বাংলায় কথা বলি,বাংলায় লিখন লিখি, বাংলায় চিন্তা করি, বাংলায় স্বপ্ন দেখি। আমার অস্তিত্ব জুড়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ।
২০০৪ সালের কথা। আমি তখন গ্রামের একটি বেসরকারী কলেজে মাস্টারী করি। সকাল সাড়ে নয়টায় আমার প্রথম ক্লাস।
জয়পাড়া থেকে লৌহজং এর ঘৌড়দৌড় (স্থানীয় বাসিন্দারা বলে ঘোড়া দৌড়) পৌছে ক্লাস নিতে হয়। তাই আমি অনেক সকালে উঠে তৈরী হই। তারপর দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে দোহার থেকে রওয়ানা দিয়ে মাঝখানে আরেকটি উপজেলা শ্রীনগরকে ফেলে লৌহজং উপজেলায় গিয়ে ক্লাস নিই।
ঘুমাই অনেক রাতে। কোন কোন দিন ঘুমাতে রাত তিনটাও বেজে যায়।
কারণ জয়পাড়া বাজারে গিয়ে আড্ডা মেরে বাড়িতে ফিরতে রাত ১২ টা বাজে। চাকরির পরীক্ষার জন্য কিছু কিছু পড়াশোনা করতে হয়। তাই তাড়াতাড়ি ঘুমানোর নিয়ম আমার মাঝে ছিল না। ফলে অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠা আমার জন্য অনেক অনেক কষ্টকর একটি ব্যাপার ছিল। তারপরও কোন উপায় ছিল না বলেই প্রতি দিন সকালে উঠতে হত।
অনেক অনেক আগে বাজার বসত দুপুরে। কিন্তু কোন এক অজানা কারণে দোহারের সবর্ত্র সকালের বাজার চালু হয়েছে। এক সময় উত্তর জয়পাড়ার চৌধুরী বাজারটাই ছিল এক মাত্র সকালের বাজার। কালক্রমে দোহার উপজেলার সর্বত্র এখন সকালে এক বার বাজার বসে। আর বড় বড় বাজার গুলো আগের নিয়মে চলে।
সকালে বাজার বসার প্রধানতম কারণ হল যাতে সকালে বাজার করে দুপুরের খাবারটা টাটকা খাওয়া যায়। সকালে বাজার থেকে তাজা শাক সবজি মাছ তরকারী কিনে আনার পর দুপুরের খাবারটা সমৃদ্ধ করাই সকালের বাজারের উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য সফল এবং দোহারে সকালের বাজার এখন প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে । সকালের বাজারেই এখন বেশী কেনাবেচা হয়।
হেঁটে জয়পাড়া থানার মোড়ের বাজারে যেতে তখনো ৫ মিনিটের পথ বাকি আছে।
হঠাৎ দেখি রাস্তার পাশে ১০/১১ বছরের একটি বালিকা। অনেক বড় সড় একটি বোঝা নামিয়ে রাস্তার পাশে বসে বসে জিরুচ্ছে। তার বিশ্রাম নেয়া শেষ। এবার বাজারে যাবার পালা। কিন্তু সাথের বিশাল বোঝাটি মাথায় তুলে নেয়া তার একার পক্ষে সম্ভব নয়।
কারো সাহায্য লাগবে। কিন্তু রাস্তায় যারা যাচ্ছে তারা সবাই ভীষণ ব্যস্ত। কেউ বা পরিপাটি পোশাকে চলেছে। হেটে যাচ্ছে কম। সবার হাতে কাচা টাকা থাকাতে হেটে যাবার লোক কম।
নিতান্ত গরীব ছাড়া কেউ আর হেটে চলাচল করতে চায় না। বালিকাটি তাই অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে কে তার বোঝাটি তার মাথায় তুলে দেবে। কাউকে বলার মতো সাহসে সে সঞ্চয় করতে পারছে না।
হেটেই পথ চলি আমি । তবে শার্টপ্যান্ট পরা ভদ্র লোক দেখে বালিকাটি সাহস পেল না তার বোঝাটি তার মাথায় তুলে দেবার কথা বলতে।
ব্যাপারটি আমার নজরে এলো । নিতান্তই গায়ে পড়ে বালিকাটির বোঝাটি তার মাথায় তুলে দিলাম। সে খুশী মনে বাজারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিল।
পাঠক, ১০/১১ বছরের যে বালিকাটি সকাল বেলায় অনেক বড় সড় একটি বোঝা মাথায় নিয়ে বাজারে যাচ্ছিল এই টি যেমন সত্য তেমনি ঐ পথে আরো অনেক অনেক বালিকা কেউ বা রিক্সায়, কেউবা তার বাবার হোন্ডায় চেপে স্কুলে যাচ্ছিল। এই বয়সটিই স্কুলে যাবার বয়স।
মাথায় বিরাট একটা বোঝা নিয়ে বাজারে যাবার বয়স নয়। তাহলে বালিকাটি কেন এই বয়সে সাত সকালেই পেটের অন্ন যোগানোর জন্য মাথায় বোঝা চাপিয়ে বাজারে যাচ্ছে? কেন সে স্কুলে যেতে পারছে না? নাকি স্কুলে যেতে তার ভাল লাগে না?
আমার প্রিয় বাংলাদেশ যেখানে অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থান-চিকিৎসা-শিক্ষার কোন নিশ্চয়তা নেই যেখানে লাখ লাখ শিশু কিশোর খেতে পায় না। সেখানেই আবার অনেক শিশু-কিশোর আছে যাদের সামনে খাবারে প্লেট সব সময় ধরা থাকে। কিন্তু তারা খেতে চায় না। তাদেরকে ঘুমপাড়ানী গান গাইয়ে তবেই না খাওয়াতে হয়।
এখনো দেশের লাখ লাখ শিশু কিশোরের প্রিয় জিনিস ভাত। কারণ তারা পেট পুরে খেতে পায় না। খাবারের জোগান তাদের নিজেদেরকেই করতে হয়। আগে তো ভাত। তারপর না ইশকুল!
ঘটনাটি অনেক দিন আগের ।
তারপরও মাঝে মাঝে মনে পড়ে ঘটনাটি। একুশ শতকে এসেও একটি দেশের শিশু-কিশোররা কেন স্কুলে যেতে পারবে না? কেন তাদের ভাতের চিন্তা তাদেরকেই করতে হবে?????
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।