পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কম নারীই আছেন, যাদের নিয়ে আজকের আধুনিক যুগেও আলোচনা হয়। আর এমন প্রেমকাহিনীর সংখ্যাও খুব বেশি নয়, যেগুলো আজো মানুষকে আলোড়িত করে, আন্দোলিত করে। কিন্তু ট্রয়ের হেলেন আর তার সঙ্গে যুবরাজ প্যারিসের প্রেমকাহিনী সভ্যতার ইতিহাসে একেবারেই অন্যরকম স্থান দখল করে আছে। ভালোবাসা এবং জিঘাংসা, সৃষ্টি ও ধ্বংস, রাজকীয় বিশ্বাস আর শঠতা যে হেলেনকে হাজার বছরের রহস্যময়ী নারীর খেতাব দিয়েছে; যার প্রেমের জন্য ১২ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ চলে। এমন প্রেম পৃথিবী অস্বীকার করে কী করে?
খ্রিস্টপূর্ব ১২১৪ অব্দ।
স্পার্টার রাজা টিনডারিউস এবং তার স্ত্রী লিডার ঘর আলোকিত করে জন্ম নেয় এক ফুটফুটে কন্যাসন্তান। রাজজ্যোতিষ সেই শিশুটির নাম রাখেন হেলেন। রাজজ্যোতিষ তখনই ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে এই মেয়ে পৃথিবীতে একদিন দারুণ রকম বিখ্যাত হবে। বলা বাহুল্য, জ্যোতিষের সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে সত্য হয়েছিল। আর সে কারণেই এত বছর পরও তাকে ঘিরে আলোচনা হচ্ছে, মানুষের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন হেলেন।
মহাকবি হোমারের 'ইলিয়ড ও অডেসি' এবং ইউরিপিডিসের 'হেলেন'-এর বর্ণনা অনুযায়ী টিনডারিউস বাহ্যত হেলেনের জনক হলেও হেলেনের প্রকৃত পিতা দেবতাধিরাজ জিউস।
দিন গড়াতে থাকে। আস্তে আস্তে স্বর্গীয় রূপ-লাবণ্য আর অসাধারণ মোহনীয় নারীত্বের পূর্ণতা নিয়ে বেড়ে উঠতে থাকেন ট্রয় অব হেলেন। দিন যত গড়াতে থাকল হেলেনের সৌন্দর্য আর মোহনীয়তার খবর চারদিকে ততই চাউর হতে থাকল। হেলেনের রূপ-সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়ে গ্রিসের বহু রাজপুত্র তার পাণিপ্রার্থী হন।
আর এত পাণিপ্রার্থীর মাঝখান থেকে সৌভাগ্যবান হিসেবে আবিভর্ূত হন স্পার্টার রাজা মেনেলাউস। কিন্তু মেনেলাউসকে স্বামী হিসেবে বরণ করে নিতে রাজি ছিলেন না হেলেন। তিনি আসলে তাকে বরণ করে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন। এর পেছনেও রয়েছে অনেক নাটকীয়তা। হেলেনের পাণিপ্রার্থী অন্যান্য যুবকের মতো হেলেনের রূপের কাহিনী একসময় স্পার্টার রাজা মেনেলাউসের কানেও চলে আসে।
হেলেনের জন্য পাগল হয়ে উঠলেন মেনেলাউস। প্রায় ৬০ জন প্রহরী নিয়ে হাজির হয় জিউসের বাড়িতে, রাজার অনুরোধ আর বিনয়ে মেয়েকে বিয়ে দিতে রাজি হয়ে যান জিউস! শুরু হয় নতুন অধ্যায়ের। মেনেলাউস বয়সে ৪০ বছরের বড় হলেও জীবনের চেয়ে বেশি ভালোবাসতেন হেলেনকে। মেনেলাউস হেলেনের জন্য প্রহরী নিযুক্ত করেন প্রায় ৮০ জন, তার গোসল, খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-পরিধান এমনকি চুল অাঁচড়ানোর জন্যও সেবিকারা থাকত সদাব্যস্ত। হেলেনের মুখের হাসি দেখার জন্য মেনেলাউস নানা উপায় অবলম্বন করতেন, কখনো গোলাপ ফুল, কখনো দামি পোশাক নিয়ে হাজির হতেন হেলেনের সামনে।
নানা আয়োজনে হেলেনকে ভালোবাসতে চাইলেও হেলেন মোটেই ভালোবাসতেন না মেনেলাউসকে! সব সময় ভিন্ন কিছু পাওয়ার আশায় উদাসীন থাকতেন হেলেন। কালেভদ্রে হাসি ফুটত হেলেনের মুখে। নিজেকে সব সময় আড়ালে রাখতেই পছন্দ করতেন তিনি। নিজের মনের কথা কখনো কাউকে খুলে বলতেন না।
এর মধ্যেই গল্পের পটভূমিকায় আবিভর্ূত হন এই গল্পের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ট্রয় যুবরাজ প্যারিস।
আর এই প্যারিসের আবির্ভাবের পর থেকেই পাল্টে যেতে থাকে পুরো গল্পের গতিপথ। আর এই পাল্টানো এতটাই তীব্র ছিল যে শেষ পর্যন্ত গোটা ট্রয় নগরী ধ্বংসের পরই কেবল শেষ হয়েছিল এই গল্পের বিবর্তন। মাঝখানে ফেলে যায় ১২ বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের এক বিরল ইতিহাস।
গ্রিক ও ট্রয় [বর্তমান তুরস্ক] ছিল পাশাপাশি দুটি রাষ্ট্র। তবে এর মধ্যে ছিল এজিয়ান নামক বিখ্যাত সাগর।
খ্রিস্টপূর্ব ১২৩০ সালের দিকে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিস ও হেক্টর ব্যবসা-বাণিজ্য সংক্রান্ত চুক্তি করার জন্য স্পার্টায় আসেন। স্পার্টার রাজা মেনেলাউস দুই রাজপুত্রকে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে বরণ করে নেন। তাদের আগমনে রাজ্যকে অন্যরকম সাজে সাজানো হয়। রাজ্যে উৎসবের রং লাগে। ট্রয়ের যুবরাজের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়।
আর এই নৈশভোজের সময়ই যুবরাজ প্যারিসের সঙ্গে পরিচয় ঘটে অনিন্দ্যসুন্দরী হেলেনের। মেনেলাউস নিজেই স্ত্রী হেলেনকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। কিন্তু কে জানত এই পরিচয়টাই একসময় জীবনের সবচেয়ে বড় ভুলে পরিণত হবে মেনেলাউসের। ব্যবসায়িক আলোচনার জন্য স্পার্টায় ২০ দিন থাকার দরকার ছিল প্যারিস ও হেক্টরের। হেক্টর ও মেনেলাউস মূলত ব্যবসায়িক নানা দিক আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন।
প্যারিসের বড় ভাই ছিলেন হেক্টর। ফলে বাণিজ্যসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তার ঘাড়েই ন্যস্ত থাকত। আর এই ফাঁকে প্যারিস গোপনে দেখা করতেন হেলেনের সঙ্গে। প্রথম দেখাতেই হেলেনের রূপ প্যারিসকে বিমোহিত করেছিল। হেলেনের প্রেমে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন প্যারিস।
অন্যদিকে ট্রয়ের রাজপুত্র প্যারিসও কম যান না। তিনিও ছিলেন সুপুরুষ। এর পরও প্যারিসের সঙ্গে একটা গোপন সম্পর্কে জড়ানোর বিষয়ে মোটেও আগ্রহী ছিলেন না হেলেন।
কিন্তু নিয়তির লিখন না যায় খণ্ডন। আস্তে আস্তে প্যারিসের দিকে ঝুঁকতে থাকেন হেলেন।
প্যারিসের চেহারা, গায়ের গড়ন, শরীর কাঠামো সবকিছুই আকর্ষণ করতে শুরু করে হেলেনকে। আর তাই অল্প সময়ের মধ্যেই হেলেনও প্যারিসের প্রতি প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়েন। এর মধ্যেই হেক্টর ও প্যারিসের স্পার্টার কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। বিদায়ের পালা চলছে। ভোর হলেই তারা রওনা দেবেন ট্রয়ের উদ্দেশে।
রাজা মেনেলাউসের আপ্যায়নের কোনো কমতি নেই। বিশেষ আয়োজনের খাবার-দাবার আর সুন্দরী রমণীদের নাচের দৃশ্য দিয়ে অতিথিদের বিনোদিত করলেন রাজা মেনেলাউস। তখনো তিনি জানতেন না কত বড় ধাক্কা অপেক্ষা করছে তার জন্য। নর-নারী, প্রহরী ও হেক্টর, রাজা ও ট্রয়ের অতিথিরা যখন আমোদ-প্রমোদ আর নাচ-গান নিয়ে ব্যস্ত তখন প্যারিস গোপনে চুপিসারে যান হেলেনের ঘরে। হেলেনও যেন প্যারিসের অপেক্ষায়ই প্রহর গুনছিলেন।
প্রিয় মানুষকে কাছে পেয়ে দুজনেই আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন। এরপর হেলেনকে নিজের সঙ্গে নিয়ে যেতে চাইলেন প্যারিস। ভয়াবহ বিপদের আশঙ্কা থাকলেও প্রেমের টানে হেলেনও রাজি হলেন যেতে। হেক্টর এসবের কিছুই জানতেন না। যথারীতি সাধারণভাবেই অতিথিদের বিদায় জানাল স্পার্টাবাসী।
তখনো কেউ জানত না তাদের প্রিয় রানীকে সঙ্গে করে নিয়ে যাচ্ছে ট্রয়ের রাজকুমার প্যারিস।
এজিয়ান সাগরের মাঝপথে এসে প্যারিস হেক্টরকে বলেন, হেলেন তাদের সঙ্গে এসেছেন। প্যারিসের কথা শুনে অবাক হয়ে যান হেক্টর! রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে চটে যান প্যারিসের ওপর। নাবিকদের বলেন জাহাজ স্পার্টার দিকে ঘোরাতে। কিন্তু প্যারিসের অনুরোধ আর কান্নায় হেক্টর নিজের মত পরিবর্তনে বাধ্য হন।
এদিকে স্পার্টায় ছড়িয়ে পড়ে প্যারিস হেলেনকে অপহরণ করে ট্রয়ে নিয়ে গেছেন। মেনেলাউস পাগলের মতো হয়ে সাহায্যের আহ্বান জানান তার আপন ভাই আর্পসের রাজা আগামেননের। আগামেনন গ্রিসের সম্মান ফিরিয়ে আনার জন্য গ্রিসের সব রাজাকে অনুরোধ জানান। প্রায় এক হাজার জাহাজ নিয়ে ট্রয়ের উদ্দেশে রওনা দেয় গ্রিসবাসী।
অন্যদিকে হেলেন কিন্তু যুবরাজ প্যারিসের সঙ্গে সুখেই ছিলেন।
ট্রয়ে গিয়ে হাসি-আনন্দ ভালোবাসার জীবন আর যৌবনের পূর্ণতা পায় সুন্দরী হেলেন। প্যারিসও নিজের জীবনের সার্থকতা খুঁজে পান হেলেনের মধ্যে। এর মধ্যেই হঠাৎ রাজ্যময় বিপদ ঘণ্টা বাজতে থাকে। রাজ্যের প্রজারা-বিপদ সংকেতে দিগ্বিদিক ছোটাছুটি করতে থাকে। রাজ্য থেকে হেক্টর ও তার বাবা দেখতে পান হাজার হাজার জাহাজ নিয়ে গ্রিকরা ধেয়ে আসছে ট্রয়ের দিকে।
মুহূর্তের মধ্যেই কালো মেঘ নেমে আসে হেলেনের চোখে-মুখে। গোপনে রাতে ট্রয় থেকে পালিয়ে যেতে চান হেলেন। কিন্তু ধরা পড়েন হেক্টরের হাতে। হেক্টর তাকে সাহস দেন। এতে ট্রয়ে থেকে যান হেলেন।
জাহাজ থেকে সর্বপ্রথম নামেন গ্রিক বীর একিলিস। নেমেই যুদ্ধ শুরু করেন একিলিস ও তার সঙ্গীরা। প্রথম যুদ্ধেই ট্রয় নগরীর বন্দর দখল করেন নেয় গ্রিকরা। এভাবে টানা ১২ বছর বন্দর ও রাজ্য অবরোধ করে রাখে গ্রিকরা। বিভিন্ন সময়ে যুদ্ধে নিহত হয় একিলিসের ভাই উইরোরাস, প্যারিসের বড় ভাই ট্রয় বীর হেক্টর ও নাম না জানা উভয় পক্ষের হাজারো যোদ্ধা।
যুদ্ধে সহজে জয়লাভ না করতে পেরে গ্রিকরা প্রতারণার আশ্রয় নেয়। তৈরি করে বিশালাকৃতির ঘোড়া। যার নাম ট্রোজেন হর্স। ঘোড়ার মধ্যে লুকিয়ে রাখে শত শত সৈন্য। উপহার হিসেবে পাঠায় ট্রয় রাজার কাছে।
রাজ্যের বাইরে লুকিয়ে থাকে গ্রিকরা, কিন্তু এসবই অজানা থাকে ট্রয়বাসীর কাছে। মহা-আনন্দে আর উৎসাহে ঘোড়াটিকে রাজ্যের ভেতরে নেয় ট্রয়বাসী। কিন্তু বিধিবাম! গভীর রাতে ঘোড়া থেকে বের হয়ে ট্রয়বাসীর ওপর অতর্কিত হামলা চালায় গ্রিকরা। গ্রিক সৈন্যরা ট্রয় রাজ্যে ধরিয়ে দেয় আগুন। মুহূর্তের মধ্যে দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ট্রয় নগরী।
আগুনে পুড়ে হাজার হাজার সৈন্য আর নিরীহ নাগরিক মারা যায়। একিলিস ছুটে যান হেলেনকে বাঁচানোর আশায়; কিন্তু প্যারিস তীর বিদ্ধ করে মেরে ফেলেন একিলিসকে। পালিয়ে যান হেলেন, জয়লাভ করে গ্রিকরা। কিন্তু যে হেলেনের জন্য এত কিছু তাকে মেনেলাউস কাছে পেয়েছিলেন কি না তা আজো অজানা। ইতিহাস আর মিথোলজি, উভয় মাধ্যমই ট্রয় নগরী ধ্বংসের জন্য হেলেনকেই দায়ী করে থাকে।
হেলেন আসলে নিয়তির ক্রীড়নক বই আর কিছুই ছিলেন না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।