আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কোপেনহেগেনের পথেই কানকুন!

গণমাধ্যমকর্মী, চেয়ারম্যান - উন্নয়নের জন্য প্রচারাভিযান, সদস্য সচিব - সম্মিলিত জলাধার রক্ষা আন্দোলন।

কোপেনহেগেনের পথেই কানকুন! জলবায়ু উদ্বাস্তুতা : হুমকির মুখে বাংলাদেশ কোপেনহেগেনের পথেই কানকুন! মেক্সিকোর কানকুনে গত ১ ডিসেম্বর থেকে শুরু হওয়া বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন চলবে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত। অতীতের যে কোন সম্মেলনের চাইতে বর্তমান সম্মেলনটি বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয় এখন শুধু তৃতীয় বিশ্বের জন্যই হুমকির কারণ নয়, তার প্রভাব থেকে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোও মুক্ত নয়। জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে সৃষ্ট উদ্বাস্তুদের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলছে; বাংলাদেশেই বর্তমানে ৩ কোটি জলবায়ু উদ্বাস্তু পূণর্বাসনের অপেক্ষায় মানবেতর জীবন যাপন করছে।

‘জলবায়ু উদ্বাস্তুতা’ নিয়ে বিশ্বময় সচেতনা ও দ্রুত দীর্ঘমেয়াদী পূণর্বাসনকল্পে কাজও শুরু হয়েছে বিভিন্ন স্তর থেকে। বিশ্ব পরিবেশের বর্তমান পরিস্থিতি : সম্ভাব্য উদ্বাস্তুতা হিমালয় পর্বতমালার বরফ গলছে অনেক দ্রুতলয়ে। জীবনের উৎস পানি, আবার পানি গড়িয়ে গড়িয়ে যায় মানুষের কাছে। কিন্তু বিভিন্নভাবে অবরুদ্ধ হয়ে এই জীবন সঞ্জিবনী পানিই কেড়ে নিচ্ছে অগণিত প্রাণ। তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে মানুষ, পরিণত করছে নিঃস্ব অসহায় উদ্বাস্তুতে।

১৯৯০ সালে ওহঃবৎ-এড়াবৎসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধহমব (ওচঈঈ) জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বড় প্রতিঘাত হিসেবে চিহ্নিত করেছে মানুষের অভিাসনকে। এটাও সত্য যে এ ব্যাপারটি কোনো জলবায়ু সম্মেলনেই ঠিকমতো তোলা হয়নি আলোচনার জন্য। আর এগুলো প্রমাণ করে আমরা বিষয়টি নিয়ে কতটা চিন্তিত। মানুষ মরলে রাজনীতির কোনো ক্ষতি হয় না বলেই আপাত মনে হয়, বড়জোর হাত বদল হয় শাসকগোষ্ঠীর। ১৯৯০ এর প্রতিবেদনে বলা হয় যে পৃথিবীব্যাপী উদ্বাস্তু অভিবাসনের সংখ্যা প্রায় ২৫ মিলিয়ন বা আড়াই কোটি।

আশ্চর্য লাগে তবুও উন্নত দেশগুলোর কোনো মাথাব্যথা নেই। থাকবেই বা কেন? ৪০-এর দশকে দক্ষিণ এশিয়ার দুর্ভিক্ষে শুধু বাংলায়ই ৬০ লাখ মানুষের প্রাণহানী হয়েছে। কিন্তু এটার কোনো সুবিচার হয়নি। অভিজ্ঞতার আলোকে প্রাক্তন ঔপনিবেশিক জলবায়ু দুর্বৃত্তরা কোটি কোটি মানুষের মৃত্যুর প্রহর গুণছে। সাহায্য-ত্রাণ নিয়ে এসে টিস্যু পেপার দিয়ে চোখ মোছার অভিনয় করে দুঃখ প্রকাশ করবে।

আমরাও হয়তোবা আর কিছু বলব না। ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি ৪০ জনের একজন জলবায়ু উদ্বস্তুতে রূপান্তরিত হবে। পৃথিবীতে বর্তমানে সমগ্র জনসংখ্যার ৩% উদ্বাস্তু যা এই নতুন ধরনের উদ্বাস্তুর সংখ্যার তুলনায় খুবই কম। ১০০ কোটি সম্ভাব্য জলবায়ু উদ্বাস্তুর তুলনায় বর্তমান প্রায় ২০ কোটি উদ্বাস্তু খুবই নগণ্য। কিছু অসুস্থ রাজনৈতিক-অর্থনীতির বেড়াজালে বৈশ্বিক পরিবেশ অবরুদ্ধ।

ধীরে ধীরে এখন তা সারা বিশ্বদেহে সংক্রমিত হচ্ছে, মানুষের মাত্রাতিরিক্ত চাহিদা আজ মানুষকে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন করে দিয়েছে। সমগ্র পৃথিবীর ৯৭.৭ ভাগ পানি লবণাক্ত আর ২.৩ ভাগ পানি সুপেয় যা মেঘমালা সৃষ্টির মাধ্যমে পাহাড়ের চূড়ায়, ভূগর্ভস্থ ও নদী-নালা-খাল-বিলে পৌঁছে যাচ্ছে। প্রকৃতির কল্যাণের বাতাস ও আবহাওয়ার মাধ্যমে, কী আর্শ্চজনক পদ্ধতিতে প্রকৃতি লবণাক্ত সমুদ্রেও পানিকে আলাদা করে সুপেয় পানি পৌঁছে দেয় আমাদের ঘরবাড়ি, গ্রামগঞ্জ, নগর-বন্দরে। আমরা উন্নয়নের চাহিদার লক্ষ্যমাত্রা নিরূপণ না করে উন্নয়ন করছি। এর ভিতর ঢুকে গেছে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ও পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কার্যক্রম।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা হচ্ছে বিস্তর কিন্তু প্রতি ২০ মিনিটে কোনো না কোনো প্রজাতি পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। বছরে প্রায় ১% বা সর্বমোট ১০ কোটি ভিন্ন প্রজাতির মধ্যে ১০.০০০ থেকে ১০০,০০০ প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে ১৭,২৯১টি প্রজাতি মারাত্মক হুমকির মুখে। প্রকৃতিতে মানুষের মঙ্গলের জন্য নিয়োজিত তাবৎ প্রাণিকূলের মধ্যে ২১% স্তন্যপায়ী, ৩০% উভয়চর প্রাণী, ১২% পাখি, ২৮% সরীসৃপ ৩৭% মিঠা পানির মাছ, ৭০% উদ্ভিদ ও ৩৫% মেরুদন্ডি প্রাণী হুমকির মুখে নিপতিত। প্রকৃতির সমগ্র পৃথিবীর ৭০% জলে আবৃত করে আমাদের বসবাসের ভূখন্ডকে বানিয়েছে অপরূপ সুন্দর দ্বীপ।

যার নিঃসীম গহ্বরে লুকিয়ে রেখেছে তাবৎ জীবিত পদার্থের ৯০%। আমরা তার দূষণের ৮০% করি ভূপৃষ্ঠে সংঘটিত অপকর্ম দ্বারা। আমাদের অপকর্ম সারা পৃথিবীতে ১৫০টি অক্সিজেন শূন্য এলাকা সৃষ্টি করেছে, যা ছিল প্রকৃতির নেয়ামতে পরিপূর্ণ। প্রতিবছর আমাদের অসতর্কতার কারণে ২ কোটি ব্যারেলের বেশি তেল নিক্ষিপ্ত হয় সাগর-মহাসাগরে। বৈশ্বিক জলবায়ু অপরাধীরা আমাদের মতো দরিদ্র রাষ্ট্রের উপকূলীয় জলসীমায় ১০০০ কোটি টন ভারি দূষিত পানি নিক্ষেপ করে যাতে, ক্ষতি হয় ব্যাপক জান-মালের।

সৃষ্টি হয় জলবায়ু বা পরিবেশগত উদ্বাস্তুতা। আজ সমগ্র পৃথিবীতে সর্বোচ্চ পর্বত চূড়াগুলো বরফশূন্য হতে বসেছে। যার উপর নির্ভর করে সমগ্র পৃথিবীর কৃষি ব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তা, অথচ আমরা বুঝতেও পারিনি কখন কার্বন বিষ দ্বারা উত্তাপ ছড়িয়ে সব গলিযে দিয়েছি। বন্যা প্লাবন মহামারীতে পৃথিবী ক্রমাগত লন্ডভন্ড। ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে তান্ডবলীলা।

বিগত ১৫০ বছরে পৃথিবীতে বিজ্ঞানীরা ঝুঝতে পেরেছেন যে পৃথিবীর সর্বোচ্চ উষ্ণ ১২টি বছরের ১০টিই বিগত ১৫ বছরে হয়েছে। অদূর ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছু অপেক্ষা করছে, যেখানে প্রতি ১৫/২০ বছরে একটি বড় ধরনের নিম্নচাপের উৎপত্তি হতো বঙ্গোপসাগরে আর এখন তা হয় ৪/৫ বছরের ব্যবধানে। কারণ বিগত ১৮ বছরে পৃথিবীতে যে বন উজার হয়েছে তার পরিমাণ ন্যূনতম ১৫টি বাংলাদেশের সমান। প্রকৃতিতে প্রতিবছর ছড়িয়ে দিচ্ছি ২৫ কেজি ওজনের ৪০০ কোটি বস্তা কার্বন। ৪ তলা উচ্চতার বাঁধ নির্মাণ করেছি ৪৫ হাজারেরও ওপর।

আমাদের ধ্বংস আমরাই ডেকে এনেছি। প্রকৃতির সৃষ্টি ধ্বংস করার কারণে আমরা আমাদের জন্য কল্যাণকর বৃষ্টি হতেও বঞ্চিত হচ্ছি। ’৯২ সালে সবাই সবারই কাছে প্রতিজ্ঞা করেছি বন উজার রোধ করব। চুক্তির পর আমরা নিজেরাই নিজেদেরকে ঠকিয়েছি গত ১৮ বছর। বিশ্বের নেতারা প্রতিজ্ঞা করেও আমাদের জন্য করা প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছে।

ওরা জানে কার্বন উৎপাদনকারী অপরাধী ব্যবসায়ীদৈর স্বার্থই তারা রক্ষা করছেন। ওরা জানে কার্বণ নিগর্মন এভাবে নিযন্ত্রণ না হলেও পৃথিবীর ২০০ কোটি মানুষ মরে গেলেও তা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই কমে যাবে। সুতরাং এই চক্রান্ত সফল হতে দেয়া যাবে না। সবাইকে অধিকতর সতর্ক হতে হবে। জোর দাবি তুলতে হবে প্রতিটি সচেতন নাগরিকের।

সফল ও শক্তিশালী জলবায়ু কূটনীতিই পারে এ সমস্যা মোকাবিলায় আমাদের পাথেয় হতে। পরিবেশ বিপর্যয়, অর্থনৈতিক ধ্বংস রাজনৈতিক অবক্ষয় একই সূত্রে গাঁথা ৩টি জলবায়ু চালক। এর একটি আরেকটিকে পরিচালিত করে জলবায়ু পরিবর্তন জনিত সমস্যা তীব্রতর করণে জোরদার ভূমিকা রাখছে প্রতিনিয়ত? প্রতিবছর মেক্সিকোর সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন করে প্রায় ১০ লাখ মানুষ, যাদের বেশির ভাগই পরিবেশগত কোনো না কোনো বিপর্যয়কে কেন্দ্র করে। রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকুক বা না থাকুক উদ্বাস্তুরা রাস্তা বের করে নিচ্ছেই। পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত যেখানে ধারণা করা যায় ১৫ কোটি মানুষ জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে যাবে, সেখানে তার পার্শ্ববর্তী দেশ বাংলাদেশে এই সংখ্যা হবে প্রায় ৩ কোটি।

কে কোথায় যাবে? যুদ্ধ অনিবার্য, প্রতিপক্ষ জলবায়ু উদ্বাস্তুরা। এখনই ব্যবস্থা না নিলে অত্র এলাকায় চরম নিরাপত্তা সমস্যা দেখা দিবে খুব শিগগিরই। ভারত ও বাংলাদেশের উচিত যৌথ দরকষাকষি চালানো; যাতে এর একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান বের করা যায়। প্রেক্ষাপট : বাংলাদেশের জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিস্থিতি ১৯৭৪ সালের ঢাকার জনসংখ্যার বিপরীতে বর্তমান জনসংখ্যা অবিশ্বাস্য রকমের বেশি। যেখানে ১৭৭,০০০ এর বিপরীতে ১ কোটি ৩০ লাখ।

স্বাভাবিক বৃদ্ধির হিসেবে যদি ধরি তাহলে জনসংখ্যা বৃদ্ধির পরিমাণ দ্বিগুণ হয় ৩২-৪০ বছরে কিন্তু বিগত ৩৬ বছরের এই বৃদ্ধি ৬৫ গুণ, যা আমাদের চরম অব্যবস্থাপনা ও উদাসীনতাকে প্রমাণ করে। আজঢাকার উদ্বাস্তু জনসংখ্যার পরিমাণ ৪০ লাখ। নোবেল পুরষ্কার পাওয়া ওহঃবৎ এড়াবৎহসবহঃধষ চধহবষ ড়হ ঈষরসধঃব ঈযধমব (ওচঈঈ) বলছে ২০৫০ সাল নাগাদ শুধুমাত্র সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও ক্রমবর্ধমান প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ২ কোটি মানুষ বাস্তুচ্যুত হবে সারা বাংলাদেশে। ধারণা করা যায় ঢাকা ২০২০ সাল নাগাদ ২ কোটি জনসংখ্যার মাত্রা অতিক্রম করে ফেলবে। শুধুমাত্র সাইকোন সিডরের পরই ঢাকার জনসংখ্যা স্থায়ীভাবে ১০ লাখ বেড়ে গেছে।

আর মৌসুমি উদ্বাস্তু আরো ১০ লাখ। বাংলাদেশের এই দুর্বিষহ সমস্যার কথা অনেক মিডিয়াতে স্থান পেতে শুরু করেছে সিডর-এর পর থেকে কার্বন নিঃসরণ রোধের আলোচনা বাংলাদেশের জন্য যদি কোনো দিন সুফল বয়ে আনেও তা ২০৫০ সাল নাগাদ অপেক্ষা ছাড়া হবে না। আর ক্ষতি পূরণের টাকা দিয়ে এদের কোনো পুনর্বাসন হবে না এটা প্রায় নিশ্চত করে বলা যায়। একটু গভীরভাবে ভেবে দেখতে হবে আমাদেরকে এই আলোচনায় যারা বেশি বেশি জড়াচ্ছেন তারা কিন্তু ঘৃণাক্ষরেও বলছেন না কিছু জলবায়ু উদ্বাস্তু বিষয়ে। যা বলছেন তা বেশি মাত্রায় প্রাথমিক পর্যায়ের।

একজন বৈশ্বিক মানসিকতার মানুষ মাত্রেই বলবেন, রাজনৈতিক ভেদাভেদের চাইতে এত বড় সন্ত্রাস আর এই মুহূর্তে পৃথিবীতে নেই। ১৭৭০ সালের দুর্ভিক্ষে (ছিয়াত্তরের মনন্তর) ১.৫ কোটি মানুষের মৃত্যু, ১৯৪৩-এ ৬০ লাখ মানুষের প্রাণহানী, ’৭০-এর প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে মিলিয়ন মানুষের অনাকাক্সিত মৃত্যুবরণ, ’৯১ এর ২৯ এপ্রিল, ২০০৭-এর সিডর বা পরবর্তী আইলার আঘাতেও মৃত্যুর ঘটনা নিতান্তই প্রাকৃতিক কারণে সংঘঠিত বলে চালিয়ে দেয়া নেহায়েত কোনো স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে বৈশ্বিক স্বাক্ষরের পর বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো কার্বনের মাত্র ৯০-এর মাত্রাকে প্রমাণ ধরে কমানোর অঙ্গীকার করেও অঙ্গীকার খর্ব করে এখন নতুন অঙ্গীকার করেছে। মোটের ওপর শতকরা হারে করা অঙ্গীকার প্রমাণ করে যে বিশ্ব জলবায়ু দৈত্যরা মানুষ মারার বৈশ্বিক অস্ত্র আবিষ্কার করে ফেলেছে। যদি পরবর্তী এক দশকে কোনো পর্যাপ্ত ব্যবস্থা পৃথিবী নিতে পারে তাহলে আর পারমাণবিক অস্ত্রের প্রয়োজন হবে না যুদ্ধবাজদের।

প্রকৃতিই আমাদের সকলকে অক্ষশক্তির কাতারে দাঁড় করিয়ে কেড়ে নেবে প্রয়োজনীয় প্রাণ। মানুষের সংখ্যা কমলে কলকারখানা এমনিতেই কমে যাবে তখন আর কার্বন কমানোর জন্য ধরনা দিতে হবে না। অগণিত মানুষের অপমৃত্যুই কি হতে যাচ্ছে সর্বশেষ জলবায়ু কূটনৈতিক প্রচেষ্টা? একটি প্রামাণ্য চিত্র ও বন্ধ দরজায় কষাঘাত পৃথিবীর অনেক সমস্যা গুরুত্বহীন হযে পড়ে আছে বছরের পর বছর। নিভৃতে জন্ম নিয়ে কৌশোরে পা দিয়েছে একটি সমস্যা, আর তা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুতা। সেটি অনুধাবিত হয়েছে, কিন্তু গুরুত্ব পায়নি দীর্ঘদিন।

কারণও অনুমেয়, উন্নত দেশগুলো জলবায়ুর ক্ষতিপূরণ দিতে চায় বিনিময়ে। চায় ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো জলবায়ু উদ্বাস্তুদের নিজের দেশেই পুনবৃাসন করুক। এর পেছনে একটি ধারণাও ক্রিয়াশীল, তা হচ্ছে উন্নত দেশগুলো মনে করে যে শহুরে শিক্ষিত ও রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাধর ব্যক্তিরা সুযোগ পেলে জলবায়ু উদ্বাস্তু হয়ে পাড়ি জমাবে সুবিধাজনক জায়গায়। ফলশ্রুতিতে সত্যিকারের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের গতির ব্যবস্থাটা ঝুলেই থাকবে। ২০০৯ এ নির্মিত হলিউডের কাইমেট রিফিউজি ছবিটি এই লুকোচুরির ব্যাপারটিকে খুবই কঠিন করে দিয়েছে।

ছবিটিতে বাংলাদেশসহ পৃথিবীর জলবায়ু ক্ষতির সম্মুখিন রাষ্ট্রগুলোর উদ্বাস্তুদের কঠিন সমস্যাবৃত্ত জীবনের কথা ফুটে উঠেছে। এদের অধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে অনেক। এই ছবিটি বিশ্ব দরবারে আমাদের দাবিকে জোরালোভাবে তুলে ধরার একটি মোক্ষম অস্ত্র বললেও বেশিবলা হবে না। জলবায়ু কূটনীতি বলতে যে একটি ব্যাপার রয়েছে তা আমাদের দেশে ভ্রণ অবস্থায় রয়েছে,কবে যে কৈশোর পাড়ি দিয়ে যৌবনে পৌঁছবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এই জলবায়ু কূটনীতি এতটা দুর্বল যে ফারাক্কা সমস্যা নিয়ে আমাদের তেমন একটা সুবিধা করতে না পারাই বলে দেয় আমাদের কূটনীতি কতটা দুর্বল।

কিন্তু সেই ভয়াবহ জঠির ও কঠিন কাজটিই সহজ করে দিয়েছে এই কাইমেট রিফিউজি ফিল্মটি। এত শক্তিশালী ও তথ্যবহুল এটি যে তা আমাদের কূটনৈতিক চেষ্টা চালানোর প্রেক্ষাপট তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারে। ফিল্মটি যুক্তরাষ্ট্রের পেন্টাগন, কংগ্রেস থেকে শুরু করে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দূতাবাসে দেখানো হচ্ছে ও হবে। আমাদের দেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলোতে ফিল্মটি দেখানোর উদ্যোগ অনেক সুফল বয়ে আনতে পারে এতে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। শুধু দূতাবাস কেন সমগ্র বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুল, মাদ্রাসা, ইলেকট্রনিক মিডিয়াসহ পার্লামেন্ট, বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পরিদফতরে এটি প্রদর্শিত হতে পারে।

প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন সাশ্রয়ী ও সুবিধাজনক তৈমনি এই ফিল্মটিও আমাদের জলবায়ু দরকষাকষিকে অনেক সাশ্রয়ী করে দিয়েছে। এই তথ্যবহুল চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছেন হলিউডের সুখ্যাত চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠান লস এঞ্জেলেস থিংক ট্যাংক-এর মাইকেল ন্যাশ। ন্যাশ একজন বহু পুস্কার পাওয়া চলচিত্র নির্মাতা। তিনি স¤প্রতি দি গ্লোবাল ইনোভেটিভ অ্যাওয়ার্ড ও নরম্যান মার্কারে ২০১০ সালের এভাইরনমেন্টাল বিশন ফিল্মমেকার অ্যাওয়ার্ড। অর্জন করেছেন এটা এমন একটি ফিল্ম যা জাতিসংঘের কোপেনহ্যাগেন সম্মেলনে কিছু বিজ্ঞানী ও বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে দেখানো হয়েছিল।

তার কাইমেট রিফিউজি ম্যুভিটির পূর্বে তিনি নির্মাণ করেছেন ফুয়েল নামের টপ ফিচার ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড পাওয়া একটি মুভি। যেখানে সমাজ ও রাজনীতিচর্চা যুদ্ধও ডেকে আনে, সেখানে বহু ক্ষেত্রে সমঝোতায় পৌছানোর কোনো গ্রহণযোগ্য সাধারণ বিষয় থাকে না। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়টি সমগ্র বিশ্বে স্বীকৃত একটি সাধারণ সমস্যা। এই বিষয়টিতে মানব জাতির ব্যর্থ হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আর এই কথাটিই উক্ত ফিল্মটির বিষয়বস্তুতে ওঠে এসেছে।

এতে বাংলাদেশের জলবায়ু উদ্বাস্তুদের বিষয়টি খুবই শক্তিশালীভাবে ফুটে উঠেছে। মানুষের নিদারুণ কষ্টের সংগ্রাম, যা হাজার লক্ষ পৃষ্ঠায় ফলহীন প্রতিবেদনের চাইতেও বেশি শক্তিশালী। জলবায়ু পরিবর্তনের মাবিক দিকটিই এই ম্যুভিটির বিষয়বস্তু। চলচ্চিত্রটিতে ফুটে উঠেছে এই মুহূর্তে বিশ্বে বিরাজিত ৩ কোটি জলবায়ু উদ্বাস্তু যারা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় আইনগত সুরক্ষা বা স্বীকৃতি না পাওয়ার কারণে কষ্ট পাচ্ছে। এটা আমাদেরকে ভবিষ্যত ভয়াবহতার স্বচ্ছ ধারণা দেয়।

ফিল্মটিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় মানুষের অভিযোজনের সংগ্রাম যেমন ফুটে উঠেছে, তেমনি মানুষের স্থিতিস্থাপকতা অর্জনের আর্তি ফুটে উঠেছে। মানুষ দুর্যোগকালে আশ্রয় কেন্দ্র খোঁজে, কিন্তু খুবই ন্যূন ব্যবস্থা পরিবর্তিত জলবায়ু দুর্যোগ মোকাবিরায় খুবই অপ্রতুল। উপকূলীয় মানুষের এই প্রয়োজনের বিষয়টি ম্যুভিটিতে খুবই গুরুত্ব পেয়েছে। ব্যাপারটি আমাদের দর কষাকষির কাজকে অনেক সহজ করবে বলে ধারণা করা যায়। এটা কি একটি সমস্যাসংকুল ধারণা? পরিবেশগত উদ্বাস্তু শব্দটি সর্বপ্রথম ১৯৮৫ সালে এল হিন্নাওয়ি জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচীর একটি প্রতিবেদনের হেডলাইন হিসেবে আনেন।

ব্যাপারি কে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় গঠিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্যানেল তার প্রথম প্রতিবেদনে ১৯৯০ সালে গুরুত্ব দিয়ে উল্লেখ করে। সেই প্রতিবেদন মোতাবেক জলবায়ু পরিবর্তনজনিত উদ্বাস্তু কোটি কোটি বলে উল্লেখ করা হয়। ১৯৯০ সালের পর প্রায় ১৫ কোটি জলবায়ু বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলন হয়ে গেল। কিন্তু ব্যাপারটির গুরুত্ব তেমন একটা প্রতিফলিত হয়নি। নরম্যান নামের এক পরিবেশবিদ ১৯৯৭ সালে প্রথম এ সমস্যাকে মানবতার জন্য সবচাইতে বড় সমস্যা বলে চিহ্নিত করেছেন।

মাইকেল ন্যাশের আগে যেমন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি আল গ্যোর ইনকনভেনিয়েন্ট ট্রথ নামের একটি তথ্য চলচিচত্র তৈরি করে মানবতার এই সমস্যাকে চিহ্নিত করেন ও অনুধাবনে বিরাট ভূমিকা পালন করেছেন। যে খারণে তিনি শক্তির দূত হিসেবে স্বীকৃতিস্বূপ নোবেল পুরষ্কারও পেয়েছেন। ২০০৪-এ রোলান্ড এমেরিকা তার সাড়া জাগানো ম্যুভি দি ডে আফটার টুমরো দিয়ে এই সমস্যাকে নাটকীয়তা প্রদান করেন। বৈশ্বিক উষ্ণতার নিশ্চিত সম্ভাব্যতা যতই প্রতীয়মান হচ্ছে ততই জলবায়ু উদ্বাস্তুদের ব্যাপারটি বেশি বেশি আলোচনায় আসছে। ইতিহাস বলে জলবায়ু ও অভিবাসনের বিষয়টি নতুন কিছু নয়।

তীব্র খরার কারণে ১৯৩০ সালে আমেরিকার ডাস্ট বোলের সমভূমির মানুষ লাখে লাখে ক্যালিফোর্নিয়াতে অভিবাসন গ্রহণ করে। সাহেল মরুভূমি থেকে একই কারণে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৪ সালের জাতিসংঘের সনদে প্রাকৃতিক/জলবায়ু সংক্রান্ত উদ্বাস্তুকে আমলে আনা হয়নি বা প্রেক্ষাপটও অমল ছিল না। সাহারা ও আরব উপদ্বীপের মরুকরণ যখন শুরু হয় তখন থেকেই নীল নদকে কেন্দ্র করে মিসরীয় সভ্যতার সূত্রপাত। হয়তোবা যদি এই পরিবর্তন ঠেকাতে আমা ব্যর্থ হই তাহলে নতুন কোনো সভ্যতা তৈরি হবে বর্তমান সভ্যতার কবরের ওপরে, যার উদাহরণ ভূরি ভূরি; যেমন সিন্ধু সভ্যতা যা পানির অব্যবস্থাপনার কারণে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে দ্রুত পরিবর্তনশীল ব-দ্বীপ, উজানে সৃষ্ট পানি প্রবাহে প্রতিবন্ধকতা ও সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং বরফ গলায় হিমালয়ের দ্রুততা আমাদেরকে অসম্ভব দ্রুত গতিতে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য সতর্ক করে দেয়।

প্রকৃতির ভাষা বুঝতে দেরি হলে আর চলবে না। জলবায়ু কূটনীতি চালাতে হবে সর্বান্তকরণে। উদ্ধারের সম্ভাব্য উপায় ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর খাল কেটে কৃষি ও জীবিকা উন্নয়নে যে অবাস্তবায়িত স্বপ্ন তার পুন:বাস্তবায়নই পারে টেকসই জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা তৈরি করতে। স্থিতিস্থাপক রাজনীতির পূর্বশর্ত স্থিতিস্থাপক জলবায়ু ও জীবনোদ্দীপক পরিবেশ। বাংলাদেশের জন্য সমস্যা মূলত দুই ভাবে; এক উপরোক্ত সকল সমস্যাগুলোর প্রেক্ষাপট এখানে বিদ্যমান ও দুই, জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি বৈশ্বিক কিন্তু বাংলাদেশ এই বিপর্যয়ের জিরো পয়েন্ট।

আলোচিত এই দালিলিক চলচ্চিত্রে এই ব্যাপারটি ঊর্ধ্বে এসেছে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। ম্যুভিটি নির্বাচিত সরকারের আমলে হয়নি বলে এতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ১৭ মিনিটেরও অধিক সময়জুড়ে এতে বাংলাদেশের পরিস্থিতির দালিকি উপস্থাপন এটাকে বাংলাদেশের জন্য দর কষাকষির একটি হাতিয়ারে রূপান্তরিত করছে। আমাদের শুরু হওয়া দর কষাকষি অনেক শক্তিশালী হয়ে ওঠবে এই ফিল্মটি যদি বিভিন্ন মাধ্যমে সকলকে দেখানোর ব্যবস্থা করা যায়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।