লেখক/কবি
ভেঙ্গে যাওয়ার পর অনেক কিছুই আর জোড়া দেয়া যায় না বা দেয়া গেলেও আগের মতো হয় না। কিন্তু এমন যদি হতো ভেঙ্গে যাওয়া প্রতিটি টুকরাই আবার আগের মূল জিনিসটির মতো হলো! তাহলে?
ভাবতে খুব মজা লাগছে তাইনা? সত্যি এমন জিনিস কিন্তু প্রকৃতিতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এদের সংখ্যাও প্রায় অসীম। বিশ্বাস হচ্ছে না? না হবারই কথা। তবে আসুন কয়েকটি বিষয়ে একটু নজর দেই।
বাড়ীর ফ্রিজে সব্জী রাখার জায়গাটি ভালভাবে খুঁজে দেখুন ফুলকপি পাওয়া যায় কিনা। না পাওয়া গেলেও ক্ষতি নেই। মনের জানালা খুলে একটি ফুলকপি আমদানি করুন অথবা একটি পাতায় ছাওয়া গাছ। এবার এর থেকে একটি শাখা আলাদা করে নিন। কী! দেখলেন তো! ঠিক আগের গাছের আকৃতির মতই একটি অংশ পাওয়া গেলো।
বাচ্চারা কিংবা এখন যারা বড় তারাও শৈশবে কিন্তু ফুলকপি বা গাছের শাখা দিয়ে সত্যিকার ফুলকপি বানিয়ে চড়ুইভাতির ফুলকপি হিসেবে মিছেমিছি বাজার করতাম আর খেলার সঙ্গীদের হাতে রান্না খেতাম। ছোট্ট ছেলে-মেয়েরা কিন্তু এখনো তাই করছে।
আসলে এটি কোনো জটিল বিষয় নয়। এই সহজ বিষয়টিই কিন্তু গণিতবিদদের কাছে আজো এক ধাঁধাঁ। তারা একই ধাঁধাঁর বিষয়টির নাম দিয়েছেন ফ্র্যাকটাল জ্যামিতি।
অনিয়ত আকৃতির বস্তুপুঞ্জ একত্রে সমন্বিত হয়ে জন্ম দেয় অসীম এক ফ্র্যাকটাল ধাঁধাঁর।
শুধু প্রকৃতি কেনো, আপনি নিজেও ইচ্ছে করলে অতি সহজেই সাধারণ কোনো জ্যামিতিক শেপ বা আকৃতি একের পর এক নিয়মতান্ত্রিকভাবে সাজিয়ে তৈরি করতে পারেন বর্ণিল এক ফ্র্যাকটালের ক্যানভাস। আবার তিনটি কাঁচের গোলক ধাঁধাঁ যা ক্যালাইডোস্কোপ নামে পরিচিত, সেই কাঁচের গোলক ধাঁধাঁর মাঝে নানা রকমের বিভিন্ন রঙের ছোট বস'কণা ফেলে দেখতে পারেন আজব সব ফ্র্যাকটালের অসীম খেলা। কাঁচের এই গোলক ধাঁধাঁর মাঝে কোন একটি নির্দিষ্ট আকার-আকৃতির বস্তুকণা নিজের বহু সংখ্যক প্রতিবিম্ব জুড়ে গিয়ে নতুন এক মাত্রায় আমাদের সামনে হাজির হয়। এর প্রতিটি স্থান পরিবর্তনে নক্সাও যায় বদলে।
হাজির হয় নতুন বৈচিত্রময় নক্সার। একটু মনোযোগ দিয়ে খেয়াল করলেই দেখবেন আপনার যোগ করা বস্তু পি-টির আসল আকার-আকৃতিই তাতে বার বার যোগ হয়েছে। একই আকৃতির বস্তুপিন্ডের পৌনপুনিকতায় ভরপুর জগতটিই আপনার নিজ হাতে জন্ম দেয়া ফ্রাকটাল।
গণিতবিদ কার্ল ওয়ারস্ট্রাস ১৮৭২ সালে প্রথম এই ফ্র্যাকটাল আবিষ্কার করেন। হাতে গুনে ফ্র্যাকটালের হিসেব কথা প্রায় অসম্ভব।
তাই কৃত্রিম হিসেব যন্ত্র তথা কম্পিউটারের যথেষ্ট উন্নতি হয়ার আগ পর্যন্ত কারো পক্ষেই ফ্র্যাকটাল সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯৭৫ সারে বেনইট মেন্ডেলব্রট কম্পিউটারের সহায়তার প্রথম স্বার্থকভাবে ফ্র্যাকটাল তৈরি করেন ও নাম দেন ফ্র্যাকটাল। তারপররই এ ধরনের আজব জ্যামতি সম্পর্কে ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়।
ফ্র্যাকটাল শব্দটি ও এসেছে ল্যাটিন শব্দ ফ্র্যাকটাস থেকে যার আক্ষরিক অর্থ ভাগ্ন অংশ।
আপনার সামনে থাকা কম্পিউটার মনিটরটির কথাই ধরুন না।
সমতল এই কাঁচের পৃষ্ঠ জুড়ে রয়েছে অনেক অনেক বিন্দু আপনারা কাছে যা পিক্সেল নামে পরিচিত। এর প্রতিটিকেই কিন্তু আলাদা আলাদা সংখ্যার সাহায্যে চিহ্নিত করা সম্ভব। এ সকল বিন্দুর কোনটিকেই কিন্তু অভিন্ন সংখ্যার মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। ঠিক গ্রিডের মতো যখন আড়াআড়ি দুটি লাইন পরস্পরকে অতিক্রম করে তখনই একটি বিন্দুর জন্ম হয়। হাতে-কলমে একটি ফ্র্যাকটাল তৈরি করার জন্য আপনার দরকার হবে একটি নিদিষ্ট আকৃতি বা ফাংশনের।
নির্দিষ্ট গাণিতিক নিয়মে যার প্রতি জোড়াকে বিন্যাসের মাধ্যমে পাওয়া যাবে নতুন সহগ। প্রকৃতির আজব ঘটনা জানার জন্য ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক বা ডিসকভারি চ্যানেলের জুড়ি নেই। এসব চ্যানেলের অনুসন্ধানি অনেক ডকুমেন্টরিতেও নিশ্চয়ই বরফের কেলাস জমার মাইক্রোস্কোপিক ভিডিও চিত্র দেখার সৌভাগ্য আপনাদের কম বেশী অনেকের হয়েছে।
উপরের বিদঘুটে গাণিতিক আলোচনাটুকুকে তার সাথে জুড়ে নিয়েই কল্পনা করে দেখুন না। তাহলে বিষয়টি এতোটা খটমটে ঠেকবে না।
কল্পনায় খানিকের জন্য দেখুন কিভাবে বরফের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কেলাসের বিভিন্ন অংশগুলো জ্যামিতিক ভাগে বিভক্ত হয়ে যাচ্ছে। আগেকার আকৃতি পরমুহুর্তেই ঢাকা পড়ে যাচ্ছে একই আকৃতির দ্বিখন্ডিত অনেকগুলো সু-সমন্বিত জ্যামিতিক জঞ্জালের মাঝে।
একই আকৃতির পুণঃ পুণঃ দ্বিভক্তি ও পর মুহুর্তে একই ধাঁচে বার বার সম্মিলন। নতুন এক জ্যামিতিক শেপ-এর মন ভোলানো এ খেলায় বরফের কেলাসের বর্ণিল আলোকচ্ছটা অসীমের পানে ধেয়ে চলছে। তৈরি হচ্ছে ক্ষুদ্র জগতের মাঝে জ্যামিতিক ফ্র্যাকটালের আঁকিবুকি।
গণিত আর জ্যামিতির নির্দিষ্ট সহজ সরল নিয়মের অধীনেই কিন্তু প্রকৃতির আজব এই খেলা চলছে সব সময় আমাদের অজান্তেই । এভাবে অতি ক্ষুদ্র সময়ের মাঝে ক্ষুদ্রতমস্থানে আট লাখেরও বেশী একই আকৃতির জোড়া লাগার খেলা সম্পন্ন হচ্ছে। খানিক বাদে এ সংখ্যার হিসেব করা কোন সুপার কম্পিউটার পক্ষেও হয়তো সম্ভব হয়ে উঠবেনা। এই হলো সহজতর ফ্র্যাকটালের জটিল কৌতুক।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায় সীমার মাঝে অসীমের হাতছানি।
গাণিতিক ভোজবাজি। শেপ-এর মাঝে খানিক ব্যবধানে বর্ণবৈচিত্র্যের কারণে তার সাথে যোগ হয় নতুন এক মাত্রা। দৃষ্টিভ্রম।
মায়াবী কুহক ছাড়া একে কি আর বলা যায়।
লেখাটি বিডিনিউজটোয়েন্টিফোরডটকম এর ২০০৯ ঈদুল ফিতর উপলক্ষে প্রকাশিত ঈদ সংখ্যার ভি-ম্যাগএ ছাপা হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।