বাংলা গানের ‘পঞ্চপ্রদীপ’-অভিহিত দলে থাকলে একের সঙ্গে অন্যের অর্থহীন তুলনা চলতে থাকে- আম ভাল না জাম ভাল, তালগাছ মহৎ না বটগাছ মহৎ। এর ফলে কোনো কোনো রথী-মহারথীও ভুল রায় দিয়ে থাকেন। যেমন সঙ্গীততাত্ত্বিক ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, রাজ্যেশ্বর মিত্র প্রমুখ সমকালীন পত্রপত্রিকায় নজরুলকে দ্বিজেন্দ্র-রজনী-অতুলের সমমর্যাদা দেননি এবং এই না-দেয়াটা তাঁদের গ্রন্থাবলিতেও অন্তর্ভুক্ত করে গেছেন। প্রথমত রবীন্দ্রনাথই তো ছিলেন না ‘পঞ্চপ্রদীপ’-এর অন্যতম। কারণ তাঁকে পাঁচজনের একজন ভাবাই পাপ।
তিনি ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন বাংলা গানের ‘প্রথম লণ্ঠন’টি হয়ে- সঠিক পথ দেখানোর লাইটহাউস, বাতিঘর, আলোকস্তম্ভ।
পাঁচের ভেতরে এক ছিলেন না নজরুলও। বরং তিনি ছিলেন একের ভেতরে পাঁচ। সেদিক থেকে কাজী নজরুল ইসলামও পঞ্চপ্রদীপের অন্যতম প্রদীপ কখনোই ছিলেন না, বরং লণ্ঠনও ছিলেন না- তিনি ছিলেন ঝাড়লণ্ঠন, শ্যান্ডেলিয়ার। প্রকৃতপক্ষে সঙ্গীতশিল্পী নজরুল ছিলেন জনতার মিছিলে- গান লিখতেন মজলিশে বসে, সুর করতেন রিহার্সেলরুমের কোলাহলে, গান গাইতেন ঘরোয়া জলসায়, কলকারখানায়, জনসভায়, গণমিছিলে।
আসলে পণ্ডিতগণের হেলাফেলা থেকে বাঁচাতে হলে জনগণের নজরুলকে পাণ্ডিত্যের মেলা থেকে বের করে ফেলা প্রয়োজন। অপরিহার্য সে-কাজটা অবশ্য মহাকালই করে ফেলেছে, সময়ের যথাপরিসরে- নজরুলকে বসিয়ে দিয়েছে রবীন্দ্রনাথের পাশে, বাংলাগানের খাসমহলে। এঁরা যেন সঙ্গীতসাম্রাজ্যের রাজা-উজির। বাকিদের বসিয়েছে আমমহলে। তাঁরা যেন রাজদরবারের আমির-ওমরাহ।
দেখা যাচ্ছে যে, বাংলা গানের ভুবনে ‘পঞ্চপ্রদীপে’র বহুল আলোচিত আসরটি বেশিদিন টিকিয়ে রাখা যায়নি। তাই আজ কেবল প্রথম এবং শেষ প্রদীপকেই প্রজ্বলন্ত দেখা যায় গানের আসরে, জয়ন্তীর উৎসবে। বাংলাদেশে বাকি তিন ‘প্রদীপ’-এর গানকে বলা হয় ‘তিন কবি’র গান, যদিও তাঁরাও মহান।
এখানে কথা হচ্ছে নজরুলসংগীত নিয়ে। তাঁর গান বহুশাখী, যার প্রতিটি শাখাকেই মহত্তম ভাবা যেতে পারে- গণজাগরণী, গজলধর্মী, হিন্দুয়ানী ভক্তিমূলক, মুসলমানী ভক্তিমূলক, ধ্রুপদী আধুনিক, রাগসুররঞ্জিত লোকসংগীত, এবং রাগপ্রধানসংগীত।
ভাবের, শব্দের, সুরের, ছন্দের, মেজাজের, পরিবেশের বহুমাত্রিকতায় বাংলার সংগীতভুবনে নজরুল একাই স্বয়ম্ভর এক সংগীতসভা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।