লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ।
যুবকটি ডক্টর সাইমনের মুখোমুখি বসে আছে। তার দুটো চোখের তারায় আলো আছে, কিন্তু সে কিছু দেখছে বলে মনে হচ্ছে না।
কয়েকদিনের না কামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে গভীর কালির পোঁচ। সব মিলিয়ে একজন বিধ্বস্ত, ভেঙে পড়া মানুষের চেহারা। কিছুদিন আগে এক প্রতারক প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজের সর্বশেষ পেনিটাও তুলে দিয়ে এখন সে সর্বস্বান্ত। ডক্টর সাইমনের বিল দিতে পারবে কীনা, সে চিন্তা তার আছে বলে মনে হয় না। হয়তো আত্মীয়স্বজনই ঠেলেঠুলে পাঠিয়েছে।
ডক্টর সাইমন সামনে ঝুঁকে এসে বললেন, যখন আপনি গিয়ে দেখলেন যে কোম্পানিটির কোন অস্তিত্বই নেই, তখন কী মনে হল? পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে গেল, না মাথায় আকাশ ভেঙে পড়লো? এখন আপনার বন্ধুরা আপনাকে কী বলছে? নিশ্চয়ই পিঠে হাত বুলোতে বুলোতে আড়ালে “নির্বোধ” বলছে? কোথায় মুখ লুকোবেন খুঁজে পাচ্ছেন না, তাই তো? বেঁচে থাকা অর্থহীন মনে হচ্ছে? আত্মহত্যার চিন্তা মাথায় আসে আপনার? একটানা একই স্বরে, দম না ফেলে প্রশ্ন করে যেতে থাকেন ডক্টর, যেন আগে থেকেই মুখস্ত করে রেখেছিলেন।
যুবকটি কথা বলল না। শুধু দেখা গেল, তার এক চোখ থেকে অশ্রু গাল বেয়ে গড়িয়ে নামছে। যেন একটি গাছের গোড়ায় কুড়ুলের কোপ দেয়া হয়েছে অনেকগুলো, এখন শুধু গাছটার শুয়ে পড়া বাকি।
***
মেয়েটি খুব জড়সড় হয়ে বসে আছে।
দু’চোখে স্পষ্ট ভীতির ছাপ, থেকে থেকে কেঁপে উঠছে। বারবার চারিদিকে তাকাচ্ছে, যেন এখুনি কোন বুনো জানোয়ার ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে।
মেয়েটির বাবা-মা বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। সাইকিয়াট্রিক সেশনগুলোতে ডক্টর সাইমন পেশেন্ট ছাড়া আর কাউকে থাকতে দেন না। একান্তে কথা বললে পেশেন্ট অনেক কিছু খুলে বলে, যেটা অন্য কেউ, এমনকি আপন কেউ সামনে থাকলেও বলে না।
অল্পবয়স্কা তরুণীটি, এই তো কয়েকদিন আগে তার ছেলেবন্ধুর কাছে “সেক্সুয়ালি অ্যাবিউজড” হয়েছে। এখন তার মন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছে, অনেককেই চিনতে পারছে না, উদ্ভ্রান্ত আচরণ করছে, কাউকে হঠাৎ ছুটে গিয়ে আক্রমণ করছে, আর সবসময় ভীষণ আতঙ্কে তটস্থ হয়ে আছে।
ডক্টর সাইমন সামনে ঝুঁকে বললেন, ছেলেবন্ধুটিকে তুমি খুব পছন্দ করতে, তাই না? নিশ্চয়ই ভালোবাসার নাম করে অনেকবার সে ঘনিষ্ঠ হয়েছে, তোমাকে ব্যবহার করেছে? আচ্ছা, সে ঠিক কীভাবে তোমাকে আদর করতে পছন্দ করতো বল তো? ব্যাপারগুলোর কি ছবি তুলে রেখেছিলে তোমরা, নাকি ভিডিও করেছ? ছেলেটা কি অবসর সময়ে সেগুলো বসে বসে দেখত, পৈশাচিক আনন্দ পেত দেখে? এখন ছেলেটা কি হাজতে, নাকি আরেকটা মেয়েকে ... ... যাক গে। তোমাদের শেষবারের ঘনিষ্ঠতার ঘটনাটা একটু খুলে বলতে পারবে? তোমার শরীরের কোথায় কোথায় ওর নখের আঁচড় আছে?
মেয়েটি সহসা চিৎকার করে ওঠে, হাঁটু গেড়ে বসে দু’হাতে কান চেপে ধরে, আর একটানা আর্তনাদ করতে থাকে যেন ডক্টর সাইমনের প্রশ্নগুলো তার কানে না যায়।
***
তেরো বছরের বালক রবিন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে।
খুব অসহায় দেখাচ্ছে তাকে। ডক্টর সাইমনের দিকে সে একবারও তাকায় নি, মাথা নিচু করে ফুঁপিয়ে যাচ্ছে।
তার পিতামাতা পরস্পরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। কাগজপত্রে লেখা আছে, “ব্যক্তিত্বের সংঘাতজনিত কারণে” তারা বিচ্ছেদ চাইছেন। স্বভাবতই তাঁদের ছেলে কার কাছে থাকবে তা নিয়ে ঝামেলা হচ্ছে, দু’জনের কেউই দাবী ছাড়ছেন না।
দু’জনেরই যুক্তি, শুধু তাঁর কাছে থাকলেই রবিন যথাযথ যত্নে বড় হবে এবং উন্নত জীবনযাত্রার সব সুযোগ-সুবিধে পাবে। রবিন আপাতত তার এক আত্মীয়ের বাসায় আছে, যিনি ওকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি এক-আধবার বলেছিলেন, বাবা-মা একসাথে থাকলেই তো রবিন উন্নত জীবনযাত্রার ডবল সুযোগ-সুবিধে পায়! তাঁর অতি হাস্যকর যুক্তি রবিনের পিতামাতা কানে তোলেন নি, বলাই বাহুল্য। মামলা পুরোদমে চলছে, এবং দু’পক্ষের উকিলই স্ব-স্ব মক্কেলের বিজয় সুনিশ্চিত, সেই সাথে প্রতিপক্ষের ভরাডুবিও – এমন আস্ফালন করেছেন।
বেচারা রবিন এই মুহূর্তে যে মানসিক অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তাকে মনোবিজ্ঞানের পরিভাষায় বলা হয় “সিভিয়ার ডিপ্রেশন” অর্থাৎ প্রচণ্ড বিষণ্ণতা।
রবিন দিনের বেশীরভাগ সময় মুখ ভার করে বসে থাকে, কারো সাথে কথা বলে না। আর বাকীটা সময় ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, এখন যেমনটা করছে। ডিপ্রেশনটা সিভিয়ার হোক বা না হোক, সে যে ভয়ানক বিপদের মধ্যে আছে তা তো বোঝাই যায়, কারণ সবাই বলছে যে ওর আচরণ এবং তাকানোর ধরণ মোটেই স্বাভাবিক নয়। এসব ক্ষেত্রে চরম অবস্থায় পেশেন্ট কী করে বসে ঠিক নেই। ওর বয়সটা কম বলে ভয় আরও বেশী, কারণ এই বয়সে মানুষ ঝড়ঝাপটা ঠিকমতো সামলানোর জোর রাখে না।
ডক্টর সাইমন গম্ভীর স্বরে বললেন, রবিন, ব্যাপারটা খুলে বল তো, ঠিক কী হয়েছিল? পারসোনালিটি কনফ্লিক্ট জাতীয় ষাঁড়ের গোবরে (বুলশিট) আমার বিশ্বাস নেই। আমার ধারণা, মূল ব্যাপারটা তুমি বলতে পারবে, যেহেতু তুমি তাঁদেরই সন্তান। কী হয়েছিল? তোমার বাবা কি অফিসের সেক্রেটারির সাথে আপত্তিকর অবস্থায় তোমার মায়ের সামনে ধরা পড়েছিলেন, নাকি তোমার মা নিজের বাড়িতে প্রতিবেশীর সাথে ... ... আহা দ্বিধা কোরো না। আমাকে সবকিছু বলতে পারো, নিশ্চিন্তে। আমি তো তোমার ভালোই চাই।
শতকরা আশিভাগ ডিভোর্সের কারণটা কিন্তু ঐ, একজন আরেকজনের কাছে বিশ্বস্ত থাকতে পারে না বলেই যত বিপত্তি।
রবিন কথা বলছে না দেখে তিনি আবার বলেন, বলে ফেলো, বলে ফেলো, দেরী করছ কেন? যত তাড়াতাড়ি বলে ফেলে নিজেকে হালকা করবে, ততই তোমার মঙ্গল।
রবিন এই প্রথমবারের মতো মুখ তুলে তাকাল। ওর চোখে এখন আর জল নেই। নাকের ফুটো দুটো অসম্ভব ফুলে উঠেছে, গাল দুটো টকটকে লাল।
খুব হিংস্র দেখাচ্ছে ওকে।
***
হঠাৎই শহরের পত্রিকায় খবর, খ্যাতনামা সাইকিয়াট্রিস্ট ডক্টর সাইমন গ্রেফতার হয়েছেন। অভিযোগটি বিচিত্র। তিনি নাকি তাঁর সাইকিয়াট্রিক সেশনে পেশেন্টদেরকে তাঁদের সবচেয়ে দুঃখের কথাগুলো রসিয়ে রসিয়ে অত্যন্ত কুৎসিতভাবে জিজ্ঞেস করে অমানুষিক যন্ত্রণা দিতেন, পাগলের মতো কাঁদাতেন। তাঁর এই অভিনব নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে সাক্ষ্য দিয়েছে সদ্য দেউলিয়া হওয়া এক যুবক ডেভিড অ্যালগার এবং এক তরুণী লুসি মারিয়া।
তেরো বছরের এক বালক রবিন টিম্বারলেককেও তার ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন নিয়ে তিনি একই পদ্ধতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন, কিন্তু রবিন হঠাৎই ডক্টর সাইমনের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, পকেট থেকে একটা ছোট্ট চাকু বের করে তাঁর বাঁ চোখে আঘাত করে। গুরুতর আহত ডক্টর সাইমন এখন পুলিশি হেফাজতে আছেন, চোখটা আছে না গেছে জানা যায় নি। এই বালকের পকেটে চাকু থাকার কথা নয়, কোত্থেকে এলো সেটা এক রহস্য।
কয়েকদিন শহরের আকাশে-বাতাসে খবরটা ঘুরে বেড়ালো, তারপর চাপা পড়ে গেল। অনেক জল্পনা-কল্পনা হল, এমন অপরাধীর কী সাজা হওয়া উচিৎ, ঐ রোগীদের সঠিক চিকিৎসার ব্যবস্থা কে করবে, ডক্টর সাইমন এখন কোথায় আছেন – এসব।
ধীরে ধীরে সব স্বাভাবিক হয়ে এলো, এবং বুড়ো জনসন শেলবি আবার রাস্তায় তাঁর পুরনো ছড়িটি নিয়ে আগের মতোই হেঁটে বেড়াতে লাগলেন। সবাই ভুলেই গেল, এখানে, এই ছোট ছিমছাম দালানটিতেই এসব ব্যাপার ঘটতো। ডক্টর সাইমন যেন ভোজবাজির মতো বাতাসে মিলিয়ে গেলেন। কে জানে, হয়তো তাঁর অনেকদিনের জেল হয়েছে, হয়তো কেউ তাঁকে ডাক্তার হয়েও মানসিক ভারসাম্যহীন বলে প্রমাণ করতে পেরেছে বলে দূরের কোথাও সাইকোথেরাপি নিচ্ছেন। মানুষের এসব নিয়ে এত ভাবার সময় নেই।
সব মিটে যাবার পর, “পুলিশ লাইন ডু নট ক্রস” লেখা হলুদ টেপগুলো উঠে যাবার পর সেই চেম্বারটাতেই নতুন নামধাম-নেমপ্লেট নিয়ে বসতে লাগলেন আরেকজন সাইকিয়াট্রিস্ট, ডক্টর হাডসন। তাঁর ভাই রবসনও ডাক্তার, তবে অর্থোপেডিক। এখানের এক হাসপাতালে কাজ করেন। ডক্টর হাডসন যখন নিবিষ্টচিত্তে রোগীর মানসিক অস্থিরতার বয়ান শুনছেন, তখুনি হয়তো ডক্টর রবসন করাত দিয়ে কারো হাড়গোড় কাটছেন। একেবারেই মেলে না দু’জনের জীবন।
প্রথম প্রথম ডক্টর হাডসনের বেশ অসুবিধে হতো। এ যুগেও অনেকেই খুব কুসংস্কারাচ্ছন্ন। তাই অনেকে এসে জিভ কেটে জিজ্ঞেসই করে ফেলত, আপনি ঐ ডাক্তারটার মতো বদলোক না তো? কেউ আবার তাঁর কাছে থেরাপি নিতে এসে ভয়েই অস্থির হয়ে পড়ত। তবে সময় পাল্টাতে লাগলো না, মাইডিয়ার গোছের ভদ্রলোক ডক্টর হাডসন খুব দ্রুত শহরে পরিচিত হয়ে উঠলেন। এখন দুয়েকজন সুস্থ মানুষও তাঁর সাথে একটু সময় কাটাতে আসে! অনেকে আসে গল্প শুনতে, অনেকদিনের অভিজ্ঞতায় বিচিত্র সব রোগীর ততোধিক বিচিত্র সব কেস স্টাডি তাঁর ঝুলিতে।
তবে ডক্টর হাডসনের একটা সমস্যা হয়েছে, যেটা কাউকে তিনি বলতে পারছেন না। সবসময় হাসিমুখে থাকেন, কিন্তু দুশ্চিন্তা হচ্ছে বেশ। ক’দিন আগে এখানে একটা পোকায় কাটা ডায়েরী পেয়েছেন তিনি, তাতে লেখা আছে, ডক্টর সাইমনও নাকি শৈশবে এক সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে এমনই মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তারপর থেকে তাঁর মনে জেদ চেপে যায়, ঠিক করেন যে একইভাবে অন্য কারো ওপর প্রতিশোধ নিতে হবে। নিতে পেরেওছিলেন, নিজের পেশেন্টদের ওপর।
সেই ডাক্তারের কী হয়েছে তা অবশ্য স্পষ্ট করে লেখা নেই, তবে আভাস পাওয়া যায়। ডক্টর সাইমন তাঁর ডায়েরীতে লিখেছেন, “আমি খুব খুশি যে ঐ পিশাচটা আর পৃথিবীর বাতাসে নিঃশ্বাস নিচ্ছে না”।
এ কথা একটাই ইঙ্গিত করে। ডক্টর সাইমন ঐ সাইকিয়াট্রিস্টকে ... ... কিন্তু সেটার কোন খবর নেই কেন? ব্যাপারটা কি অন্য কোথাও ঘটেছিল? আর ঐ ডাক্তারকে মেরে ফেললে নিজের রোগীদেরকে কেন ... ... মিলছে না, কিছুই মিলছে না। ডক্টর সাইমন মানুষটি বড় রহস্যময়।
আরও কিছু জানতে পারলে ভাল হতো।
ডক্টর হাডসন তাই চিন্তায় আছেন। ডায়েরীটা কাউকে দেখাবেন, না পুলিশের কাছে জমা দেবেন, বুঝতে পারছেন না। একজন সাইকিয়াট্রিস্টও সময়ে সময়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগেন।
(১৬ আগস্ট, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।