সেদিন রাতে উর্মী লতাকে মোবাইল করল।
কয়েকবার রিং হওয়ার পর মোবাইল রিসিভ হলো, হ্যালো।
উর্মী ছোট বাচ্চার কণ্ঠস্বরশুনে জিজ্ঞেস করল, কে তুমি?
এটা লতার মোবাইল না?
হ্যাঁ, লতা আপুকে চাচ্ছেন, লতা আপু ভাত খাচ্ছে।
আচ্ছা আমি পরে রিং করব।
উর্মী চিনতে পেরেছে মোবাইল রিসিভ করেছিল তারই সৎ মা’র ছেলে।
উর্মীর মনটা বেদনায় ভরে গেল।
আজকের যে ছেলেটি মোবাইল রিসিভ করেছিল সে তখন মাতৃগর্ভে ছিল। কয়েকদিন আগে আলট্রাসনোগ্রাম করে সবাই কনফার্ম হয়েছিল মিথিলার গর্ভে পুত্র সন্তান দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর একথা জানার পরই মোস্তাফিজ সাহেব যেন তার প্রতি আরও বেশি যত্নবান এবং তার অনুগত হয়ে পড়েছিলেন।
মায়া বাড়ীতে ঢুকেই তার বাবাকে সবকিছু খুলে বলেছিল কিন্তু মোস্তাফিজ সাহেব কিছু বলবার আগেই মিথিলা বলেছিল, তুমি হাতটা একটু ছোট কর, এখন আর শুধু দু’মেয়ে নাই যে বিয়ে দিলেই সব ঝামেলা মিটে যাবে, যা কিছু কর আমার ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে কর।
মায়া অবাক হয়ে গিয়েছিল। মেয়ের সংসার ভেঙ্গে যাচ্ছে আর বাবা আছে তার অনাগত সন্তানের ভবিষ্যত গড়ার জন্য। মোস্তাফিজ সাহেবের উচিত ছিল মায়ার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে সমাধানের ব্যবস্থা করা কিন্তু তিনি উল্টা মায়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করছিলেন, দেখ্ মা, আমার সংসারের অবস্থা যে খুব ভাল তা না, আগে তোরা দু’বোন ছিলি এখন তোর আরো একজন ভাই আসছে তার ভবিষ্যতের জন্যও তো কিছু রেখে যেতে হবে তাছাড়া লতার বিয়ের জন্য পাত্র খোঁজা হচ্ছে, পাত্র পেলে ওরও বিয়ে দিব, একসঙ্গে এতগুলো ঝামেলা আমি কি করে সামলাব বল্?
তাহলে আমি কি করব বাবা?
মিথিলা যেন তেলেবেগুনে জ্বলে উঠেছিল, তুমি কি করবে সেটা তুমি জানো, আমার মা বলতো বিয়ে হওয়ার পর মেয়েদের আর বাপের বাড়ীতে কোন অধিকার থাকে না, তাকে তখন শ্বশুরবাড়ীর লোকজনের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হয়, দেবর-ননদ থাকতে পারে তারা দু’য়েক কথা বলতেই পারে, শ্বশুর-শ্বাশুড়ী সংসারের গার্জিয়ান তারা একটু-আধটু শাসন করতেই পারে এসব মেনে নিয়েই সংসার করতে হয়। জামাইর হয়ত এখন ব্যবসা একটু মন্দা যাচ্ছে সেজন্য কিছু টাকার জন্য তোমাকে বলেছে, সেটা তুমি ম্যানেজ করে চলতে পার না, স্বামী, দেবর-ননদ কি বলল আর তুমি সোজা বাপের কাছে চলে আসলে টাকা নিতে, বাপের দিকটা একবারও দেখলে না?
বাবা আমি তোমার বড় মেয়ে আমাকে তুমি খুব স্নেহ করতে, তুমি হঠাৎ করে কেন এমন হয়ে গেলে বাবা? তোমাকে চিনতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাবা?
মোস্তাফিজ সাহেব কিছু বলেননি।
মিথিলা আবার বলতে শুরু করেছিল, তোমার বাবা আর তোমার জন্য কি করবে? বিয়ের পর মেয়েদের জন্য বাবা-মা’র আর কিছু করার থাকে না।
মায়া তুমি ডিমান্ডের জন্য আর কোনদিন এ বাড়ীতে আসো না, মেয়ে-জামাই আসবে আমরা আপ্যায়ন করব কিন্তু তুমি আর কোনদিন ডিমান্ডের জন্য এ বাড়ীতে আসো না।
মায়া রুদ্ধ কন্ঠে বলেছিল, বাবা তোমারও কি একই কথা?
মোস্তাফিজ সাহেব চুপ করে বসেছিলেন।
তুমিও জেনে রাখ বাবা, আমি আর কোনদিন ডিমান্ডের জন্য তোমার কাছে আসব না। শ্বশুরবাড়ীতে যদি ডিমান্ডের জন্য বিন্দুমাত্র নির্যাতিত হই তবে আমি আত্মহত্যা করব এবং আমার মৃত্যুর জন্য শুধু তুমি দায়ি থাকবে, বলে মায়া বাপের বাড়ী থেকে চলে এসেছিল।
পিছন থেকে মিথিলা বলেছিল, একথা সবাই বলে দুনিয়াতে যত মানুষ আত্মহত্যা করতে চায় সবাই যদি আত্মহত্যা করতো তবে পৃথিবীতে মানুষ কমে যেত।
মায়া বাপের বাড়ী থেকে শ্বশুর বাড়ীতে ফিরবার কিছুক্ষণ পরেই রেহানা বাড়ীতে ঢুকেছিল। অবস্থাটা এমন ছিল যেন সবাই মায়ার বাপের বাড়ী থেকে টাকা নিয়ে আসার অপেক্ষায় ছিল।
মায়া সোজা তার ঘরে গিয়ে ঢুকেছিল।
কয়েকমিনিট পরেই তার শ্বাশুড়ী ডাক দিয়েছিল, বউ মা, বাইরে আসো।
তার শ্বাশুড়ীর ডাকে মায়ার বুক কেঁপে উঠেছিল।
সে ধীর পদে সামনে গিয়ে অপরাধীর মতো দাঁড়িয়েছিল।
বউ মা টাকা নিয়ে এসেছ?
মায়া মৃদু কন্ঠে বলেছিল, না মা।
রেহানা বলেছিল, তবে তুমি আসলে কেন?
মায়া কোন কথা বলেনি।
তার শ্বাশুড়ী রাগান্বিতকন্ঠে বলেছিল, কথা বলছ না কেন?
কি বলব মা?
রেহানা আবার বলেছিল, টাকা নিয়ে আসতে পারনি তবে তুমি আসলে কেন?
আমি কোথায় যাব আপা? বাবা বিয়ে দিয়ে সমস্ত দায়িত্ব থেকে মুক্তি নিয়েছেন, বাবার বাড়ীর দিকে ফিরে তাকাবার আর কোন অধিকার নাই। এখন স্বামীর ঘরই আমার ঘর, মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত আমি কোথাও যাব না আপা।
মায়ার শ্বাশুড়ী বলেছিল, তবে মরে গেলেই তো পার, তুমিও মুক্তি পাও, আমরাও বেঁচে যাই।
আপনিও একথা বললেন মা, আমি কি সবার কাছে বোঝা হয়ে গেছি? ঠিক আছে মা আপনারা সবাই যখন আমার মৃত্যু চাচ্ছেন আমি মরেই যাব। আপনারা আবার অনেক টাকা যৌতুক নিয়ে আপনাদের ছেলেকে বিয়ে দিবেন, আমার বাবাও আমার অত্যাচার থেকে মুক্তি পাবে, আমি মরে গিয়ে সবাইকে মুক্তি দিব, কান্না ভাঙ্গা গলায় কথাগুলো বলতে বলতে মায়া তার ঘরে গিয়েছিল।
রাসেল রাতে বাড়ীতে ফিরেছিল গম্ভীর কালো মুখ নিয়ে। মায়া রাসেলের মুখের দিকে তাকাতেই তার বুক কেঁপে উঠেছিল।
মায়া রাসেলকে জিজ্ঞেস করেছিল, তোমার কি হয়েছে? তোমাকে এমন দেখাচ্ছে কেন?
রাসেল কিছু বলেনি।
মায়া আবার জিজ্ঞেস করেছিল, কি হয়েছে আমাকে বল প্লিজ?
কি হয়েছে সেটা তুমি আমাকে জিজ্ঞেস করছ কেন? মনে হচ্ছে তুমি কিছুই জানো না?
আমি টাকা আনতে পারিনি বলে তুমি আমার উপর রাগ করছ? তুমি বিশ্বাস কর আমি চেষ্টার কোন ত্রুটি করিনি। শেষ পর্যন্ত আমি বাবার ওপর একরকম রাগ করে চলে এসেছি, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর কোনদিন বাবার বাড়ীতে যাব না।
রাগ করে চলে না এসে থেকে গেলেও তো পারতে, তাতে করে তোমার বাবা টাকা দিতে বাধ্য হতো।
তা করব কেন? বাবা তো একবার ডিমান্ড দিয়ে আমাকে বিয়ে দিয়েছে আবার টাকার জন্য বাবার বাড়ীতে পড়ে থাকব কেন? টাকার জন্য যদি মরতে হয় তবে স্বামীরবাড়ীতে মরব, বাবার বাড়ীতে পঁচে মরব না।
স্বামীরবাড়ীতে মরে আমাকে ফাঁসিতে ঝুলাবে? আমাকে হুমকি দেখাচ্ছ, আমি কোনকিছুতেই ভয় পাই না তুমি মরবে তোমার জীবন নিয়ে যাবে।
তারমানে তুমিও আমাকে মরার পরামর্শ দিচ্ছ?
না পরামর্শ দিচ্ছি না, তুমি আমাকে ভয় দেখালে তাই বললাম।
শেষ পর্যন্ত আমার তোমার মতামত জানার ইচ্ছা ছিল, এখন জানা হলো। স্বামীহিসাবে মৃত্যুর আগে আমার তোমার কাছ থেকে মাফ নেওয়া প্রয়োজন, বলে মায়া রাসেলের পায়ের উপর লুটিয়ে পড়ে বলেছিল, আর কোনদিন যদি তোমার সাথে দেখা না হয় তবে তুমি আমাকে মাফ করে দিও।
আমাবশ্যার রাত, চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার।
রাসেল আগে সারারাত মায়াকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাতো, আজ মায়ার বিপরীত দিকে মুখ করে কাত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাসেলের কাছে মায়ার নিজেকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়েছিল। শুধু রাসেলের কাছে নয়, তার শ্বাশুড়ী, ননদ, সৎ মা এবং বাবার কাছেও তার নিজেকে বোঝা বলে মনে হয়েছিল। আজ যদি মামুন বেঁচে থাকত তবে মায়া সবকিছু ছেড়ে মামুনের কাছে চলে যেত, মামুন তাকে বুকে তুলে নিত। মায়ার আর কোথাও যাবার জায়গা নাই।
তার পৃথিবী সংকুচিত হয়ে গিয়েছিল।
সে বিছানা থেকে উঠেছিল। মায়া একদিন পেপারে পড়েছে এক গৃহবধুর ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করার ঘটনা। সে নিজেও তার একটা ওড়না ফ্যানের সঙ্গে পেঁচানোর চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না।
সে মনে করার চেষ্টা করেছিল ঘরের কোথাও ইঁদুর মারার ঔষধ আছে কি না? না ঘরে ইঁদুর মারার ঔষধ নাই। মায়া খুব দুশ্চিন্তায় পড়েছিল, সে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে আপন মনে বলেছিল, নিজে নিজেই মরব তাতেও এত ঝামেলা। সে কয়েকমিনিট চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিল তারপর বিছানা থেকে উঠে তার টেবিলের উপর থেকে একটা দিয়াশলাই দিয়ে তার শাড়ীর কোনায়া আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল।
চলবে...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।