আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সিয়াকো বনাম সার্ক



ভণিতা ছাড়াই এটা জোর দিয়ে দাবি করা যায়, পাক-ভারত শত্রুতার কাছে সার্ক জিম্মি হয়ে আছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মুশাররফ ২০০২ সালে ঢাকা সফরে এসে বলেছিলেন, পাক-ভারত সম্পর্কের ধরনের উপর সার্কের ভবিষ্যত নির্ভর করছে। বাংলাদেশ তার অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে সার্কের অনিশ্চিত ভবিষ্যতের উপর নির্ভর করে বসে থাকতে পারে না। বরং আঞ্চলিক সহযোগিতা চুক্তি অথবা ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্টের জন্য আসিয়ানের দিকে নজর দিতে পারে। নিজের পায়ে দাঁড়াতে শেখা উচিত বাংলাদেশকে।

বাংলাদেশের স্মরণ করা উচিত আঠার শ' শতকে লর্ড পলমারস্টোনের সেই বিখ্যাত উক্তি : 'আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে আমাদের কোনো চিরস্থায়ী শত্রু নেই, নেই চিরস্থায়ী বন্ধুও। আমাদের রয়েছে স্থায়ী স্বার্থ। ' বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপ নিয়ে প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক জোট সাউথ এশিয়া কোঅপারেশন অর্গানাইজেশন বা সিয়াকো বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দ্বার খুলে যাবে। ১৯৯২ সালের ১১-১৮ ডিসেম্বর বান্দুং নগরীতে ইন্দোনেশিয়া ও ইসলামিক ডেভলাপমেন্ট ব্যাংকের যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত ইন্দো-আইডিবি সেমিনারে দক্ষিণ ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ব্রুনাই ও মালদ্বীপ নিয়ে অর্থনৈতিক জোট সিয়াকো গঠনের প্রস্তাব দেয় বাংলাদেশ। প্রস্তাবটির অনুকূলে সেমিনারে অংশগ্রহণকারী প্রতিটি দেশ সমর্থন জানায়।

পরের বছর মালয়েশিয়ার রাজধানী কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইসলামিক চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ১১তম সাধারণ সভায়ও সিয়াকো গঠনের প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। একই বছরের ডিসেম্বরে ঢাকায় অনুষ্ঠিত ইসলামিক কমন মার্কেট বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারেও সিয়াকো অনুমোদন পায়। ১৯৯৪ সালে সিয়াকো গঠনের ব্যাপারে বাংলাদেশের পররাদ্ব্র মন্ত্রণালয় ব্রুনাই, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া ও মালদ্বীপের মনোভাব জানতে চেয়ে চিঠি দেয়। আর ১৯৯৬ সালে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার দ্বিপক্ষীয় আলোচনার এজেন্ডা হিসেবে সিয়াকো ঠাঁই পায়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আলোচনা ভেঙে পড়া, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির প্রেক্ষাপটে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আদলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আসিয়ানের ব্যানারে গড়ে উঠেছে একটি সফল ও বিকাশমান অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক জোট।

আসিয়ানের আঞ্চলিক সহযোগিতা ও বাণিজ্যিক সাফল্যের আঞ্চলিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও সার্বিক সহযোগিতা বাড়াতে দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার ওআইসিভুক্ত ৫টি দেশ নিয়েও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক জোট গঠনের প্রস্তাবটি দিন দিন জোরালো হয়ে উঠছে। এ প্রস্তাবিত অর্থনৈতিক জোটই সিয়াকো নামে পরিচিত। আমাদের মনে রাখা দরকার, পঞ্চাশের দশকের শেষ ভাগে এফটিএ বা মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির মাধ্যমে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) গড়ে ওঠে। ৫০ বছরের ব্যবধানে ইইউর সদস্য সংখ্যা এখন ২৭ এবং ইউনিয়নটি এখন বিশ্বের অর্থনৈতিক পরাশক্তি। কানকুন সম্মেলন ব্যর্থ হবার পর বিশ্বে এফটিএ চুক্তির আধিক্য বাড়ে।

এতে এশিয়ান দেশগুলোও আঞ্চলিক ব্লক গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। ডবলিউটিএ বা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা ইতিমধ্যে দুই শতাধিক এফটিএ-কে স্বীকৃতি দিয়েছে। পাশাপাশি আরও ১৪০টি এফটিএ কার্যকর রয়েছে। পারস্পরিক বাণিজ্য পদ্ধতির বিকল্প হিসেবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি দেখা হচ্ছে এটিএ চুক্তিগুলোকে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, নতুন ডবলিউটিএ চুক্তিতে সমঝোতার প্রভাবক হিসেবে এফটিএ ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।

মালয়েশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের আঞ্চলিক বাণিজ্য চুক্তি হলে তা পর্যায়ক্রমে সিয়াকো চুক্তি বাস্তবায়নে সহায়তা দেবে। দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার এ পাঁচটি দেশের ৪২ কোটি ৩০ লাখ ভোক্তার জন্য সিয়াকো এফটিএর মাধ্যমে উপ-আঞ্চলিক বাজার গঠন সম্ভব হলে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির দিকেই হাঁটবে। কারণ বাংলাদেশের ১৫ জনশক্তিকে জনসম্পদে পরিণত করার একটি আকর্ষণীয় পথ পেয়ে যাবে বাংলাদেশ। বিশেষত এ চুক্তি বাস্তবায়িত হলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ -পূর্ব এশিয়ার ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে বাণিজ্য, পর্যটন, ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) ও জনশক্তি রফতানিতে নতুন গতি আসবে। বাড়বে রেমিটেন্স।

পূর্ব -এশিয়ান দেশগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক অনেক প্রাচীন। আর এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে মালয়েশিয়ার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য চুক্তি বাস্তবায়ন করা হলে প্রস্তাবিত সিয়াকো গঠন সহজ হয়ে যাবে। মধ্যপ্রাচ্যের অলস টাকা ব্যবহার করে মালয়েশিয়া আজ সমৃদ্ধির পথে হাঁটছে। মালয়েশিয়ার সঙ্গে কৃষি চুক্তি করে সার্কভুক্ত দেশ পাকিস্তানও এখন খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দিকে ছুটছে। বাংলাদেশও এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারে।

সিয়াকো গঠনের ব্যাপারে ওআইসির অনুমোদন রয়েছে। মালয়েশিয়ার ব্যক্তিত্ব ড. মাহাথির মোহাম্মদ ও ইন্দোনেশিয়ার বি.জে হাবিবি সিয়াকো নামের অর্থনৈতিক জোট গঠনের পক্ষে। ওআইসির সাবেক সহকারি মহাসচিব মোহাম্মদ মুহসিনও সিয়াকো গঠনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছেন। আইডিবিও এ ব্যাপারে আগ্রহী। এখন শুধু সরকারি উদ্যোগ দরকার।

সার্ক বাস্তব হতে পারলে সিয়াকো বাস্তব না হবার পেছনে কোনো কারণ নেই। সিয়াকো গঠনের যাবতীয় গ্রাউন্ডওয়ার্ক করা আছে। এখন শুধু সরকারকে এগিয়ে যেতে হবে। প্রায় ৮০ বছর আগে ইতিহাসবিদ মার্ক টয়েনবি বলেছিলেন, আগামী শতকে বিশ্ব অর্থনীতির চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হবে প্রাচ্য। তার এ ভবিষ্যদ্বণী আজ সফল হতে যাচ্ছে।

বিশ্ব অর্থনীতির এ নতুন সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো ছাড়া আমাদের বিকল্প কোথায়? বিদেশী এয়ারলাইন্সের সহায়তায় শ্রীলঙ্কা ও থাইল্যান্ড বিমান সার্ভিস এখন সুনাম অর্জন করেছে। সিয়াকো গঠন করা হলে বাংলাদেশও তার বিমান সার্ভিসকে লাভজনক পর্যায়ে সহজেই উন্নীত করা সম্ভব। শুধু বিমান নয়, শিপিং, ব্যাংকিং,স্টক এক্সচেঞ্জ, হেলথ-সার্ভিসসহ বিভিন্ন সেক্টরে সিয়াকো গতি এনে দিতে পারে। কারণ পাঁচ দেশ একযোগে কাজ করলে বিনিয়োগ মার খাবার কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না। সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে, বাংলাদেশের ১৫ কোটি জনগণ মূলত জনসম্পদ।

আইএলও এবং ইইউ ধারণা দিয়েছে, দক্ষতা বাড়াতে বাংলাদেশ সামান্য খরচ করলেই বছরে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয় সম্ভব। ওআইসির আন্তঃআঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্যিক সহযোগিতার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে গঠিত হয়েছে গালফ কো-অপারেশন কাউন্সিল (জিসিসি), এরাব কমন মার্কেট (এসিএম), এরাব মাগরেব ইউনিয়ন (ইউএমএ), ইকনোমিক কমিউনিটি অব ইস্ট আফ্রিকান স্টেটস (ইকোয়াস), ওয়েস্ট আফ্রিকান ইকনোমিক কাউন্সিল (সিইএও) এবং ইকনোমিক কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (ইসিও)। যাই হোক, ২৩ লাখ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের ৪২ কোটি ৩০ লাখ জনগোষ্ঠী অধ্যূষিত সিয়াকো অঞ্চলের সম্মিলিত জিডিপি এক দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার আর ট্রেড ভলিউম হচ্ছে ৭৭ হাজার কোটি মার্কিন ডলার। প্রস্তাবিত সিয়াকোর কর্মক্ষম জনশক্তি হচ্ছে ১৯ কোটি ৪০ লাখ আর বার্ষিক জিডিপি হচ্ছে দেশ ভেদে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশ। সিয়াকো বাস্তবায়িত হলে পর্যায়ক্রেমে সদস্য দেশগুলোর অবকাঠামো নির্মাণ, বিদ্যুৎ খাত, পুঁজিবাজার, ব্যাংকিং, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, পর্যটন, খাদ্য সঙ্কট মোকাবেলা, ম্যানুফেকচারিং রিলোকেশন, লজিস্টিক, শিক্ষা ও দক্ষতা উন্নয়ন খাতে বিনিয়োগের দরজা খুলে যাবে।

আঞ্চলিক এফটিএ চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর অভ্যল্ন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য পণ্য ও সেবা খাতে 'থার্ড মার্কেট' উপহার দিতে পারে। দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক বাজারে গতিশীলতা এখনও বিকাশের পথে। তাই বিনিয়োগের জন্য এটা একটি আদর্শ গন্তব্য। সিয়াকো আসিয়ানের আওতায় সার্ক অঞ্চলের দেড়শো কোটি ভোক্তার জন্য অর্থনৈতিক লিঙ্কেজ হিসেবে গড়ে উঠতে পারে। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, ওআইসিভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য ১২ থেকে ১৩ শতাংশ, আসিয়ানে সংখ্যাটি ২৩ শতাংশ।

কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নে তা ৭০ শতাংশ। তিনি বলেন, ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সিয়াকো টাস্ক ফোর্স গঠন করেছে। মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ ও ব্রুনাইয়ে তা গঠনের পর্যায়ে রয়েছে। এ কারণে সিয়াকো গঠনের সম্ভাবনাকে উপেক্ষা করার সময় নেই। দেশের স্বার্থে এ সম্ভাবনাকে আজ কাজে লাগাতে হবে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.