জিনে ধরেছে, তাই জিন ছাড়াতে আট বছরের শিশু রাব্বিকে প্রথমে ঝাড়–পেটা এবং পরে তার গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয় বাগমারার দাউদপুরের ভ-পীর ওয়াহেদ। শিশুটি আর্তচিৎকার করলেও পীরের চেলারা দাহ্য পদার্থভর্তি ছোট্ট পানির গর্তে কলাগাছের সঙ্গে তাকে শক্ত করে বেঁধে রাখে, যাতে ছুটে যেতে না পারে। পানিতে ছড়ানো আগুনে শেষতক পুড়ে জ্ঞান হারালে রাব্বির অভিভাবক তাকে নিয়ে ছুটে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এরপর তাকে স্থানান্তর করা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। এ বর্বর ঘটনাটি করেছে গত ২০ অক্টোবর রাতে।
ভ-পীরের চিকিৎসার নামে এমন বর্বরতার শিকার হয়ে শিশু রাব্বি এখন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছে।
কী হবে এখন ছেলেটির? চিকিৎসার জন্য টাকা কোত্থেকে মিলবে? শেষমেশ ছেলেটি সুস্থ হবে তো?Ñ এমন নানা প্রশ্নে উদ্বিগ্ন রাব্বির পরিবার ও স্বজনরা। গত মঙ্গলবার ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে এ প্রতিবেদকের।
রাব্বির নানা আবদুল মতিন জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় চিৎকার করতে করতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে রাব্বি। উৎকণ্ঠিত অভিভাবকরা ওই রাতেই তাকে নিয়ে যান রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে নিশ্চিত হন, রাব্বি সেরেব্রাল ইডেমা (মাথায় পানি জমা) রোগে আক্রান্ত। টানা ছয়দিন নিবিড় পরিচর্যা ও চিকিৎসার পর অচেতন রাব্বির জ্ঞান ফিরে আসে। সুস্থ হয়ে উঠতে থাকে ধীরে ধীরে। চিকিৎসকরা জানান, আর কয়েকদিন গেলেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠবে রাব্বি। কিন্তু তার বাবা দরিদ্র ভ্যানচালক কাওছারের পক্ষে ছেলের চিকিৎসার ব্যয়ভার বহন করা কঠিন হয়ে পড়ে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে না জানিয়েই তিনি ছেলেকে বাড়ি নিয়ে যান। গ্রামের এক প্রতিবেশীর পরামর্শে অল্প খরচে ছেলের চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে যান বাগমারার দাউদপুরে ভ-পীর ওয়াহেদের কাছে।
ভ-পীর ওয়াহেদ শিশু রাব্বিকে দেখেই বলে ওঠে, ‘ওরে জিনে ধরেছে। ওর জিন ছাড়াতে অনেক ঝামেলা করতে হবে। কিন্তু জিন না ছাড়ালে ওই নিজেও বাঁচব না, পরিবারের কাউরে বাঁচতে দিব না।
’ পীরের এ কথা শুনে আঁতকে ওঠেন কাওছার ও তার স্ত্রী আঙ্গুর বেগম। বুকের সন্তানকে সুস্থ করে তুলতে ধারকর্জ করে পীরের হাদিয়া জোগাড় করেন। কিন্তু নিরক্ষর সহজ-সরল এ দম্পতি তখন ভুলেও চিন্তা করেনি, ভ-পীর আসলে তাদের সন্তানকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিচ্ছে।
রাব্বির নানা আবদুল মতিন আরো জানান, পীরের কথামতো ২০ অক্টোবর রাতে রাব্বিকে তার বাবা-মাসহ নিকটাত্মীয়রা নিয়ে যান পীরের আস্তানায়। সেখানে জিন ছাড়ানোর নামে রাব্বিকে ঝাড়– দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ পেটানো হয়।
সন্তানের বুকফাটা কান্না সহ্য করতে না পেরে মা আঙ্গুর ছেলেকে নিয়ে পীরের আস্তানা ছেড়ে যেতে চাইলে পীরের দুই চ্যালা সঙ্গে সঙ্গে রাব্বিকে ছিনিয়ে নেয়। এরপর পীর ওয়াহেদ এসে আবারো কয়েক দফা তাকে ঝাড়–পেটা করে। এ সময় রাব্বি আর্তচিৎকার করলেও ভ-পীর ওয়াহেদ কৃতিত্বের হাসি হেসে বলেছে, ‘জিনে ডরাইছে। এবার ঠিকই ওরে ছাড়ব। তবে এমনি ও (জিন) ছাড়ব না।
ওরে আগুন দিয়া তাড়াইতে হইব। ’
এরপরই শুরু হয় চিকিৎসার নামে ভ-পীরের বর্বরতা। তার আস্তানার উঠানে প্রায় ছয় ফুট ব্যাসার্ধের একটি গর্ত খোঁড়া হয়। এর মাঝখানে একটি কলাগাছ পুঁতে ওই গর্ত পানিতে পূর্ণ করে পীরের চ্যালারা। মধ্যরাতে রাব্বিকে ওই কলাগাছের সঙ্গে বেঁধে গর্তের চারপাশে মোমবাতি জ্বালানো হয়।
এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়ে রাব্বি শরীরের বাঁধন আলগা করে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। এ সময় তার খালু ইসমাইল ওরফে বাবুকে নির্দেশ দেয়া হয়, তাকে কলাগাছের সঙ্গে চেপে ধরে রাখতে।
তারপর ভ-পীর ওয়াহেদ আত্মীয়স্বজনকে জানায়, জিন ছাড়াতে সে চোখ বুজে ধ্যানে বসবে। জিন ওকে ছেড়ে যাওয়ার সময় পানিতে আগুন ধরে যাবে। এতে কারো ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
এ কথা বলে ওয়াহেদ তার আস্তানার ভেতরে ঢুকে পড়ে। রাব্বিকে পাহারায় থাকে তার দুই চ্যালা।
রাব্বির খালু ইসমাইল জানান, গর্তের চারপাশের মোমবাতি কিছু সময় জ্বলার পর আকস্মিক তা পানিতে ছড়িয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যেই তার দুই পা ও রাব্বির কোমরের নিচের পুরো অংশ পুড়ে যায়। এ সময় তিনি রাব্বিকে নিয়ে সরে আসতে চাইলে পীরের চ্যালারা তাকে নিষেধ করে।
এ আগুনে কোনো ক্ষতি হবে না বলেও আশ্বাস দেয়। পীরের কথামতো ইসমাইল শিশুটিকে শক্ত করে কলাগাছের সঙ্গে চেপে ধরে রাখেন। কিন্তু নিজের শরীরেও আগুন ছড়িয়ে পড়তে শুরু করলে ইসমাইল পীরের ভ-ামি বুঝতে পারেন। তিনি অজ্ঞানপ্রায় রাব্বিকে নিয়ে দ্রুত পীরের আস্তানা থেকে বেরিয়ে আসেন। কিন্তু ততক্ষণে তাদের দু’জনের শরীরেরই নিম্নাংশ পুড়ে গেছে।
স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাদের রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে রাব্বিকে পাঠানো হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে। সেখানে এখন চিকিৎসা চলছে রাব্বির। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার শরীরের প্রায় ২০ শতাংশ পুড়ে গেছে। ছোট্ট শরীরের এ ক্ষত সারতে অনেক ভোগান্তি পোহাতে হবে।
এদিকে বর্বরোচিত এ ঘটনায় বাগমারা থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। পুলিশ গত সোমবার ভ-পীর ওয়াহেদকে গ্রেপ্তার করেছে। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে ওয়াহেদ তার বর্বর চিকিৎসার কথা স্বীকার করেছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা জানান, গর্তে আগেই কেরোসিন বা দাহ্য কোনো পদার্থ ঢেলে রাখা হয়েছিল। পরে তাতে পানি ঢেলে চারপাশে মোমবাতি ধরানো হয়।
অল্প কিছুক্ষণ পর দাহ্য পদার্থ পানির ওপর ভেসে উঠলে তাতে আগুন ধরে যায়। ওই আগুনেই রাব্বি ও তার খালু ইসমাইল পুড়েছে। অলৌকিক কেরামতি দেখানোর জন্যই এ কৌশল করা হয় বলে ওয়াহেদ স্বীকারও করেছে।
স্থানীয়রা জানান, দীর্ঘদিন ধরে ওয়াহেদ নিজেকে কবিরাজ দাবি করে বিভিন্ন রোগের চিকিৎসার নামে অপচিকিৎসা করে আসছিল। সম্প্রতি সে কবিরাজ খেতাব ছেড়ে পীর খেতাব নিয়ে কবিরাজি চিকিৎসার পাশাপাশি জিন-ভূত ছাড়ানোসহ নানা উদ্ভট চিকিৎসা করে সহজ-সরল মানুষকে ধোঁকা দিয়ে আসছিল।
যন্ত্রণায় কাতর শিশু রাব্বি জানায়, ‘আগুন লাগার সময় খুব ডর (ভয়) পাইছিলাম। আব্বারে বারবার বলছি, আমার শরীরে আগুন দিতে না করো। আব্বাও কিছু না বলায় কবিরাজ ব্যাটা শরীরে আগুন লাগায় দিছে। আমি আর পারতাছি না, আমি মইরা যামু...। ’
বার্ন ইউনিটের ডাক্তার মাহবুব আলম জানান, ‘রাব্বিকে উন্নত চিকিৎসা করালে সে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠবে।
তার কোমরের নিচে প্রায় ২৫ শতাংশ পুড়ে গেছে। দুই-তিনটি অপারেশন করতে হবে। বৃহস্পতিবার প্রথম অপারেশন করার কথা। আশা করেন, অল্প সময়ের মধ্যে রাব্বি সুস্থ হয়ে উঠবে। গ্রামাঞ্চলের কুসংস্কারাচ্ছন্ন সরল মানুষ নানা ধোঁকাবাজের খপ্পরে পড়ে।
জীবন বিপন্ন হয় এসব সরল ও শিক্ষাবঞ্চিত মানুষের। শিশু রাব্বি তারই নির্মম শিকার।
বাগমারা থানা অফিসার ইনচার্জ জানান, ভ- কবিরাজের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হওয়ার পর সে আত্মগোপনে ছিল। সোমবার রাতে বাগমারা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
View this link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।