আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

অনারবী ভাষায় জুমআর খুৎবা[

তরুণ নামের জয়মুকুট শুধু তাহার, বিপুল যাহার আশা, অটল যাহার সাধনা

প্রসঙ্গ কথা অনারবী ভাষায় জুমআর খুৎবা আল্লামা মুফতী তাকী উসমানী [দা.বা.] কতিপয় বরেণ্য ব্যক্তিত্বের অনুরোধের প্রেক্ষিতে ইংরেজী ভাষায় এই প্রবন্ধটি রচনা করেন। পরবর্তীতে প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে তিনি এটিকে উর্দূ ভাষায় রূপান্তর করে দেন। বিসমিল্লাহির রাহ্মানির রাহীম আনারবী ভাষায় জুমআর খুৎবা প্রদানের বিধান এবং চার ইমামের মাযহাবের তথ্য উদঘাটন প্রশ্ন: সূদুর আমেরিকার বহু স্থানে জুমআর পূর্বে ইংরেজী ভাষায় খুৎবা দেয়া হয়। সাধারণত দেওবন্দের আলেমগণ আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় জুমআর খুৎবা দেয়াকে নাজায়েয হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। কিন্তু এখানানে আরবের কিছু লোক তা জাযেয হওয়ার পক্ষে ফাত্ওয়া প্রদান করেন।

যখন তাদের সঙ্গে কথোপকথন করা হয়, তখন অনেক সময় তাদের পক্ষ থেকে বলা হয় যে, যদিও হানাফী মাযহাবে আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া ‘না জায়েয’ কিন্তু অন্যান্য মাযহাবে তা ‘জায়েয’ আছে। এখন আপনার কাছে প্রশ্ন এই যে, চার ইমামের মধ্য থেকে কোনো ইমাম কি আরবী ছাড়া স্থানীয় অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়াকে জায়েয বলেন? দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে, আমেরিকার অনেক স্থান এমনো রয়েছে যেখানে, এমন একটি মসজিদও নেই আরবীতে খুৎবা দেয়া হয়। তাই বাধ্য হয়েই জুমআ আদায়ের জন্য ইংরেজীতে খুৎবা দেয়া মসজিদে যেতে হয়। প্রশ্ন হলো এই যে, এই ধরনের মসজিদে জুমআ আদায় করা জায়েয কি না জায়েয? এবং ইংরেজীতে খুৎবা শেষে জুমআর নামায আদায় সহীহ হবে কি? এই প্রশ্নটি এই কারণে করা হলো যে, আমাদের বুযুর্গদের মধ্যে যারা এই বিষয়ের ওপর বইপত্র লিখেছেন বা ফাতওয়া দিয়েছেন, তাঁরা একথাও লিখেছেন যে, যেমনিভাবে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় নামাযে কিরাআত পড়া জায়েয-এর মত প্রত্যাহার (রুজু) করে নিয়েছেন, তেমনিভাবে আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া জায়েয হওয়া থেকেও মত প্রত্যাহার (রুজু) করে নিয়েছিলেন। [ইমদাদুল আহকাম: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৭১১২ # জাওয়াহিরুল ফিক্হ: খণ্ড-১ম পৃষ্ঠা-৪৫২ # আহসানুল ফাতাওয়া: পৃষ্ঠা-১৫২,১৫৩] এর দ্বারা বুঝা যায় যে, ইমাম আবু হানীফা (র)-এর সর্বশেষ মত অনুযায়ী (যা জুমহুরের মতের অনুরূপ) আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষার কিরাআত পড়ার দ্বারা নামাযই সহীহ হবে না।

তাহলে কী করে আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া বৈধ হবে? আর যদি আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা জায়েয না হয়, তবে তো জুমআর নামাযই সহীহ হবে না। কেননা খুৎবা ছাড়া জুমআর নামায জায়েয হবে না। উপরোক্ত মাসআলাটির পরিপূর্ণ ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানতে চাই। উত্তর: الحمد لله وكفى وسلام على عباده الذين اصطفى, اما بعد! এ কথার দাবীদার হাওয়া ভুল যে, হানাফী মাযহাব ছাড়া অন্য কোনো মাযহাবের ইমামগণ আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়াকে জায়েয বলেন; বরং প্রকৃত সত্য হল, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ছাড়া অন্যান্য ইমামের মাযহাব এই ব্যাপারে আরো কঠিন। মালিকী, শাফেয়ী এবং হাম্বলী মাযহাবের সব ইমামগণই একমত যে, আরবী ভাষার ওপর ব্যুৎপত্তি থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ভাষায় খুুৎবা দেয়া সহীহ হবে না এবং এর দ্বারা জুমআর নামাযও আদায় হবে না।

অধিকন্তু মালিকী মাযহাবের অনুসারীরা তো এ কথা পর্যন্ত বলেন যে, উপস্থিত লোকদের মাঝে কোনো একজনও যদি আরবী ভাষায় জ্ঞাত না থাকেন, তবে জুমআর নামায রহিত হয়ে যাবে। এর স্থলে যুহরের নামায আদায় করতে হবে। কিন্তু শাফেয়ী ও হাম্বলী মাযহাবে এই অবকাশ আছে যে, যদি উপস্থিত লোকদের মাঝে কেউ আরবী ভাষায় খুৎবা দিতে সামর্থ না থাকলে এবং সময়ও এই পরিমাণ না থাকে যে, কেউ আরবী শিখতে পারে, তাহলে এই পরিস্থিতিতে অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া জায়েয এবং তা গ্রহণযোগ্যও বটে। তারপর জুমআর নামায জায়েয হয়ে যাবে। এই কথাগুলো সাব্যস্ত করার জন্য নিুে তিন মাযহাবের কিতাবগুলোর উদ্ধৃতি ব্যাখ্যাসহ তুলে ধরা হলো।

মালিকী মাযহাব আল্লামা দুসূকী (রহ.) লিখেছেন : (قوله : وكونها عربية) أى ولو كان الجماعة عجما لايعرفون العربية, فلو كان ليس فيهم من يحسن الإتيان بالخطبة عربية لم يلزمهم جمعة. ‘এবং খুৎবা আরবী ভাষায় হওয়া শর্ত। চাই উপস্থিত লোকদের মাঝে এমন লোক উপস্থিত থাকুক যে আরবী জানে না। সুতরাং তাদের মধ্যে যদি এমন একজন লোকও না থাকে যে আরবীতে খুৎবা দিতে পারে, তাহলে তাদের ওপর জুমআ-ই ওয়াজিব হবে না। ’ [শারহুল কাবীরের টীকা: দুসূকী: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৭৮] আল্লামা উলাইশ মালিকী (রহ.) লিখেছেন: وبخطبتين قبل الصلاة ... وكونها عربتين والجهر بهما ولو كان الجماعة عجمالا يعرفون اللغة العربية أو صما فإن لو يوجد فيهم من يحسنهما عربتين فلا تجب الجمعة عليهم ولو كانوا كلهم بكما فلا تجب عليهم الجمعة فالقدرة على الخطبتين من شروط وجوب الحمعة. ‘এবং নামাযের পূর্বে দুই খুৎবাও জুমআর নামায সহীহ হওয়ার জন্য শর্ত। উভয় খুৎবা আরবী ভাষায় হওয়া এবং উচ্চ আওয়াজে আদায় করাও ওয়াজিব।

চাই উপস্থিত লোকদের মাঝে সবাই অনারবী লোক থাকুক যারা আরবী জানে না, কিংবা বধির লোকেরা থাকুক। সুতরাং মসজিদে উপস্থিতদের মাঝে যদি একজন লোকও এমন না থাকে যে উভয় খুৎবা আরবীতে দিতে পারে, তাহলে তাদের ওপর জুমআই ওয়াজিব হবে না। তাই উভয় খুৎবা (আরবীতে) দেয়ার যোগ্য হওয়া জুমআ ওয়াজিব হওয়ার জন্য শর্ত। ’ [শরহু মানহিল জলীল আলা মুখতাসারিল আল্লামা খলীল : ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-২৬০] উপরোক্ত ব্যাখ্যা মালিকী মাযহাবের অধিকাংশ গ্রন্থাদিতে বিদ্যমান রয়েছে। [দ্র: জাওয়াহিরুল ইকলীল লিলহাত্তাব: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৯৫ # আল-খারশী আলা মুখতাসারি খলীল: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-২৮ # শরহুয যারকানী আলা মুখতাসারি খলীল: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৫৬ # আল ফাওয়াকাতুদ্দাওয়ানী আলা রিসালাতি ইবনে আবী যায়েদ আল কীরাওয়ানী : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা২৬৭] উপরোক্ত কিতাবগুলোর উদ্ধৃতিসমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, মালিকীদের মতে, সর্বাবস্থায় খুৎবা আরবী হওয়া একান্ত আবশ্যক।

এ কারণে কেউই যদি আরবী না জানে তবুও অন্য ভাষায় খুৎবা দেয়া জায়েয নেই; বরং জুমআর স্থলে যুহরের নামায আদায় করতে হবে। শাফেয়ী মাযহাব আল্লামা রমলী শাফিয়ী (রহ.) লিখেছেন: (ويشترط كونها) أى الخطبة (عربية) لإتباع السلف والخلف, ولأنها ذكر مفروض فاشترط فيه ذالك كتكبير الإحرام. ‘এবং খুৎবা আরবী ভাষায় হওয়া শর্ত, পূর্বসুরীদের অনুসরণ করার কারণে এবং আরো এ কারণে যে, এটা ফরয যিক্র। তাই তার মধ্যে আরবী হওয়া শর্ত। যেমন: নামাযের তাকবীরে তাহরীমা আরবী হওয়া শর্ত। ’ [নিহায়াতুল মুহতাজ ইলা শরহিল মিনহাজ: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৩১৪] আল্লামা শিরওয়ানী (রহ.) লিখেছেন, (ويشترط كونها) أى الأركان دون ما عداها (عربية) للإتباع, نعم, إن لم يكن فيهم من يحسنها ولم يكن تعلمها قبل ضيق الوقت خطب منهم واحد بلسانهم, وإن أمكن تعلمها وجب على كل منهم, فإن مضت مدة إمكان تعلم واحد منهم, ولم يتعلموا عصوا كلهم, ولا جمعة لهم بل يصلون الظهر. ‘এবং খুৎবার রুকনগুলো আরবী ভাষায় হওয়া শর্ত।

তাহলে পূর্বসূরীদের অনুকরণ হয়ে যাবে। হ্যাঁ উপস্থিতদের মধ্যে কোনো লোক যদি বিশুদ্ধভাবে আরবীতে খুৎবা না দিতে পারে এবং সময় স্বল্পতার কারণে আরবী খুৎবা শিখতেও না পারে, তাহলে উপস্থিতদের মধ্য থেকে কোনো একজন স্বীয় ভাষায় খুৎবা দিতে পারে। আর যদি খুৎবা শেখা সম্ভবপর হয় তবে সকলের ওপর শিক্ষা করা ওয়াজিব। এমনকি যদি এ পরিমাণ সময় অতিবাহিত হয়ে যায়, যার মধ্যে কোনো এক ব্যক্তি খুৎবা শিখতে সক্ষম হয়, কিন্তু যদি কেউ না শিখে তবে সবাই গোনাহগার সাব্যস্ত হবে এবং তাদের জুমআর নামায সহীহ হবে না; বরং তারা সকলে যুহর পড়ে নিবে। [আশ-শিরওয়ানী আলা তুহফাতিল মুহতাজি বি-শরহিল মিনহাজি: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৪৫] উপরে বর্ণিত ব্যাখ্যা শাফেয়ীগণের অন্যান্য কিতাবেও রয়েছে।

[দ্রষ্টব্য: যাদুল মুহতাজ বিশরহিল মিনহাজি: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২৭-৩২৮ # ইআনাতুত্ালিবীন আলা হল্লি আলফাযি ফাতহিল মুঈন: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৬৮-৬৯ # আলগায়াতুল কাসওয়া ফী দিরায়াতিল ফাতওয়া: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩৪০] হাম্বলী মাযহাব আল্লামা ভূতী (রহ.) লিেেখছেন, (ولا تصح الخطبة بغير العربية مع القدرة) عليها بالعربية (كقرأة) فإنها لا تجزى بغير العربية وتقدم (وتصح) الخطبة بغير العربية (مع العجز) عنها بالعربية, لأن المقصود بها الوعظ والتذكير, وحمد الله والصلاة على رسوله صلى الله عليه وسلم, بخلاف لفظ القران فإنه دليل النبوة وعلامة الرسالة ولايحصل بالعجمية (غير القراة) فلا تجزى بغير العربية لما تقدم (فإن عجز عنها) أى عن القراة (وجب بدلها ذكر) قياسا على الصلاة. ‘আরবী ভাষার ওপর ব্যুৎপত্তি থাকা অবস্থায় অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া সহীহ নয়। যেমন- নামাযের মধ্যে অন্য কোনো ভাষায় কিরাআত জায়েয নয়। তবে যদি আরবী ভাষা জানা না থাকে, তাহলে অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দিলে সহীহ হয়ে যাবে। কেননা, খুৎবার উদ্দেশ্য হলো ওয়াজ-নসীহত, আল্লাহর হামদ এবং রাসূলুল্লাহর (সা.) প্রতি দরূদ পাঠ করা। শব্দের কুরআনের বিষয়টি এর বিপরীত।

কেননা, তা (কুরআন) হল নবুওতের দলীল এবং রিসালাতের আলামত, যা অনারবী ভাষা দ্বারা হাসিল হবে না। তাই কিরাআত কোনো অবস্থাতেই আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় জায়েয হবে না। তাইতো কোনো ব্যক্তি যদি আরবী ভাষা না জানে তবে তার জন্য কিরাআতের স্থলে যিকর ওয়াজিব হবে। (এই মাসআলাটি ইবনুল মাফ্লাহ রচিত গ্রন্থ কিতাবুল ফুরূ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১১৩-১১৪-এর মধ্যে বর্ণিত আছে। ) উপরোক্ত উদ্ধৃতি দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, আরবী ভাষায় ব্যুৎপত্তি থাকা অবস্থায় অন্য কোনো ভাষায় খুৎবা দেয়া জায়েয-ই নয়; বরং এই ধরনের খুৎবা গ্রহণযোগ্যও নয় এবং তারপর আদায়কৃত জুমআও জায়েয হবে না।

শাফেয়ী ও হাম্বলীগণ এই কথা বলেন যে, মুসল্লীদের মাঝে কোনো একজনও যদি আরবী ভাষায় খুৎবা না দিতে পারে, সেইসঙ্গে যদি আরবী শিক্ষা করারও সময় না থাকে, তাহলে অন্য কোনো ভাষায় দেয়া খুৎবাও জুমআর শর্ত পূরণ করবে এবং তারপর জুমআর নামায আদায় করা জায়েয হবে। এটি ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.)-এরও মত। এর বিস্তারিত বিবরণ সামনে তুলে ধরা হবে ইনশাআল্লাহ। ’ ইমাম আবু হানীফা (রহ,)-এর মাযহাবের বিশ্লেষণ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর অবস্থান বোঝার পূর্বে কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ সামনে থাকলে সহজে তাঁর মাযহাব বোধগম্য হবে। আর তা হলো এই যে, সাধারণত: এ কথা মনে করা হয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) যেমনিভাবে প্রথমদিকে নামাযের কিরাআত অন্য কোনো ভাষায় পড়া জায়েয মনে করতেন, মেনিভাবে জুমআর খুৎবাও অন্য কোনো ভাষায় জায়েয মনে করতেন।

পরবর্তীতে তিনি যেমনিভাবে ফার্সি ভাষায় কিরাআত জায়েয হওয়া থেকে রুজু (মত প্রত্যাহার) করেছেন, তেমনিভাবে জুমআর খুৎবাও অন্য ভাষায় জায়েয মনে করা থেকে রুজু (মত প্রত্যাহার) করেছেন। কিন্তু প্রকৃত সত্য হলো এই যে, এখানে দু’টি মাসআলা আলাদা আলাদা এবং উভয় মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর অবস্থান ভিন্ন ভিন্ন। প্রথম মাসআলাটি এই যে, নামাযের মধ্যে কুরআনে কারীমের কিরাআত আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় গ্রহণযোগ্য কি না? এ ব্যাপারে ইমাম সাহেবের প্রাথমিক মতামত এই ছিল যে, যদি কোনো ব্যক্তি আরবী ভাষায় পারদর্শী থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ভাষায় কিরাআত পড়ে তাহলে তা মাকরূহ হবে। কিন্তু এর দ্বারা নামাযের ফরয আদায় হয়ে যাবে। এদিকে ইমাম আবু ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মদ (রহ.) এবং জমহুরে ফুকাহা বলেন, উপরোক্ত পরিস্থিতিতে নামায-ই হবে না।

অবশ্য পরবর্তীতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইন ও জমজুরে ফুকাহার মতের সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। তাই ইমাম সাহেবের (রহ.) অভিমত এখন এই দাড়াল যে, যদি আরবী ভাষায় পারদর্শী থাকা সত্ত্বেও অন্য কোনো ভাষায় কিরাআত পড়া হয় তাহলে নামাযই সহীহ হবে না। এতে প্রতীয়মান হলো যে, উপরোক্ত মাসআলার ক্ষেত্রে ইমাম সাহেব ও সাহেবাইন (রহ.) এবং জমহুরের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই এবং সব ইমামগণ এর ওপর একমত যে, নামাযের মধ্যে কিরাআত শুধু আরবী ভাষায় জায়েয, এ ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কিরাআত করার দ্বারা নামায সহীহ হবে না। দ্বিতীয় মাসআলাটি এই যে, নামায ছাড়া অন্য কোনো যিকির-আযকার যেমন- তাকবীরে তাহরীমা, রুকূ-সিজদার তাসবীহ, তাশাহ্হুদ এবং জুমআর খুৎবা ইত্যাদি বিষয়গুলো অন্য কোনো ভাষায় জায়েয আছে কি না? এই মাসআলাটিতেও ইমাম সাহেব ও সাহেবাইনের মধ্যে মতবিরোধ ছিল। সাহেবাইনের মত এই ছিল যে, যতক্ষণ পর্যন্ত আরবী ভাষায় পারদর্শী কেউ থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত উপরোক্ত যিকিরগুলো আরবীতেই হওয়া শর্ত।

তাই কোনো ব্যক্তি যদি আরবী জানা সত্ত্বেও উপরোক্ত যিকিরগুলো অন্য কোনো ভাষায় আদায় করে তাহলে তা গ্রহণযোগ্য হবে না। এ পর্যায়ে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মত এই ছিলো যে, আরবী ভাষা জানা সত্ত্বেও উপরোক্ত যিকিরগুলো অন্য কোনো ভাষায় আদায় করা যদিও মাকরূহ, কিন্তু আরবী ছাড়াও অন্য কোনো ভাষায় উপরোক্ত যিকিরগুলো আদায় করলে তা গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে। আল্লামা আইনী (রহ.)-এর একটি উদ্ধৃতি দ্বারা বাহ্যিকভাবে একথা বোঝা যায় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) দ্বিতীয় মাসআলায়ও সাহেবাইনের মতের প্রতি রুজূ করেছেন। আল্লামা আইনী (রহ.) লিখেছেন যে, وأما الشروع بالفارسية أو القرأة بها فهو جائز عند أبى حنيفة رحمه الله مطلقا وقالا : لا يجوز إلا عند العجز وبه قالت الثلاثة وعليه الفتوى وصح رجوع أبى حنيفة إلى قولهما. ‘ফার্সি ভাষায় নামায আরম্ভ করা (অর্থাৎ ফার্সীতে তাকবীরে তাহরীমা বলা) কিংবা ফার্সীতে কিরাআত পড়া এটি ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে শর্তহীনভাবে জায়েয। আর সাহেবাইন (রহ.) বলেন যে, অপারগতা ছাড়া জায়েয নেই।

আইম্মায়ে সালাসাও [অর্থাৎ, তিন ইমাম, যথা ইমাম শাফিয়ী (রহ.), ইমাম মালিক (রহ.) এবং ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.)] এই মত পোষণ করেন এবং এর ওপরই ফতওয়া। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে সাহেবাইনের মতের দিকে রুজূ করা প্রমাণিত আছে। ’ (শরহুল আইনী আলাল কান্যি: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩২] উপরোক্ত উদ্ধৃতিতে আল্লামা আইনী (রহ.) উভয় মাসআলা অর্থাৎ ফার্সীতে তাকবীরে তাহরীমা বলা এবং ফার্সীতে কিরাআত পড়াকে একসঙ্গে উল্লেখ করে একথা বুঝাতে চেয়েছেন যে, ইমাম সাহেব (রহ.) সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু করেছিলেন। যার বাহ্যিক মর্ম এটাই যে, উভয় মাসআলায় রুজু করেছিলেন। ইমদাদুল আহকাম, জাওয়াহিরুল ফিক্হ এবং আহসানুল ফাতাওয়াতে জুমআর খুৎবার ব্যাপারে বর্ণিত হয়েছে যে, ‘এ ব্যাপারেও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইনের (রহ.) মতের দিকে রুজু করেছেন।

’ এ কথাটি হয়তো আল্লামা আইনীর উপরোক্ত কথার ওপর ভিত্তি করেই বলা হয়েছে। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা হলো এই যে, আল্লামা আইনী (রহ.)-এর উপরোক্ত উদ্ধৃতি এই মর্মের ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয়; বরং তার মধ্যে এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, ‘রুজু’ এর সম্পর্ক নিরেট কিরাআতের মাসআলার সঙ্গে । আর যদি ধরেও নেয়া হয় যে, এর উদ্দেশ্য এটাই যে, ইমাম সাহেব (রহ.) উভয় মাসআলায় তার পূর্বের মত থেকে রুজু করেছেন, তাহলে বলতে হবে যে, এ ব্যাপারে আল্লামা আইনী (রহ.)-এর ভ্রম হয়েছে। প্রকৃত তথ্য এই যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) শুধু প্রথম মাসআলা অর্থাৎ ফার্সীতে কিরাআত পড়া এর ক্ষেত্রে সাহেবাইনের মতের দিকের রুজু করেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় মাসআলা অর্থাৎ আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় তাকবীরে তাহরীমা কিংবা অন্যান্য যিকির-আযকার আদায় করা কিংবা জুমআর খুৎবা আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় দেয়ার ব্যাপার তাঁর পূর্বের মত থেকে রুজু করেননি; বরং কোনো কোনো আলেম এ পর্যন্ত দাবী করেছেন যে, উক্ত মাসআলায় সাহেবাইন (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতের দিকে রুজু করেছেন।

যার সারমর্ম এই হবে যে, তাকবীরে তাহরীমা যদি অন্য কোনো ভাষায় আদায় করা হয়, কিংবা তাশাহ্হুদ অন্য কোনো ভাষায় আদায় করা হয়, কিংবা জুমআর খুৎবা অন্য কোনো ভাষায় দেয়া হয়, তাহলে ইমাম সাহেবের (রহ.)-এর মতে তা এখনো গ্রহণযোগ্য হবে। একারণেই আল্লামা আইনী ব্যতীত অনেক হানাফী ফকীহ উপরোক্ত কথাগুলো সুস্পষ্টভাবে বর্ণনা করেছেন এবং আল্লামা আইনী (রহ.)-এর দাবী খণ্ডণ করেছেন। আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (রহ.) দুররুল মুখতারে লিখেছেন যে, وجعل العينى الشروع كالقرأة لا سلف له فيه ولا سند له يقويه بل جعله فى التاتارخانية كالتلبية يجوزإتفاقا فظاهره كالمتن رجوعهما إليه لا هوإليهما فاحفظه, فقد إشتبه على كثير من القاصرين حتى الشرنبلانى فى كل كتبه فتنبه. ‘আল্লামা আইনী (রহ.) নামায শুরু করা (ফার্সীতে তাকবীরে তাহরীমা বলা)-কে (ফার্সীতে) কিরাআত পড়ার অনুরূপ বলেছেন। এতে তার পূর্বে তার আর কোনো সমকক্ষ নেই এবং এর কোনো সনদও নেই যে, তার কথাকে সূদৃঢ় করবে; বরং ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়াতে তাকবীরে তাহরীমাকে তালবিয়া-এর অনুরূপ বলা হয়েছে। যা অন্যান্য ভাষায় সবার মতে জায়েয।

তাই এর বাহ্যিক দাবী হলো তানবীরুল আবসারের মতনের ন্যায়। অর্থাৎ এই মাসআলায় সাহেবাইন (রহ.) ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতের দিকের রুজু করেছেন। ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইনের (রহ.) মতের দিকে রুজু করেননি। এই কথাটি স্মরণ রাখার যোগ্য। কেননা এই মাসআলায় স্বল্প শিক্ষিত অনেক মানুষ সংশয়ের মাঝে হাবুডাবু খেয়েছে।

এমনকি আল্লামা শারম্বুলালী (রহ.)ও তার সব কিতাবে এই সংশয় পেশ করেছেন। এ পর্যায়ে আল্লামা শামী (রহ.) লিখেছেন যে, (قوله : لا سلف له فيه) أى لم يقل به أحد قبله, وإنما المنقول أنه رجع إلى قولهما فى أشتراط القراءة بالعربية إلا عند العجز, وأما مسئلة الشروع فالمذكور فى عامة الكتب حكاية الخلاف فيها بلا ذكر رجوع أصلا, وعبارة المتن كالكثرة وغيره كالصريحة فى ذالك حيث أعتبر العجز فيه أى فى القراءة فقط (قوله : ولا سند له يقويه) أى ليس له دليل يقوى مدعاه, لأن الإمام رجع إلى قولهما فى إشتراط القراءة بالعربية, لأن المأمور به قراءة القران, وهو إسم للمنزل باللفظ العربى المنظوم بهذا النظم الخاص, المكتوب فى المصاحف المنقول إلينا نقلا متواترا, ولاعجمى إنما يسمى قرانا مجازا, ولذا يصح نفى إسم القران عنه, فلقوة دليل قولهما رجع إليه, أما الشروع بالفارسية فالدليل فيه للإمام أقوى وهو كون المطلوب فى الشروع الذكر والتعظيم, وذالك حاصل بأى لفظ كان وأى لسان كان, نعم لفظ الله أكبر واجب للمواظبة عليه لا فرض. ‘দুররুল মুখতারে বলা হয়েছে যে, ‘এ ব্যাপারে আল্লামা আইনী (রহ.)-এর কোনো সমকক্ষ নেই’ এর মর্ম এই যে, তার পূর্বে কোনো লোক উক্ত কথা বলেন নি; বরং বর্ণিত আছে যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইনের (রহ.) মতের দিকে এই মাসআলায় রুজু করেছেন যে, অপারগতার অবস্থা ছাড়া সাধারণ অবস্থায় আরবী ভাষায় কিরাআত শর্ত। কিন্তু যতটুকু আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় নামায আরম্ভ করার মাসআলাটির সম্পর্ক রয়েছে এই মাসআলায় প্রায় অধিকাংশ কিতাবাদিতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও সাহেবাইনের (রহ.) মধ্যে মতবিরোধ দেখানো হয়েছে। মূলত: ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে রুজু করার কোনো কথা উল্লেখ নেই। তাই তানবীরুল আবসারের মতন এবং কানযুদ্দাকায়িক ইত্যাদির উদ্ধৃতি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট যে, ইমাম সাহেব (রহ.) অপরাগতার কথা শুধু কিরাআতের ক্ষেত্রে বলেছেন।

দুররুল মুখতারের গ্রন্থকার আল্লামা আইনী (রহ.) মতের ব্যাপারে এই কথা বলেছেন যে, ‘তার কথার কোনো সনদ নেই যা তাকে সুদৃঢ় করবে’-এর মর্ম এই যে, এমন কোনো দলীল নেই যা তার দাবীকে সুদৃঢ় করবে। কেননা, কিরাআতের মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইনের (রহ.) মতের দিকে এ কারণে রুজু করেছেন যে, ফরয কিরাআত হলো কুরআন। আর কুরআন ওই বাণীর নাম যা আরবী ভাষায় বিশেষ বিশেষ নিয়মাবলীর সঙ্গে অবতীর্ণ হয়েছে, যা সহীফায় লিখিত এবং ধারা পরম্পরায় আমাদের পর্যন্ত পৌঁছেছে। এই কারণে কোনো অনারবী অনুবাদকে রূপক অর্থেই কুরআন বলা হয়। তাইতো এর থেকে কুরআনের শব্দের বিলুপ্তি জায়েয আছে।

সুতরাং যেহেতু সাহেবাইনের (রহ.) দলীল শক্তিশালী ছিলো, সেহেতু ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তাদের মতের দিকের রুজু করেছিলেন। কিন্তু ফার্সী ভাষায় নামায আরম্ভ করার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর দলীল শক্তিশালী। অর্থাৎ নামায আরম্ভ করার দ্বারা উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর যিকির ও তার সম্মান করা, যা যে কোনো শব্দে এবং যে কোনো ভাষায় হতে পারে। হ্যাঁ, [ألله أكبر] ‘আল্লাহু আকবার’ শব্দটি হবহু বলা এজন্য ওয়াজিব যে, এর ওপর রাসূলুল্লাহ (সা.), সাহাবায়ে কিরাম এবং তাবিয়ীনে ইযাম সর্বদা আমল করেছেন, কিন্তু তা ফরয নয়। আল্লামা শামী (রহ.) হুবহু এই বক্তব্যটি-ই আল-বাহরুর-রায়িক এর প্রান্ত টীকায় বিস্তারিতভাবে উল্লেখ করেছেন।

’ [মিনহাতুল খালিক আলাল বাহরির রায়িক: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০৭] আল্লামা আবূস সাঊদ হানাফী (রহ.)ও মোল্লা মিসকীন (রহ.)-এর ব্যাখ্যাগ্রন্থে উপরোক্ত বক্তব্যটির সত্যয়ন করে বলেছেন যে, নামায আরম্ভ করা এবং অন্যান্য যিকিরের ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু করেননি; বরং এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতই নির্ভরযোগ্য। তাই তিনি বলেন, وقول العينى الفتوى على قول الصاحبين أنه لا يصح الشروع بالفارسية إذا كان يحسن العربية, فيه نظر, بل المعتمد فيه قول الإمام, أن الشروع كنظائره مما إتفقوا عليه, ولهذا نقل فى الدر عن التاتارخانية أن الشروع بالفارسية كالتلبية يجوز إتفاقا. ‘আল্লামা আইনী (রহ.)-এর এ কথা চিন্তার বেশ খোরাক রয়েছে যে, নিুোক্ত মাসআলায় সাহেবাইনের (রহ.) মতের ওপর ফাতওয়া, যে যখন কোনো ব্যক্তি আরবীতে তাকবীরে তাহরীমা বলতে সক্ষম, তখন ফার্সীতে তাকবীরে তাহরীমা বলা সহীহ নয়; বরং প্রকৃতপক্ষে উপরোক্ত মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মত গ্রহণযোগ্য। তাকবীরে তাহরীমা এবং তার অনুরূপ বিষয়ের মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এবং সাহেবাইন (রহ.) একমত। এজন্য দুররুল মুখতারে ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া থেকে বর্ণনা করা হয়েছে যে, ফার্সীতে তাকবীরে তাহরীমা বলা তালবিয়ার অনুরূপ, যা অন্যান্য ভাষায়ও আদায় করা সবের মতে জায়েয। ’ [ফাতহুল মুঈন আলা শরহিল কানযি লি মোল্লা মিসকীন: খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৮২] এছাড়া মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষেèৗভী (রহ.) লিখেছেন যে, وذكر العينى فى شرح الكنز ثم الطرابلسى ثم الشرنبلالى رجوعه فى مسئلة التكبير أيضا إلى قولهما, وهو خلاف ما عليه عامة الكتب من بقاء الخلاف فى مسئلة التكبير والتلبية والتسمية وغيرها, وهذا المبحث طويل الذيل, كم زلت فيه الأقدام وتحيرت فيه الأفهام. ‘আল্লামা আইনী (রহ.) কানযের ব্যাখ্যাগ্রন্থে এবং আল্লামা তারাবুলসী (রহ.) এবং আল্লামা শারুম্বুলালী (রহ.) এ কথা উল্লেখ করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) তাকবীরের মাসআলায়ও সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু করেছিলেন।

অথচ এই কথাটি সাধারণ কিতাবাদির বক্তব্যের পরিপন্থী। যার প্রেক্ষিতে তাকবীর, তালবিয়া এবং বিসমিল্লাহ ইত্যাদির মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এবং সাহেবাইনের (রহ.) মতবিরোধ থেকে যায়। এই আলোচনাটি অনেক দূর্ভেদ্য। না জানি এ বিষয়ে কত লোকের পদস্খলন ঘটেছে এবং কত বিবেকবান সংশয়ের সাগরে হাবুডুবু খেয়েছে। ’ [আস্সিআয়াহ্: খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-১৫৪-৫৫] হযরত মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষেèৗভী (রহ.) এই বিষয়টির ওপর একটি স্বতন্ত্র পুস্তিকা রচনা করেছেন, যাতে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর দলীলগুলো বিস্তারিত আলোচিত হয়েছে।

পুস্তিকাটির নাম হলো اكام النفائس فى اداء الاذكار بلسان الفارس উক্ত পুস্তিকাটিতে তিনি লিখেছেন যে, والحق أنه لم يرو رجوعه فى مسئلة الشروع بل هى على الخلاف, فإن أجلة الفقهاء منهم صاحب الهداية وشراحها العينى والسغناقى والبابرتى والمحبوب وغيرهم وصاحب المجمع وشراحه وصاحب البزازية والمحيط والذخيرة وغيرهم ذكروا رجوعه فى مسئلة القرائة فقط وإكتفوا فى مسئلة الشروع بحكاية الخلاف. ‘প্রকৃত ও সত্য কথা হলো এই যে, তাকবীরে তাহরীমার মাসআলার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) থেকে রুজু করার কোনো প্রমাণ নেই, বরং এ ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা ও সাহেবাইনের মধ্যকার মতবিরোধ এখনো রয়েছে। এ কারণে অনেক বড় বড় ফকীহ যেমন : হিদায়া গ্রন্থকার এবং তার ব্যাখ্যাদাতাগণের মধ্যে থেকে আল্লামা আইনী (রহ.) আল্লামা সাগনাকী, আল্লামা বাবরতী, আল্লামা মাহবূবী, মাজমা’র গ্রন্থকার ও তার ব্যাখ্যাতাগণ, বাযযারিয়া, মুহীত এবং যখীর]ে গ্রন্থকারসহ সবাই ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর রুজু, করার বর্ণনা শুধু কিরাআতের মাসআলা-ই উল্লেখ করেছেন। আর নামায আরম্ভ করার মাসআলায় তারা তাদের মতদ্বৈততার কথা উল্লেখ করেছেন। [আকামুন নাফায়েস : পৃষ্ঠা-৭৩] আল্লামা লাক্ষেèৗভী (রহ.) একথাও ঠিক বলেছেন যে, খোদ আল্লামা আইনীর উদ্ধৃতি এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট নয় যে, ইমাম সাহেব (রহ.) উভয় মাসআলায় সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু করেছেন, বরং এর মধ্যে এই সম্ভাবনাও রয়েছে যে, রুজু করার সম্পর্ক শুধু কিরাআতেরই সঙ্গে । তাই এই ব্যাপারে দৃঢ়তার সঙ্গে একথা বলা জায়েয হবে না যে, তিনি উভয় মাসআলায় রুজু‘ করার কথা বর্ণনা করে ভুল কবরেছেন।

এছাড়া এই উদ্ধৃতি দ্বারা যারা এই দাবী করেছেন যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর তাকবীরে তাহরীমা এবং অন্যান্য মাসআলায় সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু‘ করেছেন এ কথাও সঠিক নয়। কেননা তাতারখানিয়া গ্রন্থে ফার্সী ভাষায় তাকবীরে তাহরীমা বলাকে সর্বসম্মতিক্রমে যে গ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে- এর দ্বারা তাকবীরে তাহরীমা উদ্দেশ্য নয়, বরং জবাই করার সময়ের তাকবীর উদ্দেশ্য। তাই বাস্তব হলো এই যে, তাকবীরে তাহরীমা এবং অন্যান্য যিকির যেমন: নামায এবং খুৎবার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এবং সাহেবাইন (রহ.) এর মতবিরোধ বহাল আছে। তারা ইমাম আবু হানীফা (রহ.) মতের দিকে রুজু‘ করেননি। [দ্র: আকামুন্ নায়েস : পৃষ্ঠা-৭৩] আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (রহ.), আল্লামা ইবনে আবেদীন শামী (রহ.), আল্লামা আবুস সঊদ (রহ.) এবং হযরত মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষেèৗভী (রহ.)-এর বর্ণনাগুলো দ্বারা প্রতীয়মান হলো যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.) শুধু কিরাআতের মাসআলায় সাহেবাইনের মতের দিকে রুজু‘ করেছিলেন।

তাকবীরে তাহরীমা এবং অন্যান্য যিকির-আযকারের ব্যাপারে রুজু‘ করেননি। এ জন্য হানাফী মাযহাবের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থের উদ্ধৃতিসমূহ যেমন ‘কান্য’, ‘বিকায়াহ’ এবং ‘তানবীরুল আবসার’ গ্রন্থসমূহে তাকবীরে তাহরীমার মাসআলার ক্ষেত্রে একথাই লিখিত আছে যে, তা (তাকবীরে তাহরীমা) আরবী ছাড়া অন্য কোনো ভাষায়ও সহীহ হবে। আলোচ্য বিষয়ে কানযের বর্ণনা নিুরূপ, ولو شرع بالتسبيح أو بالتهليل أو بالفارسية صح كما لو قرء بها عاجزا যদি ‘তাসবীহ’ [سبحان الله] অথবা ‘তাহলীল’ [لا اله الا الله] অথবা ‘ফার্সি ভাষা’র (অনারবী ভাষার) দ্বারা নামায শুরু করে, তাহলে তা জায়েয হবে। যেমননি জায়েয কিরাআত পড়তে অক্ষম অবস্থায়। [বাহরুর রায়েক; কানযের টীকা গ্রন্থ : খণ্ড-১,পৃষ্ঠা-৩০৭] বিকায়ার বর্ণনা নিুরূপ, فإن أبدل التكبير بالله أجل وأعظم والرحمن أكبر ولا إله إلا الله أو بالفارسية أو قرء بها بعذر أو ذبح وسمى بها جاز. ‘যদি ‘আল্লাহ আকবর’ [الله اكبر]-এর পরিবর্তে ‘আল্লাহা আজাল্লু’ [الله اجل] ‘আল্লাহু আ’যামু [الله اعظم] ‘আল্লাহুর রাহমানু’ [الله الرحمن] অথবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু’ [لا اله إلا الله] কিংবা ‘ফার্সী ভাষায় (অনারবী ভাষায়) বলে কিংবা ওজরবশত: কিরাআত পড়ে কিংবা জবাই করে তবে তা জায়েয হবে।

[বিকায়া : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৬৫] তানবীরুল আবসারের বর্ণনা নিুরূপ, وصح شروعه بتسبيح وتهليل كما صح لو شرع بغير عربية أو امن أو لبى أو سلم أو سمى عند ذبح أو قرء بها عاجزا. ‘এবং ‘তাসবীহ’ [سبحان الله] ‘তাহলীল’ [لا إله إلا الله] -এর দ্বারা (নামায) শুরু করা জায়েয আছে, যেমন জায়েয আছে অনারবী ভাষায় শুরু করা, কিংবা ‘আমীন’ বলা কিংবা ‘তাহলীল পড়া’ কিংবা সালাম করা’ কিংবা জবাই করার সময় বিমিল্লাহ পড়া কিংবা অপারগ অবস্থায় অনারবী ভাষায় কিরাআত তিলাওয়াত করা। [তানবীরুল আবসার : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১৫৮] ‘উপরোক্ত বর্ণনাসমূহের মধ্যে কিরাআতের মাসআলার ক্ষেত্রে সাহেবাইনের (রহ.) মতামতকে গ্রহণ করা হয়েছে যে, ফার্সীতে কিরাআত পড়া শুধু অপারগতার অবস্থায় গ্রহণযোগ্য। কিন্তু তাকবীরে তাহরীমা জাতীয় মাসআলার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর মত অনুযায়ী শর্তহীনভাবে সহীহ হওয়ার হুকুম আরোপ করা হয়েছে এবং এর মধ্যে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) রুজু‘ করার কোনো কথা উল্লেখ নেই। এছাড়া আল্লামা ফখরুদ্দীন যায়লায়ী (রহ.) তাকবীরে তাহরীমার মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর রুজু‘ করার কথা উল্লেখ করেননি। কিন্তু কিরাআতের মাসআলায় রুজু‘ করার কথা উল্লেখ করেছেন’।

[তাবয়ীনুল হাকায়িক লিয-যায়লায়ী শরহে কানয : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১১০] এর দ্বারা অবশ্যই আল্লামা ইবনে আবেদীন প্রমূখদের উল্লিখিত তথ্যের স্বপক্ষে সমর্থন পাওয়া যায়। আর এ কথা সুষ্পষ্ট হয়ে যায় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর রুজু‘ নিছক কিরাআতের মাসআলায় প্রমাণিত। তাকবীরে তাহরীমা বা অন্যান্য যিকিরের ব্যাপারে তিনি স্বীয় মত থেকে রুজু‘ করেননি, বরং এখনো তার মাযহাব এটাই যে, এই সব যিকির-আযকার আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায়ও জায়েয। অপরদিকে এ কথা পরিস্কার হয়ে গেলো যে, ‘জুমআর খুৎবা ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে নামাযের কিরাআতের হুকুমের অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং তাকবীরে তাহরীমা বা অন্যান্য যিকির-আযকারের হুকুমের অর্ন্তভুক্ত। এজন্যই ফুকাহায়ে কিরাম খুৎবার আলোচনা অন্যান্য যিকির-আযকারের সঙ্গেই করেছেন।

যেমন, আল্লামা ইবনে নুজাইম (রহ.) তাকবীরে তাহরীমার মাসআলা বর্ণনা করার পর বলেন, وعلى هذا الخلاف الخطبة والقنوت والتشهد . ‘খুৎবা, দুআয়ে কুনূত এবং তাশাহহুদের ব্যাপারেও ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও সাহেবাইনের মধ্যকার মতবিরোধ আছে। (ইমাম আবু হানীফা (রহ.) এর মতে আরবী ছাড়া অন্যান্য ভাষায় গ্রহণযোগ্য, আর সাহেবাইনের মতে গ্রহণযোগ্য নয়)। [বাহরুর রায়েক : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৩০৭] আল্লামা আলাউদ্দীন হাসকাফী (রহ.)ও তাকবীরে তাহরীমার মাসআলা আলোচনা করার পর লিখেছেন, وعلى هذا الخلاف الخطبة وجميع اذكار الصلاة . ‘এবং খুৎবা ও নামাযের অন্যান্য যিকির আযকারের ক্ষেত্রেও একই মতবিরোধ রয়েছে। ’ [দুররুল মুখতার : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১০৭] আল্লামা যায়লায়ী (রহ.) তাকবীরে তাহরীমার মাসআলা আলোচনা করার পর লিখেছেন, وعلى هذا الخلاف الخطبة والقنوت والتشهد . ’একই মতবিরোধ খুৎবা, দুআয়ে কুনূত এবং তাশাহহুদের ক্ষেত্রেও রয়েছে। ’ [তাবয়ীনুল হাকায়িক লিয্যায়লায়ী শরহে কানয : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-১১০] ফাতাওয়ায়ে তাতারখানিয়াতে কিরাআতের মাসআলায় ইমাম আবু হানীফা (র.)-এর রুজু‘ করার কথাকে নির্ভরযোগ্য বলা হয়েছে।

[ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া খণ্ড-১০, পৃষ্ঠা-৪৭৫] কিন্তু খুৎবার ব্যাপারে বর্ণিত আছে যে, ولو خطب بالفارسية جاز عند أبى حنيفة رحمه الله على كل حال . ‘যদি ফার্সী ভাষায় খুৎবা দেয়া হয় তাহলে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে সর্বাবস্থায় সহীহ হয়ে যাবে। ’ [ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া, কিতাবুসসালাত শারায়িতুল জুমআ : খণ্ড-২, পৃষ্ঠা-৬০] এছাড়া ফার্সী ভাষায় তাকবীরে তাহরীমা বলার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও সাহেবাইনের মধ্যকার মতবিরোধ উল্লেখ করার পর তিনি লিখেছেন, والتشهد والخطبة على هذا الأختلاف . ‘এই মতবিরোধ তাশাহহুদ ও খুৎবার ব্যাপারে রয়েছে। ’ [ফাতওয়ায়ে তাতারখানিয়া : খণ্ড-১, পৃষ্ঠা-৪৪০] মাওলানা আব্দুল হাই লাক্ষেèৗভী (রহ.) লিখেছেন- وفى الهداية وجامع المضمرات والمجتبى وغيرها أن الخطبة على الإختلاف يعنى أنه يجوز عند أبى حنيفة بغير العربية للقادر والعاجز كليهما وعندهما لاحد هما. ‘হিদায়া’ ‘জামিউল মুজমারাত’ এবং ‘মুজতাবা’ ইত্যাদি গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, খুৎবার ক্ষেত্রে ইমাম আবু হানীফা (রহ.) ও সাহেবাইনের মাঝে মতবিরোধ রয়েছে। অর্থাৎ ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে খুৎবা অন্য কোনো ভাষায় ওই ব্যক্তির জন্য জায়েয যে আরবী ভাষায় খুৎবা দিতে সক্ষম এবং তার জন্যও জায়েয যে আরবী ভাষায় খুৎবা দিতে অক্ষম। ’ [আকামুন নাফায়েস : পৃষ্ঠা-৯১] উপরে বর্ণিত পুরো আলোচনা দ্বারা এ কথা প্রতিভাত হলো যে, জুমআর খুৎবার ব্যাপারে ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মত আজো তাই আছে যে, তার আরবী ছাড়া ভিন্ন কোনো ভাষায় আদায় হয়ে যাবে, এর থেকে ইমাম সাহেব (রহ.) রুজু করেননি।

বিজ্ঞ হানাফীগণ এর ওপরই ফাতওয়া দিয়েছেন। কিন্তু এখানে একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ইমাম আবু হানীফা (রহ.)-এর মতে ‘আবরী ভাষা ছাড়া ভিন্ন কোনো ভাষায় জুমআর খুৎবা আদায় হয়ে যাবে। ’- এর প্রকৃত মর্ম শুধু এতটুকু যে, এর দ্বারা খুৎবার [وجوب] ‘অপরিহার্যতা’ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। আর ওই খুৎবা এই হিসাবে ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.