আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

| অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব | পর্ব: ২/৮ |

``চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল। ' -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
[ ডিসক্লেইমার: লেখার বিষয় সংবেদনশীল এবং কিঞ্চিৎ গবেষণাধর্মী। ইতঃপূর্বে এটি মুক্ত-মনা বাংলা ব্লগে সিরিজ আকারে আটটি পর্বে প্রকাশিত হয়েছে এবং পরবর্তীতে ই-বুক আকারে সেখানে সংরক্ষিত হয়েছে। রিপোস্ট সিরিজ হলেও বিষয়বস্তুর কারণে আশা করি কারো বিরক্তির কারণ হবে না।

তাছাড়া পাঠক হিসেবে অনায়াসে এড়িয়ে যাবার স্বাধীনতা তো রয়েছেই ! ] [ ১ম পর্ব] মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পৃথিবীতে যতগুলো কথিত ধর্মগ্রন্থ রয়েছে তার মধ্যে মনে হয় অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূর্ণ গ্রন্থটির নাম হচ্ছে ‘মনুস্মৃতি’ (Manu-smriti) বা ‘মনুসংহিতা’ (Manu-samhita)। ব্রাহ্মণ্যবাদের (Hinduism) আকর গ্রন্থ শ্রুতি বা ‘বেদ’-এর নির্যাসকে ধারণ করে যেসব স্মৃতি বা শাস্ত্র গ্রন্থ রচিত হয়েছে বলে কথিত, তার শীর্ষে অবস্থান করছে মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। তাই মনুসংহিতা ও ব্রাহ্মণ্যবাদকে আলাদা করে দেখার উপায় নেই। মনুসংহিতা মানেই ব্রাহ্মণ্যবাদ, ব্রাহ্মণ্যবাদ মানেই মনুসংহিতা। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়।

বারোটি অধ্যায়ে প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত এ গ্রন্থটির পাতায় পাতায় ধর্মীয় বিধানের নাম দিয়ে সংস্কৃত অক্ষরে অক্ষরে যে শ্লোকগুলো উৎকীর্ণ রয়েছে, অধিকাংশ শ্লোকের ভাবার্থকে যদি মনুষ্য সমাজে পালনীয় নীতি হিসেবে বিবেচনা করতে হয়, তাহলে মানুষের সমাজে কোন মানবিক বোধ আদৌ রয়েছে বা অবশিষ্ট থাকতে পারে বলে বিশ্বাস করাটাই অবিশ্বাস্য মনে হয়। এ ব্যাপারে কোন বিস্তৃত ব্যাখ্যায় না গিয়ে বরং মনুসংহিতা থেকে অনুবাদ ও ভাবার্থসহ কিছু শ্লোকের নমুনা-উদাহরণ টানলেই বিষয়গুলো আমাদের সামনে অধিকতর স্পষ্ট হয়ে ভেসে ওঠে। উল্লেখ্য, মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। কথিত হয় যে মহান স্রষ্টা বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করেছেন, এ সবকিছু রক্ষার জন্য তাঁর মানব সৃষ্টিও জরুরি হয়ে পড়ে। ফলে মানুষও সৃষ্টি হলো।

কিন্তু মানব সৃষ্টি ও পরিপালনের ক্ষেত্রে এসে ব্রহ্মা বা ঈশ্বর বোধ করি নিজেকে আর সুমহান মর্যাদায় ধরে রাখতে পারেন নি। যে শ্রেণীবিদ্বেষপ্রসূত তীব্র অসমতাভিত্তিক বর্ণপ্রথার আশ্রয় নেয়া হয়েছে তাতেই সন্দেহ গাঢ় হয়ে ওঠে যে এটা আদৌ কোন অতিলৌকিক পবিত্র বিধিবিধান কিনা। বরং ধর্মীয় মোড়কে এক ঘৃণ্য আর্থ-সমাজ-রাজনীতির অত্যন্ত দুরভিসন্ধিমূলক হীন প্রচেষ্টা বলেই মনে হয়। তার পেছনে যে এক অতীব স্বার্থান্বেষী ভণ্ড প্রতারক গোষ্ঠির সূক্ষ্মতম কারসাজিই কার্যকর হতে পারে, তা বুঝতে খুব বেশি যুক্তিবাদী হবার প্রয়োজন পড়ে না। বিস্তৃত পরিসরে না গিয়ে আমরা প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয়ের নমুনা-উদাহরণ পর্যবেক্ষণ করে নিতে পারি।

এক্ষেত্রে বঙ্গানুবাদসহ উদ্ধৃত শ্লোক ব্যবহারে সদেশ প্রকাশনী কলকাতা থেকে বইমেলা ১৪১২-এ প্রকাশিত মানবেন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘মনুসংহিতা’ সুলভ সংস্করণ গ্রন্থটির সহায়তা নেয়া হয়েছে। ০১ এই বিশ্বজগৎ সৃষ্টি করে অতঃপর স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা কি আদতে মানুষ সৃষ্টি করলেন, না কি কিছু বিভেদপূর্ণ বর্ণ (varnas) (জাতি) সৃষ্টি করলেন, মনুসংহিতা পাঠ করলে তা প্রশ্ন হিসেবেই থেকে যায়। তবে গোটা গ্রন্থে যেখানে যা কিছুই বলা হয়েছে জাতি হিসেবে ব্রহ্মাসৃষ্ট বর্ণগুলোকেই বারবার উল্লেখ করা হয়েছে। যেমন- সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ। মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।

। (১/৮৭) বঙ্গানুবাদ: এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন। অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা। দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ। ।

(১/৮৮) বঙ্গানুবাদ: অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন। প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ। বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ। । (১/৮৯) বঙ্গানুবাদ: প্রজারণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।

পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ। বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ। । (১/৯০) বঙ্গানুবাদ: পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল। অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।

প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ। । (১০/১) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত।

এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ। এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রূষামনসূয়য়া। । (১/৯১) বঙ্গানুবাদ: প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন, -তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা। উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই।

তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ।

সন্দেহ তীব্র হলে নিচের শ্লোকগুলো দেখা যেতে পারে- উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ। সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ। । (১/৯৩) বঙ্গানুবাদ: ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু। ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।

ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে। । (১/৯৯) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন। সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।

শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি। । (১/১০০) বঙ্গানুবাদ: জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন। স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ। আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।

। (১/১০১) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে। ন তং স্তেনা ন চামিত্রা হরন্তি ন চ নশ্যতি। তস্মাদ্রাজ্ঞা নিধাতব্যো ব্রাহ্মণেষ্বক্ষয়ো নিধিঃ।

। (৭/৮৩) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণকে যে ভূমি-অর্থ প্রভৃতি দান করা হয় তা এমনই নিধি (ন্যস্ত সম্পত্তি) যে, সেই নিধি চোরেরা অপহরণ করতে পারে না, শত্রুরা হরণ করতে পারে না, এবং তা নিজেও নষ্ট বা অদৃষ্ট হয় না। এই জন্য রাজার কর্তব্য হল, ব্রাহ্মণগণের কাছে এই অক্ষয় নিধি ন্যস্ত করা। সমমব্রাহ্মণে দানং দ্বিগুণং ব্রাহ্মণব্রুবে। প্রাধীতে শতসাহস্রমনন্তং বেদপারগে।

। (৭/৮৫) বঙ্গানুবাদ: অব্রাহ্মণকে যে বস্তু দান করা হয় তার সমপরিমাণ ফল পাওয়া যায়, তার দ্বারা অতিরিক্ত ফল হয় না। ব্রাহ্মণব্রুবকে (অর্থাৎ যিনি জাতিমাত্রে ব্রাহ্মণ, কিন্তু ব্রাহ্মণোচিত গুণসম্পন্ন নন) দান করলে পূর্বাপেক্ষা দ্বিগুণ ফল লাভ হয়। যে ব্রাহ্মণ বেদাধ্যয়ন আরম্ভ করেছেন, তাঁকে দান করলে লক্ষগুণ ফল লাভ হয়; এবং যিনি সমস্ত বেদশাখাধ্যেতা বেদপারগ ব্রাহ্মণ, তাঁকে দান করলে অনন্ত ফল লাভ হয়। বুঝাই যাচ্ছে, কথিত ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ হতে সৃষ্ট বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই জগদীশ্বরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন।

অতএব কাউকে কর দিয়ে ব্রাহ্মণের চলার কথা নয়। এবং তা-ই মনুসংহিতার পাতায় পাতায় খুব ভালোভাবে জানান দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। মনুশাস্ত্রে রাজার কর্তব্য হিসেবে নিরাপদে রাজ্য পরিচালনার প্রয়োজনেই প্রজাদের কাছ থেকে কর ধার্য্য ও গ্রহণের কথা বলা হচ্ছে- নোচ্ছিন্দ্যাদাত্মনো মূলং পরেষাঞ্চাতিতৃষ্ণয়া। উচ্ছিন্দন্ হ্যাত্মনো মূলমাত্মানং তাংশ্চ পীড়য়েৎ। ।

(৭/১৩৯) বঙ্গানুবাদ: কর, শুল্ক প্রভৃতি গ্রহণ না করে রাজা নিজের মূলোচ্ছেদন করবেন না অর্থাৎ রাজকোষ শূন্য করবেন না; এবং অতিলোভবশতঃ বেশি কর নিয়ে প্রজাদেরও মূল নষ্ট করবেন না। কারণ, এইভাবে নিজের ও পরের মূলোচ্ছেদ ঘটালে নিজেকে এবং প্রজাবর্গকে উৎপীড়িত করা হয়। অতএব কার কাছ থেকে কিভাবে কী পরিমাণ কর আদায় করা হবে তার বিস্তারিত শ্লোক-বয়ান মনুশাস্ত্রে উদ্ধৃত রয়েছে। তবে সাধারণসূত্রে বলা হচ্ছে- যৎ কিঞ্চিদপি বর্ষস্য দাপয়েৎ করসংজ্ঞিতম্। ব্যবহারেণ জীবন্তং রাজা রাষ্ট্রে পৃথগ্জনম্।

। (৭/১৩৭) বঙ্গানুবাদ: যে সব ‘পৃথগ্জন’ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয় ছাড়া অন্য লোক কৃষি, পশুপালন প্রভৃতি কোনও একটি ব্যবহার অর্থাৎ বৃত্তি অবলম্বন করে জীবিকা নির্বাহ করে, তাদের কাছ থেকে রাজা বার্ষিক যৎ কিঞ্চিৎ হলেও কর গ্রহণ করবেন। যে ব্রাহ্মণ কল্পশাস্ত্রের সাথে এক বেদ অথবা ব্যাকরণ প্রভৃতি ছয়টি বেদাঙ্গের সাথে বেদশাখা অধ্যয়ন করেন এবং বেদাধ্যয়নাদি কাজে নিরত থাকেন, তাঁকে ‘শ্রোত্রিয়’ বলা হয়। উপরোক্ত ৭/১৩৭ সংখ্যক শ্লোকে এই বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ ও শ্রোত্রিয়ের কাছ থেকে কোনরূপ কর গ্রহণকে নিরস্ত করা হয়েছে। তবে মনুসংহিতার ১০/১২৯ সংখ্যক শ্লোকের দ্বারা (পরবর্তীতে নিচে বর্ণিত হয়েছে) শূদ্রের ধন-সম্পদ অর্জনকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হলেও শূদ্রের কাছ থেকে কর আদায় নিষিদ্ধ হয়নি।

যেহেতু তার অর্জিত সম্পদ থাকার কথা নয়, তাই এই কর পরিশোধ হবে বাধ্যতামূলক শ্রমদানের মাধ্যমে- কারুকান্ শিল্পিনশ্চৈব শূদ্রাংশ্চাত্মোপজীবিনঃ। একৈকং কারয়েৎ কর্ম মাসি মাসি মহীপতিঃ। । (৭/১৩৮) বঙ্গানুবাদ: পাচক, মোদক প্রভৃতি কারুক এবং কাংস্যকার, লৌহকার, শঙ্খকার প্রভৃতি শিল্পী ও কায়িক পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকানির্বাহকারী শূদ্র- এদের দ্বারা রাজা প্রতি মাসে একদিন করে নিজের কাজ করিয়ে নেবেন। কিন্তু পরধন অর্জনে মত্ত ব্রাহ্মণের কাছে কোনক্রমেই কর নেয়া যাবে না।

অর্থাভাবে রাজা মরণাপন্ন হলেও ক্ষতি নেই, তবু কোন ব্রাহ্মণ যেন রাজার রাজ্যে ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন, এ ব্যাপারে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে- ম্রিয়মাণোহপ্যাদদীত ন রাজা শ্রোত্রিয়াৎ করম্। ন চ ক্ষুধাহস্য সংসীদেচ্ছ্রোত্রিয়ো বিষয়ে বসন্। । (৭/১৩৩) বঙ্গানুবাদ: রাজা ধনাভাবে মরণাপন্ন হলেও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণের কাছ থেকে কখনও যেন কর গ্রহণ না করেন। রাজার রাজ্যে বাস করতে থেকে কোনও শ্রোত্রিয় ব্রাহ্মণ যেন ক্ষুধায় মরণাপন্ন না হন।

মনুসংহিতার পরতে পরতে উচ্চবর্ণ ব্রাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও ক্ষমতা প্রদান আর নিম্নবর্ণ শূদ্রের নিচত্ব ও তাকে বঞ্চনা করার কৌশল বিভিন্নভাবে বিভিন্নরূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে উপস্থাপিত হয়েছে। যেমন, রাজকার্যে ও বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় ক্রিয়া-অনুষ্ঠানে সবাইকে উদ্ধারের নিমিত্তে ক্ষমতাসীন পরামর্শক ব্রাহ্মণের উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। প্রয়োজনীয় গুণ ও যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক ব্রাহ্মণ হলেই হলো, এবং তা-ই হতে হবে। কিন্তু যত যোগ্যতা বা গুণের আধারই হোক শূদ্রকে কিছুতেই নিয়োগ মর্যাদা দেয়া যাবে না। জাতিমাত্রোপজীবী বা কামং স্যাদ্ব্রাহ্মণব্রুবঃ।

ধর্মপ্রবক্তা নৃপতের্ন তু শূদ্রঃ কথঞ্চন। । (৮/২০) বঙ্গানুবাদ: বিদ্যা ও গুণসম্পন্ন ব্রাহ্মণের অভাব হলে রাজা জাতিমাত্রোপজীবী অর্থাৎ জাতিসর্বস্ব ব্রাহ্মণকে অথবা ক্রিয়ানুষ্ঠানবিহীন ব্রাহ্মণব্রুবকেও (অর্থাৎ নামে মাত্র ব্রাহ্মণকেও) নিজের ধর্মপ্রবক্তার পদে (শাস্ত্রীয় আইন বিশ্লেষক) নিযুক্ত করবেন, কিন্তু শূদ্র যদি সর্বগুণসম্পন্ন, ধার্মিক এবং ব্যবহারজ্ঞও হয়, তবুও তাকে ঐ পদে নিয়োগ করতে পারবেন না। শাস্ত্র বিশ্লেষকদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ব্রাহ্মণকেই ধর্মপ্রবক্তা করার বিধান থাকায় বিদ্বান্ ব্রাহ্মণকেই ঐ কাজে নিযুক্ত করতে হয়। কাজেই ক্ষত্রিয় প্রভৃতি অন্য তিন বর্ণের লোককে ধর্ম নিরূপণের কাজে নিযুক্ত করা নিষিদ্ধ।

তবুও এখানে শূদ্রকে ঐ কাজে নিয়োগ করতে নিষেধ করার তাৎপর্য হলো, ঐ কাজের জন্য উপযুক্ত বিদ্বান ব্রাহ্মণ পাওয়া না গেলে ক্ষত্রিয় বা বৈশ্যকে ঐ কাজে হয়তো নিয়োগ করা যেতে পারে, কিন্তু কিছুতেই শূদ্রকে নয়। এই ব্রহ্মবিধি ভঙ্গ হলে কী পরিণতি হবে তাও মনুশাস্ত্রে ব্যাখ্যা করা হয়েছে- যস্য শূদ্রস্তু কুরুতে রাজ্ঞো ধর্মবিবেচনম্। তস্য সীদতি তদ্রাষ্ট্রং পঙ্কে গৌরিব পশ্যতঃ। । (৮/২১) বঙ্গানুবাদ: বিচারসভায় যে রাজার সাক্ষাতে শূদ্র ন্যায়-অন্যায় ধর্ম বিচার করে, সেই রাজার রাজ্য কাদায় নিমগ্ন গোরুর মতো দেখতে দেখতে নষ্ট হয়ে যায়।

যদ্রাষ্ট্রং শূদ্রভূয়িষ্ঠং নাস্তিকাক্রান্তমদ্বিজম্। বিনশ্যত্যাশু তৎ কৃৎস্নং দুর্ভিক্ষব্যাধিপীড়িতম্। । (৮/২২) বঙ্গানুবাদ: যে রাজ্য ধর্মাধিকরণে (বিবাদ নিরূপণের ব্যাপারে-) শূদ্রের প্রাধান্য ও নাস্তিকদের প্রভুত্ব, এবং যেখানে দ্বিজগণের (ব্রাহ্মণদের) অভাব, সেই রাজ্য দুর্ভিক্ষ ও নানারকম রোগে পীড়িত হয়ে অতি শীঘ্রই বিনষ্ট হয়। অপরাধ সংঘটন হলে রাজার বিচারে দণ্ড প্রয়োগের ক্ষেত্রে মনুসংহিতার ৮/৩৭৯ সংখ্যক শ্লোক অনুযায়ী শাস্ত্রের বিধান হলো- প্রাণদণ্ডের যোগ্য অপরাধেও ব্রাহ্মণের এই দণ্ড বা অঙ্গচ্ছেদনাদি করা যাবে না।

যদিও অন্যান্য বর্ণের পক্ষে বধাদি প্রাণদণ্ডই বিধেয়। এছাড়া মনুশাস্ত্রে আরো বলা হচ্ছে- ন জাতু ব্রাহ্মণং হন্যাৎ সর্বপাপেষ্বপি স্থিতম্। রাষ্ট্রাদেনং বহিষ্কুর্যাৎ সমগ্রধনমক্ষতম্। । (৮/৩৮০) বঙ্গানুবাদ: ব্রাহ্মণ যে কোনও পাপ বা অপরাধই করুক না কেন (যত কিছু অপরাধ আছে সে সবগুলি একসাথে অনুষ্ঠান করলেও) রাজা তাকে হত্যা করবেন না; পরন্তু সমস্ত ধনের সাথে অক্ষত শরীরে তাকে রাষ্ট্র থেকে নির্বাসিত করবেন।

কারণ- ন ব্রাহ্মণবধাদ্ ভূয়ানধর্মো বিদ্যতে ভুবি। তস্মাদস্য বধং রাজা মনসাপি ন চিন্তয়েৎ। । (৮/৩৮১) বঙ্গানুবাদ: এই পৃথিবীতে ব্রাহ্মণবধের তুলনায় গুরুতর অধর্ম (অর্থাৎ পাপ) আর কিছুই নেই। এই কারণে ব্রাহ্মণকে বধ (এবং অঙ্গচ্ছেদনাদি) করার কথা রাজা কখনও মনে মনেও চিন্তা করবেন না।

(চলবে...) [পরের পর্ব: ৩/৮]
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।