[লেখাটি পত্রিকার কলাম হয়নি কিছু কারণে, কিন্তু সেজন্যই লিখিত ছিল বটে]
যে ক’টা ক্রিয়াপদ নিয়ে ছোটবেলায় ভেজালে পড়তে হয়েছিল ‘মারা’ তার মধ্যে শীর্ষস্থানে পড়ে। ভেজালটা মুখ্যত কল্পনাশক্তিগত। সম্ভাব্য কতরকম ক্রিয়াকে যে ‘মারা’ বলা হয়ে থাকে, এবং সেসকল ‘মারা’তে কত বিবিধ রকম চিত্রকল্প যে সংশ্লিষ্ট তার কোনো সীমা আছে বলে মনে হয়নি। মারার অবধারিত অর্থটাই প্রায় ভুলবার জোগাড়। কপালগুণে, পাঠ্যসূচির কোনো এক বইতে বাগ্ধারা ধরনের ক্রিয়াপদীয় ব্যবহারের কিছু উদাহরণ পেয়ে যাওয়ায় পরিস্থিতিটা খানিক অনুকূল হয় বটে।
কিন্তু সেখানেও সকল ধরনের বস্তু মারার ফর্দ দেয়া ছিল না। ...যেমন ধরা যাক, দই মারা।
ফলে ‘নেপো’র মতো বঙ্গাল-মুল্লুকে-নেহায়েৎ-বেসম্ভব একটা নামের মালিক বসে বসে দই মারতে থাকলে তা দিয়ে বোধগম্য কোনো দৃশ্য বা অনুভূতি সৃজন সম্ভব ছিল না। নৃপতি নামের তুলনায় নেপোলিয়ন, ফরাসী হওয়া সত্ত্বেও, অধিক পরিচিত ছিলেন। সেই নেপোলিয়নের সঙ্গে দইয়ের সম্পৃক্তি কল্পনা কারো পক্ষেই সহজ নয়।
হঠাৎ করে কেনই বা তিনি সমরাস্ত্র ছেড়ে দইয়ের হাড়ি নিয়ে বসবেন! এবং ভারতবর্ষীয় অঞ্চল থেকে কার পক্ষেই বা দইয়ের একটা মট্কা তাঁকে সরবরাহ সম্ভব!! ওদিকে নৃপতি নামের অপভ্রংশ যে ‘নেপো’ হতে পারে তা ওই নামের মালিক ভিন্ন কারো জানার কথা নয়। ফলে, কোনো এক উৎসবের হুলুস্থূলের মধ্যে সকলের চোখ এড়িয়ে এক কোণায় বসে দইয়ের হাড়ি সাবাড় করতে-থাকা নৃপতি, ওরফে ‘নেপো’, খুব দূরসম্ভবা একটা চিত্রকল্প। নেহায়েৎ কষ্টসাধ্য একটা জ্ঞান। অথচ, বাগ্ধারাটি ইতোমধ্যেই শেখা হয়ে গেছে। অর্থোদ্ধার-করতে না-পারা এক প্রবচনের জ্ঞানী হয়ে বসে থেকে এর বহুকাল পরেই কেবল দৃশ্যটি ভালমতো কল্পনা করতে পেরেছি।
এখন আর জনচক্ষু আড়াল করে হাতের-তালু চাটতে-থাকা ‘নেপো’কে মনে মনে দেখতে আমার কষ্ট হয় না।
২৩শে অক্টোবর ২০১০-এ নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ এলাকায় যা হলো তাকে নজিরবিহীন বলার মানে হয় না। এগুলো বাক্য-সাজানোর ক্ষেত্রে আমাদের কল্পনাশক্তির দুরাবস্থার কারণে বলে থাকি। নইলে বাংলাদেশে জন-অসন্তোষ, হামলা, মৃত্যু-উৎসব আর ধামাচাপা দেবার সরকারী ভাষ্য কোনোটাই বেনজির নয়। কিন্তু যে অর্থে বেনজির তা হলো এরকম খবর আকছার পত্রিকার পাতায় ভিড় করে না।
এরকম বক্তব্য দেবার মধ্য দিয়ে আমি একভাবে তাঁদের দলে পড়তে সম্মত থাকছি যাঁরা ভাবেন পত্রপত্রিকা এন্তার স্বতঃপ্রণোদিত নিষেধাজ্ঞা মেনে চলার অনুশীলন করে; এবং নানারকম ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ খবরাখবর ছাপে না। পত্রিকা থেকে পত্রিকান্তরে এই অনুশীলনের ভিন্নতা থাকতে পারে, তবে মোটের উপর এই বাস্তবতাতেই প্রেস-দুনিয়া চলছে বলে মনে করার কারণ রয়েছে। আবার স্বতঃপ্রণোদিত নিষেধাজ্ঞার অনুশীলন আছে মানেই হলো নিষেধাজ্ঞা আরোপের রাষ্ট্রীয় পাহারাদারির নজির এবং ইতিহাস দুই-ই আছে। ক্রমাগত শাসানি আর চোখরাঙানি স্বারোপিত সীমানা নির্ধারণে মদদ দেয়। কিন্তু শাসানি না থাকলেই প্রেস-দুনিয়া যে জনগণপক্ষীয় হয়ে কাজ করে যেত এভাবে দেখারও কোনো সুযোগ সাম্প্রতিক কালে আর নেই।
পত্রিকার স্বার্থ আর যেসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের লগ্নিতে পত্রিকাগুলো বের হয় সেগুলোর স্বার্থ বিভিন্ন নেই। সংবাদপত্র প্রায় মুখপত্রই মনে হয়। কোনো কালে লগ্নিকারের সঙ্গে কাঙ্খিত এই বিযুক্তি সম্পাদক-সাংবাদিক মহলের ছিল কিনা সেই জিজ্ঞাসার উত্তর নিশ্চয়ই গবেষণাসাধ্য বিষয়, তবে দূরকল্প নয়। যাহোক, সংবাদ-কারখানা বিষয়ক এই আলাপ একেবারেই প্রসঙ্গসূত্রেই এল। মুখ্য প্রতিপাদ্য সেটা নয়।
রূপগঞ্জে মানুষ কতো মারা গেল তা হয়তো নিরীক্ষা আর সহজ নেই। অন্তত সেখানে গিয়ে জনে জনে সরেজমিন তদন্ত না করলে তা জ্ঞাত হওয়াও সম্ভব নয়। আর কী ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে সেগুলোও সাধারণ্যে অনুমানসাপেক্ষ মাত্র। কিন্তু অন্তত দুটো বিষয় জ্ঞাত হওয়া যায়, খবরাখবর থেকেই। তার একটা হলো, স্থানীয় লোকজন ‘ক্ষিপ্ত’ বা ‘বেপরোয়া’ হয়ে ‘সেনাক্যাম্প’-এ হামলা করেছে।
আর অন্যটা হলো, স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে সেনা ও অপরাপর বাহিনীর সংঘর্ষের কারণ হচ্ছে অধিকৃত বা অধিকরণের জন্য নির্ধারিত জমি। জমির দখল এবং জমি থেকে উন্মূল হয়ে পড়বার আশঙ্কা থেকেই এই সংঘর্ষ। এই সংঘর্ষ তাই বাংলাদেশের নানাবিধ রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার একটা মেটাফর হিসেবে পাঠযোগ্য। যা এবং যতটুকু খবরের কাগজে জায়গা পেয়েছে তা এই বিষয়ক ভাবনাচিন্তা এগিয়ে নেবার জন্য এবং চলমান বাংলাদেশকে বোঝার জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ পাটাতন সরবরাহ করছে।
যেটাকে ‘সেনাক্যাম্প’ বলা হচ্ছে, সেটাকেই আবার সেনাক্যাম্প বলা হচ্ছে না।
কারণটা চমকপ্রদ, কিন্তু অবোধগম্য নয়। সরকার নানাক্ষেত্রেই নামকাওয়াস্তে অনুমোদনের সীল-ছাপ্পড় দিয়ে থাকে। কিন্তু রূপগঞ্জের কথিত এই ‘সেনাক্যাম্প’ কোনো মতেই সেই ধরনের অনুমোদিত কিছু নয়। সকলেই জ্ঞাত আছেন যে আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার এই উদ্যোগটিকে ঊর্ধ্বতন মহল ‘প্রাইভেট’ নামে আখ্যায়িত করছে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে রাষ্ট্রীয়ভাবে দায়দায়িত্ব নেবার প্রয়োজন পড়ছে না; কিংবা রাষ্ট্র সেনাবাহিনীকে যেসব সুযোগ-সুবিধা ‘দিচ্ছে’ এটা তার বাইরের একটি উদ্যোগ।
এসব খবরও আমাদের এখন জানা যে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও সেনানীদের জন্য এই প্রকল্পটি ডিজাইন করা। উর্দিপরা সেনাগণ তাহলে কার ছাড়পত্র নিয়ে ওখানে আস্তানা গেড়েছেন? ‘গণতান্ত্রিক’ প্রক্রিয়ায় চক্ষুলজ্জার একটা ছাড়পত্রও তো প্রয়োজন পড়ে!
হেলিকপ্টারে করে নিহত জনসাধারণের লাশ সরানো হয়েছে নাকি ‘আহত’ সেনাসদস্য ও বাহিনীর লোকজনকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে তা নিয়ে আশপাশের মানুষজনের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। এই মতভেদ নিষ্পত্তি হবার কথা নয়, যদি আমরা ‘প্রেসবিজ্ঞপ্তি’র প্রথাগত সংস্কৃতি নিয়ে ওয়াকিবহাল থাকি। কিন্তু এই সংঘর্ষ যে একটা সুগভীর ষড়যন্ত্র তা নিয়ে সরকারী দলের মধ্যে কোনো মতভেদ নেই। একটা সিভিল এলাকায় উর্দিপরা লোকজনের সঙ্গে স্থানীয় মানুষজনের ভূমি-অধিগ্রহণ নিয়ে লড়াই হলোÑসেটা বিরোধী রাজনৈতিক দলের ষড়যন্ত্র হিসেবে আবিষ্কার ও ঘোষণা করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের বহুপ্রচলিত রাজনৈতিক অশিষ্টাচারের একটা নমুনা রাখলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ।
আর এতে বিশেষ কোনো বিস্ময়ের কিছু ঘটেনি। কিন্তু সেনাবাহিনীর অবঃকালীন কিংবা সমকালীন উচ্চবর্গের সঙ্গে সরকারের মিথষ্ক্রিয়ার ধরন নিশ্চয়ই উদ্বেগের। ভূমি অধিগ্রহণজনিত যে বেদনা ও উন্মূলতার বোধ আম মানুষের মনে বিরাজমান সেটাকে সরকারের গুরুত্ব দিয়ে না-দেখা নিশ্চয়ই হতাশার। সর্বোপরি, বাণিজ্য গোষ্ঠী (এই বিশেষ ক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট) ও সেনা হেডকোয়ার্টারের মৈত্রী আর যোগাযোগের ধরন নিয়ে সরকারের হ্রস্বদৃষ্টি নিশ্চয়ই সন্দেহের।
রূপগঞ্জের ঘটনাটি আরও একটি দিক দিয়ে ইঙ্গিতবহ।
গত কয়েক বছরে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায় জড়িত বহু কোম্পানির বিরুদ্ধে একগাদা প্রতারণার অভিযোগ উঠেছে। টাকা-পয়সা জমা দিয়ে স্বর্বস্বান্ত-হওয়া অনেক মানুষজন এদিক-সেদিক দৌড়ে সুবিচার আশা করছেন। সরকার এই ব্যবসায় প্রতারণার শাস্তিও ঘোষণা করেছে। বাস্তবে মানুষ অভিযোগ করতে ভয় পাচ্ছেন, যাতে আম-ছালা দুই-ই না যায়। যদি যেমনটা জানা গেল, রূপগঞ্জের আবাসিক প্রকল্পটি অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তাদের জন্যই হয়ে থাকে, তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করবার সাহস এই কোম্পানিগুলো করবে নাÑঅন্তত এই আশা করা যেতে পারে, রিয়েল এস্টেট কোম্পানিগুলো বিশুদ্ধ ‘সিভিল’ মালিকানাধীন আছে এটা ধরে নিয়ে অবশ্যই।
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার তথা জরুরি অবস্থার কালে, কানকথায় শোনা যায়, নয়া নয়া ‘ডিফেন্স অফিসার্স হাউসিং সোসাইটি’ তৈরি হয়েছে। সেগুলো ঠিক কোথায় কোথায় অবস্থিত, কী কী শর্তে সরকার সেগুলোর ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করেছে, মিলিটারি প্রশাসনের সঙ্গে দরকষাকষি করার আদৌ কোনো সামর্থ্য সরকারী [সিভিল] প্রতিষ্ঠান সমূহের আছে কিনাÑএসব জিজ্ঞাসা অতীব কেন্দ্রীয় হিসেবে সামনে চলে আসছে। কিন্তু জিজ্ঞাসাগুলোর উত্তর কোথায় মিলবে! অনুপুঙ্খ উৎসাহীরা, কিংবা ভুক্তভোগীরা আরও খবর দিচ্ছেন কিন্তু। মামলা কেবল ডিওএইচএস-এর নয়। কর্পোরেট ফিন্যান্সের একাধিক জায়গায় লগ্নিকার, বা অংশীদার, কিংবা হয়তো দুই-ই, হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছেন সেনা প্রশাসন কিংবা অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তারা।
এরকম একটা পরিস্থিতির তুলনা দেয়া হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মধ্যে কেবল পাকিস্তানের। তথাকথিত ‘গণতন্ত্রের’ হাল নিয়ে না-ভেবে তো উপায় নেই!
আম মানুষজন যে নানান কিছু ভাবছেন না তা নয়। তাঁরা ভাবছেন। তাঁদের রাজনৈতিক কর্তব্য-নির্ধারণ ঘটে নানাবিধ দৈনন্দিন সঙ্কট নিরসনের মধ্যে ও মাধ্যমে। মধ্যবিত্ত সিভিল মানুষজনের মধ্যেও কেউ কেউ নিশ্চয়ই ভাবছেন।
ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছেন। আবার সরব হবার প্রয়োজন বুঝলেও দ্বিতীয় বার আতঙ্কিত হচ্ছেন। লিবেরেল গণতন্ত্রের যে মহিমা গাওয়া হয়ে থাকে তাতে কণ্ঠস্বর খোলতাই করবার অনুশীলন, লোক-দেখানো হলেও, জারি রাখার নিরাপত্তা থাকে। বাংলাদেশে গলা সাধার সেই সুযোগটুকুও আছে বলে মানুষজনের ভরসা নেই। উপরন্তু, ৯০ সালে ‘গণজোয়ার’ হয়েছে বলে প্রচার করতে-করতে একটা রাখাল বালকের সঙ্কটে তাঁরা পড়েছেন।
সেই রাখাল বালক যে বার বার বাঘের বানোয়াট গল্প দিয়ে মানুষের বিশ্বাস নষ্ট করেছে। এতবার গণতন্ত্র, গণজোয়ার আর বিসামরিকীকরণের গল্প ফাঁদার পর তাঁদের জন্য কর্তব্য নির্ধারণ দুরূহই বটে। সর্বোপরি, তাঁদের চূড়ামণি একাংশ বর্তমান পরিস্থিতির স্টেকহোল্ডারও হতে পারেন। অবস্থাদৃষ্টে তাও মনে হতে পারে। অন্তত ততটুকু স্টেকহোল্ডার যতটুকু হলে এসব বিষয়ে ভেবে ‘ঝামেলা-না-বাধানো’ একটা উদ্দেশ্য হতে পারে।
ফলে, নেপো'র দই মারার এটাই যথার্থ সময়। কর্পোরেট-সামরিক মিথোজীবিতার পয়লা অধ্যায় অবলোকন করছি কি? অবলোকনের অধিকন্তু কর্তব্য নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু তার রূপকার কারা হবেন?!
(০৯ই নভেম্বর ২০১০॥ ঢাকা)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।