কে জানে কখন কেটেছে তোমার স্বপ্নমুগ্ধ রাত,আজকে কঠিন ঝড়ের বাতাসে দ্বারে করে কশাঘাত
উইকিলিকস্ বোমা ফাটিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের নেতাদের মধ্যকার পারস্পরিক সম্পর্ক কত যে খারাপ এবং তাদের কথাবার্তা যে কত নীচকর তা এসব গোপন নথি থেকে বের হয়ে এসেছে। শত শত নয়, ক্যাবল মোট দুই লাখ পঞ্চাশ হাজারের বেশী আমেরিকান ডিপ্লোম্যাটিক ডকুমেন্ট প্রকাশ করেছে।
কেউই এগুলো অস্বীকার করছেন। বলছেও না যে, এসব আমরা বলি নাই অথবা করি নাই।
বরঞ্চ বলছে এতে করে আমাদের পারস্পরিক সম্পর্কের অবনতি হবে।
ওয়াইট হাউস বলছে “ইটস ডেঞ্জারাসএন্ড রেকলেস”। আমেরিকা সরাসরি উইকি বস জুলিয়ান এসেঞ্জকে বিচারের আওতায় আনার কথা ঘোষণা করেছে। অপরাধ হল, কেন সে এতসব তথ্য ফাঁস করে দিবে? ওসব একান্তই সিক্রেট ব্যাপার-স্যাপার। একটি লিখছে, কেন এখনো জুলিয়ান নিহত হয়নি (Why isn’t Julian Assange dead yet? টরন্টো সান, নভেম্বর ৩০), কিংবা উইকিলিক বস সময় ধার করে বেঁচে আছেন ইত্যাদি।
দুইদিন আগে আমেরিকা ভিত্তিক হোস্টিং কোম্পানী উইকিলিকের সাইটটি বন্ধ করে দিয়েছে। অন্য নামে সাইটটি চালু রয়েছে এখন। আমেরিকার এটর্নী জেনারেল বলেছেন, “জুলিয়ানের বিরুদ্ধে ক্রিমিনিলাইজেশনের তদন্ত চলছে। ” জুলিয়ান একরকম বৃটেনে আত্মগোপন করে এতদিন ছিলেন। একটি ধর্ষণ প্রচেষ্টা মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে স্পেনের আদালত গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করে রেখেছিল।
নিন্দুকেরা বলে আমেরিকার চাপেই বৃটেন তাঁকে আজ গ্রেফতার করেছে এবং জামিন না দিয়ে জেলে পুরেছে। সম্ভবত স্পেনে ফেরত পাঠানোও লাগতে পারে।
যদিও জুলিয়ান এই মামলাকে তাঁর বিরুদ্ধে বৃহৎ শক্তিদের ষড়যন্ত্র বলে অভিযোগ করেছেন। তাঁর নিজ দেশ হল অস্ট্রেলিয়া। এক সাক্ষাৎকারে তিনি লিখেছেন, তাঁর দেশে ফেরা অসম্ভব হয়ে পড়েছে প্রধানমন্ত্রী জুলিয়া গিলার্ড এবং এটর্ণী জেনারেল রবার্ট ম্যাকলিল্যান্ডের ভুমিকায়।
তাঁকে হত্যা করতে আমেরিকাকে সহযোগিতা করতে দুইজন সরাসরি কাজ করছেন বলে জুলিয়ান এসেঞ্জ অভিযোগ করছেন।
সে যাই হোক, ওসব গোপন নথিপত্র প্রকাশের ফলে আমেরিকার ডিপ্লোম্যাটিক কারসাজি সাধারণ মানূষজনের হাতে চলে এসছে। হিলারী ক্লিনটন এর দায় স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছেন সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর কাছে। আর প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন যারা এসব তথ্য ফাঁস করতে ব্যবহৃত হয়েছেন সেসব আমেরিকানদেরকে সাজা দেয়ার।
ইরান নেতা আহমেদিনেজাদ উইকিলিককে বলেছেন, ‘শয়তানের ষড়যন্ত্র (satanic conspiracy)।
’ বলেছেন, “প্রতিবেশীদের সাথে আমাদের চমৎকার সম্পর্ক রয়েছে। মুসলিম নেতাদের মধ্যে বিভক্তির বীজ বপন করতে আমেরিকার হীন পরিকল্পনারই এটা একটা অংশ। ” তূর্কী প্রধাণমন্ত্রী এরদোগান এগুলোকে ‘বাজে গপ্প’ আখ্যায়িত করে উড়িয়ে দিয়েছেন। তিনি আরো সাহসী মন্তব্য করে বলেছেন, "The unserious cables of American diplomats, formed from gossip, magazines, allegations and slander are spreading worldwide via the Internet,"
কি ছিল উইকি ক্যাবলে?
আমরা মধ্যপ্রাচ্য নিয়েই আজকে কথা বলতে পারি।
মধ্যপ্রাচ্যে দুটি মাত্র দেশে একটা সময় পর পর সরকার পরিবর্তন হয় ।
ইরান ও ইসরাইল। আর বাকী সব দেশেই নেতাদের মৃত্যু পর্যন্ত জনগনদের অপেক্ষা করতে হয়। অবশ্য লেবানন সরকারে মাঝে মাঝে এদিক সেদিক হয়। জিমি কার্টার বলেছেন, এ অঞ্চলের একমাত্র দেশ ইসরাইলে ১৫০ টি নিউক্লিয়ার অস্ত্র বিদ্যমান (টাইমস্, মে২৬, ২০০৮ )। আর বর্তমানে পশ্চিমা দেশসমূহ বলছে, ইরান চেষ্টা চালাচ্ছে নিউক্লিয়ার শক্তি অর্জন করতে।
যাহোক, মধ্যপ্রাচ্যের সব মুসলিম নেতাদের চোখে বর্তমানের একমাত্র সমস্যা হলো ইরান, কোনমতেই ইসরাইল নয়। আমেরিকাকে সবাই অভিন্ন সুরে জোড়ালো আবদার জানিয়েছে ইরানকে দ্রুত শায়েস্তা করতে। সৌদি আরব আমেরিকাকে বলছে ‘সাপের মাথা কেটে দাও’ (cut the head of snake)। কিং আব্দুল্লাহ বলছেন, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আমাদের সম্পর্ক পূনঃস্থাপিত হলেও আসল কথা হল, আমরা তাদেরকে বিশ্বাস করিনা। কাতারের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমরা তাদের সাথে মিথ্যা কথা বলি, তারাও আমাদের সাথে মিথ্যা কথা বলে (they lie to us, and we lie to them)।
মিশর নেতার দৃষ্টিতে মধ্যপ্রাচ্যে দুটি চ্যালেঞ্জ- ইরাকের স্থিতবস্থা অন্যটি ‘সর্বত্র’ই ইরানের বিস্তৃতি। প্রেসিডেন্ট হোসনী মোবারক তেহরানের সমঝোতার ব্যাপারে ওয়াশিংটনকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছেন এই বলে যে, তারা ‘বিগ, ফ্যাট লায়্যার’, ইরান এরকম করবেই কারণ, তারা মিথ্যাকে প্রতিষ্ঠিত করে বৃহত্তরউদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করতে চায়।
মিশরের এই জগদ্দল পাথর হোসনী মোবারক ইরাক আক্রমণ করতেও বুশকে উৎসাহিত করেছিলেন। বুশের স্মৃতিচারণমূলক বই ‘ডিসিশন পয়েন্ট’ এ অনেক কথা লিখেছেন। আরব নেতারা কিভাবে তাকে প্ররোচিত করেছেন তা তিনি অকপটে জানিয়েছেন।
বুশ লিখেছেন, “President Hosni Mobarak of Egypt had told (general) Tommy Franks that Iraq had biological weapons and was certain to use them on our troops (অর্থাৎ মিশরের হোসনী মোবারক জেনারেল টমি ফ্রাংকে জানিয়েছেন, ইরাকে বায়োলজিক্যাল মারণাস্ত্র রয়েছে। আর সেগুলো নিশ্চিতভাবেই আমেরিকান সৈন্যদের মারতে ব্যবহৃত হবে)। ” যদি কথাটি সত্যই হয়, তাহলে মোবারক এ অভিযোগটিকেন প্রকাশ্য জনসমুক্ষে তোলেননি? বিপরীতভাবে বলতে গেলে, কেন তিনি সাদ্দামের সাথে ভাব বজায় রেখে চলতেন? বুশ তার কারণ জানিয়েছেন এভাবে, আরবের রাস্তায় তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হবে বলে “Mubarak refused to make allegation in public for fear of inciting the Arab street”
সৌদি এম্ব্যাসাডরও ইরাক আক্রমণে গুরুত্বপূর্ণভুমিকা রেখেছেন। বুশ ওই বইয়ে লিখেছেন, “Prince Bandar of Saudi Arabia, the kingdom’s longtime ambassador to Washington and a friend of mine since dad’s presidency, came to the Oval Office and told me our allies in the Middle East wanted a decision (অর্থাৎ ওয়াশিংটনে সৌদি আরবের রাস্ট্রদূত প্রিন্স বান্দর যিনি আমার পিতার শাসন আমল থেকেই আমার বন্ধু তিনি ওভাল অফিসে এসে আমাকে বললেন, আমাদের মধ্যপ্রাচ্যের মিত্র দেশসমূহ ‘সিদ্ধান্ত’ চায়)। ”
যাহোক, আবার উইকিলিকে ফিরে আসি।
টরন্টো স্টার (নভেম্বর৩০) মন্তব্য করেছে, রোববার (নভেম্বর২৮) দিনটি ছিল খুব সম্ভবত লেবানীজ প্রধানমন্ত্রীর সবচেয়ে খারাপ দিন। কারণ এদিনই তিনি ইরানে তাঁর প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর “ইরানের প্রতি লেবাননের সর্বাত্মক সমর্থন থাকবে” বলে সমাপ্তি টানছেন। আর এইদিনই কিনা নিউ ইয়র্ক টাইমস তাঁর ভিলেনের অভিনয়টা প্রকাশ করেছে। ক্যাবলের মাধ্যমে ২০০৬ সালে সা’দ হারিরীর সাথে ইউএস ডিপ্লোম্যাটের কথোপকথনের উদ্দৃতি দিয়ে টাইমস্ লিখেছে, সা’দ হারিরী (তখন তিনি পার্লামেন্টে সুন্নী মেজরিটি গ্রুপের নেতা ছিলেন) আমেরিকাকে জানিয়েছেন, দ্যা ইউএস “এটাক অন ইরাক আননেসিসারি” ওয়াইল এন এটাক অন “ইরান ইজ নেসিসারি” (অর্থাৎ ইরাকের উপর আমেরিকার আক্রমণ অপ্রয়োজনীয় ছিল অথচ ইরান আক্রমণ জরুরী)। উইকিলিকের শত শত ডকুমেন্ট প্রমাণ করেছে এসব নেতাদের পাবলিক কথার সাথে প্রাইভেট কথার কোনই মিল নেই।
ইসরাইল-প্যালেস্টাইন কনফ্লিক্টের চেয়ে তাঁদের কাছে ইরানই বড় সমস্যা। ইউএস সেন্ট্রাল কম্যান্ডার জেনারেল জন আবিজিয়াদের সাথে মিটিং-এ আরব আমিরাতের মিলিটারী কম্যান্ডাররা ইরানের নেতা মাহমুদ আহমেদিনেজাদকে, ‘এগ্রেসিভ’ ‘ক্রেজি’ বলেছেন। আবুধাবির যুবরাজ প্রিন্স মুহাম্মদ বিন যায়েদ আমেরিকার নিকট দাবী জানিয়েছেন, “ট্যাক একশন এগেইন্সট ইরান উইথিন এ ইয়্যার এট মোস্ট(সর্বোচ্চএক বছরের মধ্যে ইরানের বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাও)। ” চীফ অব স্টাফ জেনারেল মাইকেল মোসলিকে বিন যায়েদ বলেছেন, ইরানকে কখনোই নিউক্লিয়্যার প্রোগ্রামের অনুমতি দেয়া যায়না। এই লোকটি আমদেরকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
বাহরাইনের রাজা হামিদ বিন ইসাও সবার সাথে যোগ দিয়েছেন। তিনি আমেরিকানদের বলেছেন, the danger of letting it go on is greater than the danger of stopping it (এটাকে এভাবে ছেড়ে দিলে বিপদ বাড়বে। তারচেয়ে ওদেরকে এটা অর্থাৎ নিউক্লিয়্যার প্রোগ্রাম বন্ধ করাতে হবে)। ”
গোপন ইউএস ডিপ্লোম্যাটিক ক্যাবল আরো জানিয়েছে, সৌদির দৃষ্টিতে ইয়েমেন একটা ব্যর্থ রাষ্ট্র। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আব্দুল্লাহ সালেহ একজন অথর্ব যার কোনই নিয়ন্ত্রণ নাই দেশের উপর।
লিবিয়ান লিডার গাদ্দাফী পানিপথে চলাফেরা করতে ভয় পান, স্থলপথে ভ্রমণ করতেই তিনি পছন্দ করেন। গাদ্দাফী তার ইউক্রেনিয়ান নার্স ছাড়া চলাচল করেন না। উইকিলিক প্রকাশ করেছে, পাকিস্তান প্রধাণ আসিফ আলী জারদারী আমেরিকার কাছে নালিশ করেছেন, যে কোন সময় তাঁর আইএসআই প্রধান পাশা এবং সেনাপ্রধান কিয়ানী মিলে ক্ষমতা কেড়ে নিতে পারেন। বাংলাদেশ বিষয়েও উইকিলিক ২১৮২টি নথি প্রকাশ করেছে। ইসলামাবাদের আমেরিকান এম্বেসি থেকে ধারনা দেয়া হয়েছে বাংলাদেশে লস্কর-ই-তৈয়বার আস্তানা থাকতে পারে বলে।
প্যারিসের দূতাবাস জানিয়েছে, আলজেরিয়া, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও মরক্কো থেকে আসা কমপক্ষে ২০ জন ইমামকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বা এতে মদদ দেওয়ার অভিযোগে ২০০৬ সালে ফ্রান্স থেকে বহিষ্কারের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
উইকিলিক প্রাচ্য, প্রতীচ্য, পাশ্চাত্যের প্রায় সব দেশ নিয়েই ইউএস ডিপ্লোম্যাটিক ক্যাবলেরবিশ্বজোড়াকারসাজি উন্মোচন করে দিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে একমাত্র দেশ ইসরাইল নিরাপদ অবস্থানে। উইকিলিক চীফ জুলিয়ান এসেঞ্জ প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনভাবেই ইসরাইলকে রাগাতে চাননি। ইসরাইলের প্রধাণমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু বলেছেন, “ইসরাইল হ্যাজ নট বিন ড্যামাজ্ড এট অল বাই দ্যা উইকিলিক পাবলিকেশন্স।
” তিনি বলেছেন, “এই অঞ্চলে গত ৬০ বছর ধরে প্রপাগান্ডা চলছে ইসরাইল এই অঞ্চলের সবচেয়ে বড় হুমকি, কিন্তু আরব নেতাদের এই প্রথম উপলব্ধি তে এসেছে আমরা নয়, ইরানই একমাত্র হুমকি। ”
উইকিলিকের উদ্দেশ্য যাই হোক না কেন ওসব তথ্য প্রকাশের মধ্যদিয়ে মানুষজন জানতে পেরেছে মধ্যপ্রাচ্যের নেতারা কতটা মেরুদন্ডহীন। আরো পরিষ্কারভাবে বলা যায়, সারা দুনিয়ার প্রায় এক বিলিয়ন মুসলিম জাতি ও বিশ্বের সিংহভাগ সম্পদ এসব অযোগ্য ও ঘরের শত্রু বিভীষণ নেতাদের হাতেই জিম্মি। যাদের না আছে না সাহস, না আছে দুনিয়ার জ্ঞান আর নাই বা আছে কোন ধর্মের প্রতিই দৃঢ বিশ্বাস। এসব পদলেহী নেতাদের হাত থেকে মুসলিম বিশ্ব কবে মুক্তি পাবে?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।