আমি না হয় ভালবেসেই ভুল করেছি, ভুল করেছি। নষ্ট ফুলের পরাগ মেখে পাঁচ দুপুরের নির্জনতায় খুন করেছি...
(পাঠক, এটি একটি বিজ্ঞান ভিত্তিক নিরস পোস্ট। তবুও একটু ধৈর্য ধরে পড়ার অনুরোধ রইল। অত্যন্ত জটিল একটি বিষয় সহজভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আশা করি ভাল লাগবে।
)
অতি রহস্যময় এ মহাবিশ্ব
ঘটনাটি শুরু করেছিলেন বিজ্ঞানী হাবল। তিনি ক্যালিফোরনিয়ার মাউন্ট উইলসনের একশ ইঞ্চি টেলিস্কোপ ব্যবহার করে মহাকাশের বিভিন্ন গ্যালাক্সি নক্ষত্র সম্পর্কে গবেষণা করেন এবং বেশ আশ্চর্যজনক তথ্য দেন। তিনি বলেন, মহাবিশ্বের সকল নক্ষত্র বা গ্যালক্সিই পৃথিবী থেকে দূরে সরে যাচ্ছে এবং পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্র বা গ্যালাক্সি যত দূরে সেটির দূরে সরে যাওয়ার হার ততো বেশি। অর্থাৎ দুটি নক্ষত্রের মধ্যে যেটি পৃথিবী থেকে অপেক্ষাকৃত বেশি দূরে সেটির বেগ অপরটির তুলনায় বেশি। ব্যাপারটিকে এভাবে বলা যায়, ধরুন পৃথিবী থেকে একটি নক্ষত্র X এর দূরত্ব এক আলোকবর্ষ (আলো এক বছরে যে দূরত্ব অতিক্রম করে তাকে এক আলোকবর্ষ বলে।
আলোর বেগ সেকেন্ডে ৩ লক্ষ কিলোমিটার) এবং অপর একটি নক্ষত্র Y এর দূরত্ব তিন আলোকবর্ষ। হাবল এর সিদ্ধান্ত মতে পৃথিবী থেকে দুটি নক্ষত্রই সময়ের সাথে দূরে সরে যাচ্ছে এবং Y নক্ষত্রের দূরে সরে যাওয়ার হার অর্থাৎ বেগ X নক্ষত্র থেকে বেশি হবে।
বিজ্ঞানী হাবল- যার আবিষ্কার পৃথিবীকে অবাক করে দেয়
হাবলের এই বিচিত্র আবিষ্কার বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করলেন (না গ্রহণ করার কোন কারণ ছিল না)। পৃথিবীর মানুষ তখন বিস্ময়ের সাথে বুঝতে পারল এই মহাবিশ্ব, যার গ্যালাক্সি নক্ষত্রগুলোকে এতদিন স্থির ধরা হয়েছিল সেগুলো মোটেই স্থির নয়। বরং প্রচণ্ড গতিতে একে অপরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
আর সাথে সাথে সকলের মনে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগল, কি কারণে এই ক্রমাগত ছুটে চলা?
সম্প্রসারণশীল মহাবিশ্ব- The Expanding Universe
এই প্রশ্নের উত্তর দুভাবে দেওয়া হয়। প্রথম উত্তরটি দেন ফ্রেড হয়েল নামের এক জ্যোতির্বিদ। তিনি বলেন, এটা ঠিক যে মহাবিশ্ব ক্রমাগত স্ফীত হচ্ছে। অর্থাৎ একটি গ্যালক্সি অপর গ্যালাক্সি থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। কিন্তু এ ঘটনাটি প্রকৃতপক্ষে একটি চলমান স্থিতি অবস্থা (Stealy State)।
যার অর্থ, এভাবে চলতে থাকলে সময়ের সাথে সাথে একটি নক্ষত্র অপরটি থেকে অনেক দূরে সরে যাবে। ফলে বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের ঘনত্ব কমে যাবে। কাজেই সেটা ঠিক রাখার জন্য নতুন নতুন পদার্থ জন্ম নিতে হবে।
ফ্রেড হয়েলের এ ব্যাখ্যা সত্য হতে হলে ক্রমাগত মহাবিশ্বে নতুন পদার্থ জন্ম নিতে হবে। ফলে নতুন গ্যালক্সির সৃষ্টি হতে হবে।
প্রকৃত সত্য হল, বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড এত বড় যে ফ্রেড হয়েলের ব্যাখ্যাটি সত্যি হওয়ার জন্য খুব বেশি পরিমাণ পদার্থের জন্ম নিতে হয় না। এক কিউবিক মিটারে প্রতি বিলিওন বছরে (শত কোটি বছরে) মাত্র একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর (যার পারমাণবিক সংখ্যা ১.০০৮ এবং ভর ০.০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০০১৬৭৩ গ্রাম!!!) জন্ম হলেই যথেষ্ট!!
বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো-বিগ ব্যাং তত্ত্বের প্রবক্তা
যাই হোক প্রশ্নটির দ্বিতীয় উত্তর দিয়েছিলেন বিজ্ঞানী জর্জ গ্যামো। তার ব্যাখ্যাটিকে এক শব্দে নাটকীয় বলে আখ্যায়িত করা যায়। তার মতে, আমরা যেহেতু দেখছি যে নক্ষত্রগুলো প্রচণ্ড বেগে পরস্পর থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, এর অর্থ হল অতীতে অবশ্যই এরা সবাই এক সাথে একটি মাত্র বিন্দুতে ছিল। তখন কোন এক কারণে এই বিন্দুর মাঝে প্রচণ্ড শক্তি সম্পন্ন এক বিস্ফোরণ হয় এবং এর ফলে অসংখ্য মৌলিক কণিকা বের হয়ে আসে।
যারা পরবর্তীতে বিভিন্ন জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে একীভূত হয়ে নানা রকম বস্তু সৃষ্টি করে। জর্জ গ্যামোর এই ব্যাখ্যার নামই হল বিগ ব্যাং (Big Bang) বা বৃহৎ বিস্ফোরণ।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব- The BIG BANG Theory
এই বিগ ব্যাং তত্ত্বটি পরবর্তী সময়ে অসংখ্য বিতর্কের জন্ম দিয়েছিল। অনেকে অনেক ধরনের প্রশ্ন করা শুরু করে। যেমনঃ এত বড় বিশ্ব কিভাবে একটা মাত্র বিন্দুতে ছিল? বিস্ফোরণটি কেন ঘটল? কিভাবে ঘটল? না ঘটলেই বা কি হত? বিস্ফোরণটি ঘটার আগে কি ছিল? বিস্ফোরণের পর এত গ্রহ নক্ষত্র সৃষ্টি হল কিভাবে? ইত্যাদি...
কিন্তু শেষ পর্যন্ত গ্যামোর এই মোটামুটি উদ্ভট তত্ত্বটি (!) টিকে গেল (প্রকৃতপক্ষে বিজ্ঞানের দৃষ্টিটে ব্যাপারটি মোটেই উদ্ভট নয়)।
বিশ্বের তাবৎ বড় বড় বিজ্ঞানীরা বিগ ব্যাং কে সমর্থন করেন। এর পেছনে কিছু ঘটনা প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। ১৯৬৫ সালে রবার্ট উইলসন ও আর্নো নামক দুইজন বিজ্ঞানীর এক পরীক্ষা এক্ষেত্রে সবচেয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের দুজনের পরীক্ষা লব্ধ ফলাফল থেকে সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মহাবিশ্বের তাপমাত্রা হচ্ছে তিন ডিগ্রি কেলভিন। সেই সময়ে প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু জ্যোতির্বিজ্ঞানী হিসেব করে বের করলেন যে বিগ ব্যাং এর কারণে যে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়েছিল সেখানে অবশ্যই প্রচণ্ড তাপমাত্রা সৃষ্টি হয়েছিল।
এতদিনে তার তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি কেলভিনে নেমে এসেছে।
পাঠক, লক্ষ করুন, উইলসন ও আর্নোর পরীক্ষা লব্ধ ফলাফলও কিন্তু একই কথাই বলেছিল। এইরকম আরো বেশ কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা এবং গবেষণা শেষ পর্যন্ত বিগ ব্যাং তত্ত্বকে দাঁড় করিয়ে দেয়।
বিগ ব্যাং তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই বিজ্ঞানীদের মাথায় নতুন এক প্রশ্নের উদয় ঘটে। আমাদের মহাবিশ্ব না হয় বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে উৎপত্তি লাভ করছে।
কিন্তু এই মহাবিশ্বের পরিণতি কি? বা মহাবিশ্বের কি আসলেই কোন পরিণতি আছে? নাকি মহাবিশ্ব এভাবে চিরকাল স্ফীতই হতে থাকবে?
সে আবার অনেক কথা। মহাবিশ্বের পরিণতি সম্পর্কে তিনটি ধারণা রয়েছে। প্রথম ধারণা, মহাবিশ্বের গ্রহ- নক্ষত্রগুলো ক্রমাগত পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে এবং এ প্রসারণ অনন্ত অর্থাৎ ক্রমাগত ঘটতেই থাকবে। দ্বিতীয় ধারণা, মহাবিশ্বের নক্ষত্র গ্যালাক্সিগুলোর সম্প্রসারণ হবে ঠিকই, তবে তা হবে বদ্ধ সম্প্রসারণ। অর্থাৎ সময়ের সাথে নক্ষত্রগুলো পরস্পর থেকে দূরে সরে যেতে থাকবে, কিন্তু তাদের প্রসারণের হার কমতে থাকবে।
অর্থাৎ এক সময় প্রসারণ প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। তৃতীয় ধারণা অনুযায়ী, মহাবিশ্ব প্রসারিত হতে হতে এমন এক সময় আসবে যখন নক্ষত্র গ্যালাক্সিগুলোর গতি থেমে যাবে এবং এগুলো আবার বিপরীত দিকে সরে আসতে থাকবে। অর্থাৎ, মহাবিশ্বের উপাদানগুলো যেভাবে প্রসারিত হওয়া শুরু করেছিল তার বিপরীতভাবে সংকুচিত হতে থাকবে যাকে মহাসংকোচন নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ ধারণাই সম্ভবত সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। এ নিয়ে আশা করি কথা হবে অন্য একদিন।
আপাতত এটুকই থাক আজ।
পুনশ্চঃ যারা ধৈর্য ধরে এ পোস্টটি পড়ে ফেললেন, তাদের জন্য সংগ্রামী বেনীআসহকলা সালাম!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।