিজেই কত আবোল-তাবোল বকে তোমাকে ছুঁয়েছি, তুমি বিরক্ত হয়েছ।
মনের দুঃখ মনে নিয়েই সরে গেছি।
কই? মনেতো পড়ে না, কখন-ও, কোনদিন-ও তুমি আমায় আজকের মত এমন ব্যাকুল হয়ে ডেকেছিলে বলে?
আজ আমার এই শুভ্র-শয্যা, আমার কত কাঙ্খিত
শয্যাকে-ও বুঝি-বা ম্লান করে দেয়। আমি-তো সব সময় তোমায় কাছে পেতেই চেয়েছিলাম, কিন্তু সে-তো এখানে--------------
এভাবে নয়। -------------কত দিন, কত কাল, কত বছর আমরা পেরিয়ে এলাম পাশাপাশি, কাছাকাছি।
শুধু নিঃশব্দে। নিঃশ্বাসের-ও কাছে, অথচ দূরে,-------
ব--------------হু দূরে----------------------
( পাঁচ )
ছোটর থেকেই আমি ভীষণ হাসি-খুশি থাকতে ভালবাসি।
যার জন্যে বন্ধু-মহলে আমার ভীষণ দাম। বাড়ীতে আমি ছাড়া সব ফাঁকা। আমার সর্বক্ষনের সঙ্গী একমাত্র গান। গান আমার প্রাণ। পাড়ায়,
নাটকে বিবেকের পাট আমার একেবারে বাঁধা ছিল।
সে একটা দিন গেছে, যখন দেওয়ালে পোস্টার পড়ত
---------একটা হাত এঁকে, নিচে আমার নাম--------------
সবার-ই আমার গান ভাল লাগত। আর আমিতো গান পাগল। ফাংশানে, সেই গান শুনেইতো তোমাদের আমায় পছন্দ হয়েছিল। গরিব ঘরের মেয়ে, তাই বয়সের ফারাকটা একটু বেশি হলেও,
দাবি না থাকায় সবাই এক কথায় রাজি হয়ে গেল। কন্যা-দায় থেকে মুক্তি পেল।
অল্প বয়স--------নতুন শাড়ী, নতুন গয়না, নতুন সংসার পেয়ে আমিও চনমন করে বেড়ে উঠেছি।
বিচিত্র জাঁতাকল এই সংসার। কবে, কখন যে আমায় একেবারে দলে-মলে ছিবড়ে করে ফেলল, জানতে-ও পারিনি। -----------সব সময় শুধু মনে হয়,
কি যেন আমি হারিয়ে ফেলেছি। কি যেন আমার
নেই,--------নেই।
ঠিক বুঝতে পারিনা।
প্রথম, প্রথম দু-বেলাই রেওয়াজ করতাম। তারপর হয়ে গেল একবেলা। তারপর আরও কম, আরও কম। কাজের ভয়ে গলা সাধা--------এসব শুনে, শুনে সে পাঠ চিরদিনের জন্য তুলেই দিলাম।
এখন শুধু নিজের জন্য নিজেই গান গাই। গান না গেয়ে যে আমি থাকতে পারি না।
----------তুমি নাকি গান ভালবাস? কই? কখনও,
কোনদিনও তো এমন কথা বলনি, -"একটা গান কর শুনি। -"-----------তাহলে যে কত খুশি হতাম। কাল-ও কত রাত পর্যন্ত ডাক্তার, নার্স, রোগীরা বসে আমার গান শুনল।
ওরা মুগ্ধ হয়ে শুনছে আর বলছে, -"আপনার কষ্ট হচ্ছে। -"
আমি বললাম, -"না, না আমার শরীরে এখন কোন কষ্ট-ই নেই, খুব আরাম বোধ করছি। -"
( ছয় )
আজ দিতি চোখের ওপর হাত ঢেকে শুয়ে আছে। ত্রস্ত পায়ে ছুটে গিয়ে, মাথায় হাত রেখে
বলি, -" কি হোল দিতি, শরীর বেশি খারাপ লাগছে?-
মাথা নাড়ে, বোঝাতে চায়, ------না------
-"তবে চোখ ঢেকে আছ কেন? হাত সরাও, দেখি,
মুখ দেখি,---------------বাঃ, এই তো, আজ বুঝি আয়া
তোমায় সাজিয়ে দিয়েছে? তোমায় দেখেতো আজ অসুস্থই মনে হচ্ছে না। ভাল, ভাল খাওয়ার এনেছি,
সব খাবে।
তাহলে দেখবে কদিনেই ভাল হয়ে যাবে। কদিন পরই-তো অপারেশন, না খেলে ধকল সামলাবে কি করে?----------কি হোল? কথা বলছ না কেন? তোমার বান্ধবীরা রোজ তোমার খবর নিতে আসে। আজও এসেছিল। সবাই শুধু বলে, তুমি না থাকায় নাকি তাদের আড্ডাই জমছে না। -"
-----পুরো চোখ কপালে তুলে, ওর গোটা মুখখানা দেখি, আর মনে মনে ভাবি,---এই-ই কি সে?
ওমনি ভেতরটা যেন পাগলের মত ফুঁসতে থাকে, ইচ্ছে হয় বলি,------------ওরা কি জানে? তোমার বাড়িতে কথা বলার কোন প্রয়োজন-ই ছিল না।
গান শোনার মত একটা মন-ও ছিল না। হাসার জন্য কোন খোরাক ছিল না। -------------যা ছিল জল, বায়ু,
অন্নের চেয়েও আমার কাছে বেশি। প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত যে অভাব আমায় কুরেকুরে খেয়েছে , তা
দেখারতো একটা চোখও ছিল না।
-"কি হোল দিতি, শরীর বেশি খারাপ লাগছে? কথা
বলছ না যে? উঠবে না? তোমার ইমন, অন্তরার
কথা কিছু জিজ্ঞেস করবে না?-"
-"জানি, ওরা তোমার কাছে ভালই আছে।
-"
-"আর আমি?-" একটু মুচকি হেসে আড়চোখে চেয়ে বলে, -"তুমি? তুমিতো স্বয়ং-সম্পূর্ণ। তোমার জীবনে আমিতো একটি বাড়তি সংযোজন মাত্র। -"
-"জানি, আমার ভুলের কোন ক্ষমা নেই। ওদের কি একদিন নিয়ে আসব?-" ঝটপটিয়ে ওঠে--------------------না, না ওদের এখানে এনো না, এনো না। -"
( সাত )
আজ আমায় পঙ্গু করে, অসুস্থ করে, কুরূপা করে, কেন? কেন বারবার ছুটে ছুটে আস? কি আছে? কি আছে আমার আর দেখার? যেদিন আমি দেখাতে চেয়েছিলাম, সেদিন দেখলেতো আজ আমার এই দশা হোত না।
প্রায় বছর-খানেক ধরেই বুকে একটা ফুসকুড়ি, ব্যাথা ব্যাথা করে। সব সময় শীত-শীতও করে। যে দেখে সেই বলে, চেহারা এত খারাপ হয়ে যাচ্ছে কেন?--------কই, তুমিতো এমন কথা মুখেও কখন-ও আনোনি। সবার চোখেই যা পড়ত, তোমার চোখে কি, কখনও-ই তা ধরা পড়েনি?
আমি বুঝতে পারতাম, ইদানিং তুমি ভয়ে বরং আগে যেটুকু-ও কথা বলতে, পরে তাও বলতে না। কিজানি, যদি আবার রোগের কথা কিছু শুনতে হয়?
যথা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চাইতে।
এ কাকে? কাকে তুমি এড়িয়ে চললে?-------------আমিও তোমায়
আর বিরক্ত করিনি। দাঁতে দাঁত খিচে বুকের কষ্ট
বুকেই ধরে রেখেছি। অবশেষে পাশের বাড়ির বৌদি যেদিন জোর করে তার ডাক্তার ভাইকে আমায় দেখাল, তারপর তোমায় সব বলল, সেদিন তুমি বুঝলে যে, এ আমার ভনিতা ছিল না।
---------------কেন? কেন, তুমি থাকতে আমায় পরমুখাপেক্ষী
হতে হোল? এ ব্যাথা আমার রোগ-যন্ত্রনা থেকেও অনেক, অনেক বেশি। আজ তুমি, আমায় নাম ধরে বারবার ডাক-------------বাকি সারা জীবন এভাবে ডেকে যাবে-------------দেব না, দেব না, আমি সাড়া দেব না।
এ আমার অভিমান নয়, এ আমার অহঙ্কার!
( আট )
------কি-গো বৌদি, আর কত ঘুমোবে? দাদা চলে গেল দেখি শুয়েই আছ। নাও ছানাটুকু খেয়ে নাও। শরীরে শক্তি হলেই দেখবে কেমন তরতর করে ভালো হয়ে যাবে।
-------তা তোমরা আমায় যতই বোঝাও না কেন, আমি জানি, আমি এখন-ই ভাল আছি। এরপর শুধু খারাপ-ই হয়ে যাব।
এতো আর নতুন কিছু নয়, অনেককে দেখেছি, যাকে ধরে একেবারে শেষ না করে যায় না। যাক ওসব বাজে কথা। এসো একটা গান শোন,-----------
শূন্য এ বুকে পাখী মোর ফিরে আয়,
ফিরে আয়-----------------
-"বৌদ, তোমার কি অপূর্ব গলা-গো। -"
-"আমরা তো খুব গরীব ছিলাম, কিন্তু শত অভাবের মধ্যেও আমার মা-বাবা, সেই ছোট থেকে আমায় গান শিখিয়েছিলেন। কোনদিন আমাদের বাড়ি গেলে দেখবে আমার গানের মেডেল, প্রাইজ, সার্টিফিকেটে বাড়ি ভর্তি।
আমার মা, সব যত্ন করে এখনও রেখে দিয়েছে। -"
-"তা বিয়ের পর আর শিখলে না কেন?-"
-"শিখেছি তো, শিখেছি। প্রথম দু, চার, ছ-মাস। ব্যাস, তারপর-ই সব বন্ধ হয়ে গেল। কি দরকার?
রাত পোহালেই, আ-আ করে সবার ঘুম ভাঙ্গাবার? তার চাইতে সকাল সকাল চা করে, গরম গরম চা মুখের সামনে পেলে, সবার মেজাজটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায় বল।
-"
-"আজ দেখবে, আমার এক ভাই আসবে আমায় দেখতে। -" বলতে না বলতেই তুহিন হাসতে হাসতে এগিয়ে আসে।
-"কি ব্যাপার? এ-যে দেখছি একেবারে ফলপট্টি বানিয়ে ফেলেছেন। কি? এত সেবা-যত্ন পেয়ে আর বাড়ি যেতে ইচ্ছে করছেনা নাকি?------------ব্যানার্জিদা,
পাঠিয়ে দিলেন। উনি এলে নাকি আপনি গুম মেরে বসে থাকেন? কোন কথাই বলেন না? সত্যি বৌদি, দাদা ভেতরে ভেতরে ভীষন কষ্ট পাচ্ছে।
-"
-"তাই? এতোদিন তো শুধু আমিই বলেছি, এবার তোমরাও কিছু বল আমি শুনি। -"
-"না, না বৌদি এ আপনার রাগের কথা--------"
-"আরে না না--------------------এ-তো রাগ নয়,
এ যেন আমার কিছু অনুরাগ,
আর কিছু অভিমান-----------------"
-"বাঃ শাব্বাস , এই না হলে আপনাকে মানায়? সময়তো হয়ে গেল, এবার যে আমায় যেতে হবে? দিনতো কটা আঙ্গুর খাই। রক্ত দেব আমরা আর আঙ্গুর খাবেন বসে বসে আপনি? এতো বেশ মজার কথা। হা-হা-হা। ফিরে গিয়ে বেশ বড় করে একটা ফিস্ট দেবেন কিন্তু------------------"
-"সেদিন কি আর আসবে রে ভাই?-"
কি দেখলাম? এ কি দেখলাম? বৌদিকে আমি একি দেখলাম? ভাল লাগে না, রোগী দেখতে হাসপাতালে আসতে আমার একদম ভাল লাগে না. চাকরী পেয়ে গ্রাম থেকে শহরে এসে, এই দাদা বৌদির কাছ থেকে সময়ে অসময়ে অনেক সাহায্য পেয়েছি।
বৌদিও আমার মধ্যে পেয়েছে তার হারিয়ে
যাওয়া ভাইকে। আমিও বাড়ির বাইরে বেরিয়ে-ও ঘর খুঁজে পাই। কদিন পর-পর না গেলেই, দাদা অফিসে ছুটে আসেন। তাই সপ্তাহান্তে বাড়ি যাওয়ার পথে একবার ঢুঁ মেরে যেতেই হয়। গেলেই বৌদি এটা-ওটা
দিয়ে বলবে, -"নাও, এবার খেতে খেতে গল্প কর।
--------খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে আমার বাড়ির খবর, অফিসের খবর, সব শোনা চাই। বৌদির একদিনের একটা কথা এখন আমার প্রায়-ই মনে হয়,-----------"তুহিন, যদি
কোনদিন কারুককে ভালবাস, তবে তাকে বিয়ে কোর। -----------আর যদি কারুককে বিয়ে কর, তবে তাকে একটু ভালবেসো। -" কিজানি, কার সুখ যে কোথায়, কিভাবে লুকিয়ে থাকে কেউ বলতে পারে না। -"
( নয় )
-------কোথায়? কোথায় ছিল হৃদয়ের এই টান? এতোদিন কোথায় ছিল? উনিশ, উনিশটা বছর শুধু মুখ বুজে সহ্য করেছি।
তাই আজ বুক ফুঁড়ে, বীভৎস, নগ্ন হয়ে এসেছে আমায় নিতে। আজ তোমার চিন্তা, ভাবনা, সেবা, যত্ন সব , সব বৃথা। আজ আর
এসবের কোন মূল্য নেই, কোন মূল্য নেই।
কতদিন এমন-ও তো গেছে, সকালে ঘুম থেকে উঠে
ভাত খেয়ে অফিস চলে গেছ। ফিরে এসে জল-খাবার খেয়েছ, টি।
ভি দেখেছ, পেপার পড়েছ আবার
সময়মত খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছ। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে, চব্বিশটা মিনিট-ও কি তোমার কাছে আমার প্রাপ্য
ছিল না?
জান না, জান না, তোমরা কিচ্ছু জান না। মেয়েরা
যে কত অল্পে সুখী হতে জানে, তা তোমরা জান না। --------------------শ্রেষ্ঠ রঙ্গ-মঞ্চ এই পৃথিবী। প্রতিদিন,
প্রতিনিয়ত আমরা সকলে সেই রঙ্গ-মঞ্চে একের পর এক অভিনয় করে চলেছি।
আগে মঞ্চে করেছি বিবেকের অভিনয়, পরে সংসারে করে গেলাম মূকাভিনয়। দুটোতেই আমি সফল। সম্পূর্ণ, সমান সফল। নিখুঁত অভিনয়। তোমরা কেউ বুঝতেই পারোনি।
-----------------------কতদিন কত কথা দিয়ে ব্যাথাকে ঢেকেছি,
-----------কত গান শুনিয়ে, কান্নাকে চেপেছি,
-----------শুধুই ঠোঁটে হাসি ফুটিয়ে, দুঃখকে ভুলেছি---
যা বয়ে যায়, তা চলেই যায়। আচ্ছা, আমি তো আগে এতো চিন্তাবাগীশ ছিলাম না? যতই দিন যাচ্ছে কেমন জানি সব বিষয়েই উল্টো-পাল্টা ভাবতে শুরু করছি। আসলে মুখ ফুটেতো কারুর কাছে কোনদিন মনের কথা বলা হয়নি, তাই মন-ই আজ মনের কাছে সব বলে যেতে চায়। --------------কেউ শুনবে না, কেউ বুঝবে না,------------এ আমার রক্ত ঝরানো ব্যাথা!----
( দশ )
সব পরীক্ষা-পত্র হয়ে গেল। কোন রিপোর্টেই কোন আশা নেই।
দেখা যাক ভাগ্য কোথায় নিয়ে ঠেকায়। প্রায় কুড়িদিন হয়ে গেল, ও এখানে আছে। আস্তে আস্তে আরও নির্জীব হয়ে যাচ্ছে। কোন কথাতো বলেই না, শুধু চেয়ে থাকে। আজ গিয়ে দেখি, বালিশের ওপর কুঁকড়ে, উপুড় হয়ে কুনকুন
করে কি একটা সুর ভাঁজছে।
আমি মাথায় হাত দিতেই, একটু কাত হয়ে, আধখানা চোখে হেসে তাকায়। বহুদিন পর ওর মুখে হাসি দেখলাম। মনে হোল জীবনে এমন-ও অনেক হাসি আছে, যা বুঝিবা কান্নার চেয়েও বেদনাদায়ক। জানতে চায়,
-"সব রিপোর্ট এসে গেছে?-"
-"হ্যাঁ, আজ-ই সব পেলাম। -"
-"ডাক্তারবাবু , কি বললেন দেখে?-" কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হতে একটু সময় লাগে, তাই একটা ছুতো ধরে বেরিয়ে যাই।
ফিরে এসে বলি,
-"হ্যাঁ, ডাক্তারবাবু তো বললেন, তেমন চিন্তার কিছু নেই। একটু যত্নে থাকলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাবছি, এবার তেজপুরে তোমার বড়দার বাড়ি থেকে তোমার মাকে এনে কিছুদিন এখানে রাখব। কারণ সামনের সপ্তাহেই হয়ত অপারেশন হবে। তখন কদিন আর বাড়ি যাব না, এখানে, মন্টুদের বাড়িতেই থেকে যাব।
মা, বাড়িতে থাকলে, ইমন, অন্তরা ওদেরও কোন কষ্ট হবে না। কি বল? ভাল হবে না? চুপটি করে, সব কথা মন দিয়ে শোনে। তারপর যেন চুপিচুপি করে আমায় বলে,------------"একবারটি ওদের আনবে?-"
-" কেন , আনব না? সে তুমি না বললেও, সামনের ছুটির দিন আমি ওদের আনতাম-ই----"
( এগার )
পাশেই অনাত্মীয়, ডাক্তার-কাকুর কোলে-পিঠে আমি মানুষ। তাই ডাক্তারদের পরিভাষা না বুঝলেও, ডাক্তারদের চোখের ভাষা আমি খুব ভালই বুঝি। আজ ডাক্তার-কাকু থাকলে কি আর আমার এই অবস্থা হোত? ছেলে-মেয়ে ছিল না, দুজনেই আমায় খুব ভালবাসতেন।
ভাল মানুষরা যে কেন এতো তাড়াতাড়ি চলে যায়?
-----------------------শেষবারের মত ডাক্তার খোরানাকে,
যেদিন তুমি আমায় দেখাতে নিয়ে গেলে, দক্ষ, অভিজ্ঞ ডাক্তার, উনি আমায় দেখলেন এক নিমেষ-----
--আর তোমার দিকে তাকিয়ে রইলান কয়েক পলক। ------তাঁর সেদিনের সেই তাকানোর ভাষা, আমাকে কারুর বলে বোঝাতে হয়নি।
বুঝলাম, ফুটো এ তরী, পাড়ে আর ভিড়বে না।
আমি বাইরে এসে, তোমার অপেক্ষায় বসে রইলাম। কিছুক্ষন পর, ডিসেম্বর মাসের শীতেও যখন তুমি, রুমাল দিয়ে চোখ-মুখ মুছতে মুছতে বেরিয়ে এলে, দেখে আমি নিশ্চিন্ত হলাম।
--------বেশ লাগে, তোমাদের মত আত্মকেন্দ্রিক, অধীনতাপরায়ন পুরুষদের এভাবে ভেঙ্গে পড়তে দেখলে, আমার বেশ লাগে। --------------------------
( বার )
পরদিন নির্দিষ্ট বেডের সামনে গিয়ে, থমকে দাঁড়িয়ে
থাকি। পাশের বেডের মহিলা, আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বলেন, -"আপনার স্ত্রীকে গতকাল থেকে কেবিনে দেওয়া হয়েছে। -" অনেকদিন ধরেই একটা কেবিনের চেষ্টা করছিলাম, ভালই হোল। ধীরেধীরে কেবিনের দিকে এগিয়ে যাই,--------দেখি যন্ত্রণা-কাতর মুখে দিতি এইটুকু হয়ে গুটিয়ে আছে।
মাথায় হাত বুলোতে বুলোতে কথা বলি,
-----"কাল থেকে দশ দিন ছুটি নিয়েছি, অফিসেও যাব না, বাড়িও যাব না। এখানে বেলেঘাটায় মন্টুদের বাড়িতেই থাকব। তোমার মা-ও এসে গেছেন।
চিন্তা কোর না। ইমন, অন্তরা ওনার কাছে ভালই আছে।
কাছেই এখানে থাকলে চার বেলাই তোমার কাছে আসা-যাওয়া করতে পারব। দুহাতে মুখ ঢেকে ডুকরে ডুকরে ওঠে। মাথাটা বুকের মাঝে চেপে ধরে বলি, -"ভয় কি, দিতি আমিতো আছি। -"
-"আমার এই প্রান-তো, আমি সঁপে ছিলাম
তোমারই হাতে---------------------------------------"
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।