"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। " মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন
তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক বা থ্রিজির শুভ সূচনার মাধ্যমে দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতিক্ষার সমাপ্তি হয়তো এবারে ঘটতে যাচ্ছে। চলতি বছর পরীক্ষামূলকভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিযোগাযোগ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিটক থ্রিজি সেবা চালু করবে। সেলুলার মোবাইলের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে প্রথম প্রজন্ম (1G)। দেখা গেছে কম-বেশি প্রতি দশ বছর অন্তর-অন্তর নব প্রজন্মের (G) আগমন ঘটছে।
আজকের লিখায় ওয়্যারলেস নেটওয়ার্কের ৪টি প্রজন্মের আগমণ ও তার পরিচিতি তুলে ধারার চেষ্টা করা হয়েছে।
কোন উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে প্রদত্ত প্রেক্ষাপটে শৃঙ্খলা আণয়নের লক্ষ্যে, ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও কোন স্বীকৃত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অনুমোদিত এমন কোন নিয়মকানুন যা সকলে মেনে চলবে তাকেই আমরা স্ট্যান্ডার্ড (মান) বলে থাকি। দৈনন্দিন জীবনে নানারকম কাজের জন্য আমরা বিভিন্ন রকম স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করি। স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠানে একই বিষয়ের উপর বিভিন্ন বিশেষজ্ঞরা থাকেন। তারাই নির্ধারণ করেন কোন্ কোন্ নিয়ামক-কে স্ট্যান্ডার্ড হিসেবে গ্রহণ করা হবে।
বিভিন্ন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইসের ক্ষেত্রে স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের বড় সুবিধ হলো সবাই একই নিয়ম মেনে/অনুসরণ করে উপকৃত হতে পারে। উদাহরণ স্বরুপ বলা যায়, আপনি বাজার থেকে কোন ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস কিনলেন। প্রত্যাসিত ফলাফল পেতে বাসায় এনে সেটিকে অবশ্যই বৈদ্যুতিক সংযোগ দিতে হবে। এখন সে ডিভাইসে যদি স্ট্যান্ডার্ড সংযোগ পদ্ধতি ব্যবহার করা না থাকে তাহলে আপনি অসুবিধায় পড়বেন নিশ্চয়ই। আর যদি আপনার দেশের ইলেকট্রিক্যাল সংযোগ স্ট্যান্ডার্ড মেনে সে ডিভাইসের ডিজাইন করা হতো তাহলে তা সহজেই ব্যবহারযোগ্য হতো।
কম্পিউটার বা কম্পিউটার সংশ্লিষ্ট নেটওয়ার্ক বিষয়ে বিশ্বব্যাপী স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণকারী প্রধান সংস্থার সংখ্যা হলো ছয়টি। এ ছয়টি সংস্থা নেটওয়ার্কের বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণের মাধ্যমে বিভিন্ন ডিভাইস, টেকনোলজি, ডিজাইন ইত্যাদির মাঝে সমন্বয় সাধনের চেষ্টা করে। ফলে স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করে গড়ে উঠা নেটওয়ার্ক সহজেই কোন রকম বিপত্তি ছাড়াই একটি আরেকটির সাথে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণকারী ছয়টি সংস্থা হলো, ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ফর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন (ISO), ইনস্টিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল এন্ড ইলেকট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার (IEEE), ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রিজ এলায়েন্স (EIA), টেলিকম্যুনিকেশন্স ইন্ডাস্ট্রি এসোসিয়েশন (TIA), আমেরিকান ন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ডস ইনস্টিটিউট (ANSI) এবং ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম্যুনিকেশন্স ইউনিয়ন (ITU)। ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম্যুনিকেশন্স ইউনিয়ন (ITU) জাতিসংঘের একটি অঙ্গসংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে টেলিকম্যুনিকেশন্স সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তিনটি সেক্টর নিয়ে কাজ করে।
সেক্টরগুলো হলোঃ রেডিও কমিউনিকেশন সেক্টর (ITU-R), স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন সেক্টর (ITU-T) ও ডেভোলাপমেন্ট সেক্টর (ITU-D)।
ইন্টারনেট বা নেটওয়ার্কিং একটি বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত প্রযুক্তি হওয়ায় এক্ষেত্রে আন্তর্জাতিকভাবে গৃহীত স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ওয়্যারলেস টেলিফোন নেটওয়ার্কে প্রথম প্রজন্ম (1G), দ্বিতীয় প্রজন্ম (2G), তৃতীয় প্রজন্ম (3G) ও চতুর্থ প্রজন্ম (4G) এর আগমন। মোবাইল প্রযুক্তির প্রজন্ম যা সেল ফোন এবং এর নেটওয়ার্কে ইনস্টল করা হয়ে থাকে। প্রতিটি নতুন ‘জি’-এর জন্য প্রয়োজন হবে নেটওয়ার্কের ব্যয়বহুল আপগ্রেডের।
১৯৮০ সালের দিকে প্রথম প্রজন্মের (1G) এনালগ ওয়্যারলেস টেলিফোন নেটওয়ার্কের আগমন ঘটে। জাপান প্রথম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক স্থাপনের মাধ্যমে জেনারেশন প্রযুক্তির যাত্রা শুরু করে। এটা এনালগ টেলিকম্যুনিকেশন স্ট্যান্ডার্ড। এই স্ট্যান্ডার্ড কেবলমাত্র কথোপকথনের (ভয়েস আদান-প্রদান) জন্য নির্ধারিত ছিল এবং এনালগ সিগন্যাল ব্যবহার করে তা সম্পাদন করা হতো। এনালগ টেলিকম্যুনিকেশন স্ট্যান্ডার্ড হওয়ায় বিভিন্ন পরিবেশে নির্বিঘ্নে ও অব্যাহতভাবে কথোপকথন সম্ভব হতোনা।
বিভিন্ন পরিবেশে নির্বিঘ্নে ও অব্যাহতভাবে কথোপকথন সম্পাদনের লক্ষ্যে ১৯৯০ সালের দিকে দ্বিতীয় প্রজন্মের (2G) ডিজিটাল ওয়্যারলেস টেলিফোন নেটওয়ার্কের আগমন ঘটে। কোন রকম কাঠামোগত পরিবর্তন ছাড়া প্রথম প্রজন্মের (1G) এনালগ ওয়্যারলেস টেলিফোন নেটওয়ার্কের এনালগ সিগন্যালকে কেবমাত্র ডিজিটাল সিগন্যালে রুপান্তর/প্রতিস্থাপন করে দ্বিতীয় প্রজন্মের (2G) এই স্ট্যান্ডার্ড নির্ধারণ করা হয়েছে। আমাদের দেশে এখনো এই স্ট্যান্ডার্ড ব্যবহার করে সেলফোন অপারেটরগুলো তাদের সেবা দিচ্ছে। এ প্রজন্মেরই ধারাবাহিকতায় এসেছে গ্লোবাল প্যাকেট রেডিও সার্ভিস (GPRS) একে 2.5G ও এনহ্যান্সড ডাটা রেট ফর জিএসএম ইভালুয়েশন (EDGE) একে 2.75G বলে গণ্য করা যায়। এমনকি, টুজি লাইসেন্স নবায়নে আদালতে বিভিন্ন মামলা রয়েছে, সরকার পক্ষ ও অপারেটরদের এসব মামলা প্রত্যাহারের জন্য বলা হয়েছে।
মামলা প্রত্যাহারের পর লাইসেন্স নবায়ন করা হবে। বাংলাদেশে যখন টুজি লাইসেন্স বিতরণ নিয়ে সমস্যা তখন বিশ্বের আরেক প্রান্ত সেই প্রযুক্তি ব্যবহার বন্ধ করে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ ল্যান্ড এবং মোবাইল টেলিফোন সুবিধা প্রদানকারী সংস্থা এটিঅ্যান্ডটি ২০১৭ সালের ১ জানুয়ারি থেকে টুজি সেবা বন্ধ করে দিবে বলে জানিয়েছে।
প্রযুক্তিগতভাবে টুজি পর্যন্ত বিষয়গুলো সাদামাটাই ছিল। এর পরে এসেই বিষয়টা একটু জটিলাকার ধারণ করেছে।
কারণ তৃতীয় প্রজন্মের (3G) জন্য থ্রিজিবান্ধব নয়া নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রয়োজন। অন্য দিকে থ্রিজি নেটওয়ার্ক সুবিধা উপভোগ করতে গ্রাহকদের প্রয়োজন উন্নত মোবাইল সেট। তারপরও প্রজন্ম-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আটকে থাকেনি। শুধু যে ধনী দেশেগুলোতেই মোবাইল নেটওয়ার্কের এই আপগ্রেডেশন হচ্ছে তা-ই নয়, থ্রিজিতে আপগ্রেডেশনের এই অনুমোদন আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশগুলোসহ তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের সরকার ২০০৮ সালের মধ্যে দিয়ে দিয়েছে। থ্রিজি প্রযুক্তির সবচেয়ে বড় ও আকর্ষণীয় সুবিধা হলো, এই প্রযুক্তি কার্যকর থাকলে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মাধ্যমে ভয়েস সুবিধার পাশাপাশি ব্যবহারকারী উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারে।
এছাড়া টিভি দেখা, খেলা দেখা, ভিডিও ক্লিপস আদান-প্রদান, ভিডিও কনফারেন্স সবই সম্ভব। থ্রিজি বাংলাদেশের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের একমাত্র সমাধান। গণ ব্রডব্যান্ড ছাড়া ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন অবান্তর। কেননা ডিজিটাল বাংলাদেশে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের পরে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট হবে জনগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার। মোবাইল নেটওয়ার্ক ছাড়া অন্য কোনো নেটওয়ার্কে যে কোনো লোকেশনে ব্রডব্যান্ড দেয়া প্রায় অসম্ভব।
বর্তমান সময়ে ব্রডব্যান্ড নেটওয়ার্কের জন্য পৃথিবীতে সাধারণত তিন ধরনের নেটওয়ার্ক অবকাঠামো ব্যবহার করা হচ্ছে—১. ফাইবার অপটিক ক্যাবল; ২. ওয়াইম্যাক্স ও ৩. থ্রিজি মোবাইল নেটওয়ার্ক।
টুজি এবং থ্রিজি’র ধারাবাহিকতায় এসেছে ফোরজি বা চতুর্থ প্রজন্ম (4G)। আশা করা হচ্ছে, ফোরজির মাধ্যমে ইন্টারনেট ভিত্তিক কাজসমূহ থ্রিজির চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি দ্রুতগতিতে (আলট্রা ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ) করা সম্ভব। ফোরজির মাধ্যমে হাই-ডেফিনিশন মোবাইল টিভি এবং ভিডিও কনফারেন্সসহ আরও অনেক চমকপ্রদ সুবিধা পাওয়া যাবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফোরজি প্রযুক্তি চালু হতে শুরু করেছে।
[লেখকঃ প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ই-মেইলঃ ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।