নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
কিছুদিন আগে নিরুদ্দিষ্ট হওয়া মানুষটির মানিব্যাগে বেশ অনেকগুলো তাজা নোট ছিল। চেইনটা খোলা, নোটগুলো অন্য ব্যাগে বেড়াতে গেছে দাফনের আগে। কেউ একজন দখল করে নিয়েছে ভাগ্য-ফেরানো তোপাজের আংটি। যেখানে ঘুমাতো সেখানটা শূণ্য পড়ে নেই। উকিল মোটা পয়সা নিয়ে মেপে দিয়ে গেছে জমিজমা, দালানের হিসাব।
যে দামী গাড়িটা কিনে সে পরিতৃপ্ত হয়ে কাচ তুলে দেখতো গরীব রিক্সাওয়ালাদের, অথবা গাড়িহীন বন্ধুদের লিফট দিয়ে সুখ পেতো সেটা আছে। তার জায়গায় তার স্ত্রী বসে। পাশের জায়গায় অন্য মানুষ। অফিসের এই চেয়ারে আয়েশ করে বসতো, চুমুক চুমুক কফি খেত। আরেকটা "সে" চেয়ারটাতে বসে আছে।
দেয়ালে সোনালী ফ্রেমের পারিবারিক ছবিগুলো বদলে সেই সে'র পরিবার ঝুলছে।
কখনো রাতে একা হয়ে লোকটা বারান্দায় বসতো। পুরনো স্মৃতি ঘেঁটে সুখ পেত। প্রতিযোগিতায় নিজেকে সরল করে ফেলতে চাইতো। পাইপের ধোঁয়ায় নিজেকে আড়াল করে ফেলতে চাইতো।
বিষন্ন হয়ে মরে যেতে চাইতো। অথচ মৃত্যুর ইচ্ছেটা ছিল নিছক বিলাসিতা। সে বাঁচার অক্সিজেনে সতেজ হতেই বারান্দায় আসতো। যেদিন একটু বেশী পয়সা আসতো, তার পদোন্নতি হতো, পুরষ্কার পেত, খ্যাতি আসতো সে বারান্দাটা ভুলেই যেত - বারান্দা সে কথা এখনো ভোলেনি।
দুর থেকে সব বারান্দাই এক।
সমস্ত বারান্দাতে চেয়ার পাতা থাকে। সব বিনিদ্রদেরই রাতে এক দেখায়। যদিও শোয়ার রুম কারো চারকোনা কারো আয়তক্ষেত্র। তার বাথরুমে বাইরে থেকে একটা বাতি দেখা যাচ্ছে কিন্তু সে মানুষটা সেখানে নেই। যে আয়নায় চুলের চেকনাই দেখতো, চোখের বলীরেখায় উদ্বিগ্ন হতো, মজবুত দাঁতে টুথব্রাশ ঘষে নিতো।
তারপর নেয়ার বেঁধে নিতো রাতের পোষাকের। পোষাকটা থাকতো ভাল ব্র্যান্ডের। তারপর ডিম লাইটের মৃদু অন্ধকারে মানুষটা কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুমিয়ে পড়তো যেমনটা পৌষের রাতে সদরঘাটে হলুদ স্ট্রীট ল্যাম্পের নিচে রিকশার সীটে ক্লান্ত চালক লুঙ্গী মুড়ে ঘুমায়।
তার মাথায় অনেক কিছু পড়ে ছিল পরের দিনের জন্য। কাগজে লিখে রেখেছিল ব্যাঙ্কে যাওয়া, সেখানে অর্থ তোলা, নতুন একটা ভাল স্যুট বানানো, ছেলেমেয়ের জন্য ভাল কিছু কেনার কথা।
সে কাগজগুলো পড়ার কেউ নেই। আর তার সন্তানেরা তাদের মতোই চলছে। মৃত বাড়িটা পবিত্র করতে ভাল করে বাড়ি পরিষ্কার করা হয়েছে। বাড়িতে প্রথামত যে কোরানখানি হওয়ার কথা ছিল, সেটা ভালভাবে হয়েছে। খুব পরহেজগার কিছু মানুষ পয়সা গুনে তৃপ্ত হয়ে চলে গেছে অন্য মরার বাড়িতে।
সে কি ভেবেছিল মরহুম লেখা নেমপ্লেট ঝুলবে তার বাড়িতে? সময় বাঁচাতে নগন্য এক লোকের মৃত্যুসংবাদ কপি করে পত্রিকায় শোকবার্তা পাঠানো হবে। আর না পড়া অনেক খবরের ভিড়ে তার মৃত্যুর খবরটা অনেকে জানবেই না। অবশ্য সে সৌভাগ্যবান তার মৃত্যুতে প্রার্থনার কমতি হয়নি। এমন কি মৃত্যুতে খুশী হওয়া লোকজনও মোনাজাত ধরেছে - চিরবিদায়ের স্টোরের মালিক, বাজারের মাংস বিক্রেতা, ডেকোরেটর, কলহপ্রিয় প্রতিবেশী এবং অনেকে । কুলখানির অতিথিদের জন্য ঝুলানো খাসীর দেহ থেকে কসাই চামড়া ছিলে নিচ্ছিলো বড় ছুরিতে।
যেমন ছুরি লোকটা দেখেছিল পথে আসতে। সেই ছুরি তাকে খুব ভীত করেছিল বলে ছিনতাইকারীকে দামী রোলেক্স ঘড়িটা তুলে দিয়েছিল। ঘড়িটা সময়ের চেয়ে দামী ছিল। লোকটা ভীতুই বলা চায়, মরতে চায়নি। ব্যথাও চায়নি।
সে সামান্য সুঁচ বিঁধলে সহ্য করতে পারতো না। অথচ সে অনায়াসে মরে গেছে।
তার ঘুম দরকার ছিল। ডাক্তারের চেম্বার বদলেছে। অষুধ বদলেছে।
মাস ধরে পাতা পাতা নিদ্রাবটিকা খেয়েও দুশ্চিন্তা দুর করতে পারেনি। টেবিলে পড়েছিল আধাশেষ হওয়া সিডাক্সিনের পাতা। সে কি জানতো এই ব্যর্থ অষুধের পাতার পরদিন থেকে তার ঘুমাতে কোন কষ্টই হবে না? ঘুমাতে যাওয়ার সময় জীবনে কিছু পায়নি বলে যে মনস্তাপ ছিল সেটা আর হবে না। যে জমিগুলো পড়ে আছে সেখানে বাড়ি করার ইট-কাঠ-সুরকীর ভাবনা ঘুরে বেড়াবে না। মানিব্যাগের ভিতরেই ছোট ক্যালকুলেটর থাকতো।
যে ক্যালকুলেটর নগদের হিসাবটা শূণ্যের পর তিন দশমিক পর্যন্ত নিখূঁত বলে দেয়। অথচ সেই নগদ অঙ্কের গণকের ব্যাটারীও মরে যাবে তার মতো।
নগদ কোন কিছুই নেই। যেখানে সে নিজেই নেই। বিনিয়োগের পড়তি চার্টের মতো সময়ে বাকি কান্নাগুলো সরল রেখায় মিশে যাচ্ছে।
মুদ্রার বদলী মুদ্রা আসে। কে মনে রাখে টাকার সিরিয়াল? আর জীবন তো মা নয় অযথা সন্তানকে আলাদা আঁকড়ে রাখবে। যদিও মফস্বলে পড়ে থাকা মায়ের দেহটা পড়ে ছিল উপুর হয়ে খাটের ওপর, খুব সাধারণ হয়ে। ঠিক তার মতই।
*
বাড়ির ঘুল ঘুলিতে একটা চড়াই বাসা বেঁধেছিল ।
কারো নজরে আসেনি বলে বাসাটা ভেঙে দেয়া হয়নি। কিচির মিচির করে সে খেলতো বাড়ির পাশের গাছে। সে জানে পাখীদের খুদরুটি ছাড়া আর কিছু চাওয়া নেই। লোকটার সঙ্গে পরিচয়ের দিন অন্যমনস্কভাবেই মানুষটা চায়ের অবশিষ্ট বিস্কিটটা খেতে দিয়েছিল চড়াইটাকে। দ্বিতীয় দিন ক্ষুধায় কিচির মিচির করছিল দেখে ছুড়ে দিয়েছিল রুটির অংশ।
সে উপকার থেকে পাখীটা মানুষটাকে ভালবেসে ছিল। বহুদিন পর সে মনে রাখে তাকে। লোকটার নাম পদবী কিছুই সে জানে না। সে জানতো মানুষেরা নিরুদ্দেশে যায়, মরে না। আর হয়তো এজন্য মানুষটা থাকে আড়ালে।
চড়াইটা ভাবছিল লোকটা ঠিকই ফিরে আসবে হঠাৎ কোনো এক সকালে। ভাল দু'চারটে কাজ থাকলে মানুষেরা সাধারণত আবার ফিরে আসে।
---
ড্রাফট ১.৫
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।