বাংলা সিনেমা সম্পর্কে যাদের মোটামুটি খোঁজখবর আছে তারা সবাই কম বেশি শাকিব খানকে চেনেন । হাল সময়ে তিনি ঢালিউডের ব্যস্ততম নায়ক এবং সবচেয়ে ব্যয়বহুল নায়কও বটে। শাকিব খানের বয়স কত? অনুমান করা যায় ? ২৬ বছর(!!)। যতদূর জানি ২০০০ সালে তার প্রথম ছায়াছবি মুক্তি পায় এবং তার শুটিং শুরু হয় ১৯৯৮ সালে। সে হিসেবে তিনি ১৪ বছর বয়স (!!) থেকে অভিনয় করেন।
যে বয়সে আমরা পিঠে আটার বস্তার মত করে ব্যাগ ভর্তি বই খাতা নিয়ে স্কুলে যেতাম এবং দু একটা প্রেমের গান গাওয়ার জন্য বড়দের কাছে ইঁচড়ে পাকা ধরনের গালিসমেত কানমলা খেতাম, সেই বয়সেই শাকিব খান বাংলা ছায়াছবিতে নায়িকাদের সাথে প্রেমের অভিনয় করেছেন, বৃষ্টি ভেজা গানের দৃশ্যে নায়িকাকে জড়িয়ে ধরেছেন!! যা হোক, শাকিব খানের বয়স নিয়ে আলোচনা করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। বরং মূল প্রসঙ্গে আসি। আমরা কয়েকজন বন্ধু সিদ্ধান্ত নেই বাংলার ‘কিং খান’ তথা শাকিব খান এর একটি সিনেমা দেখার । ছবির নাম ”নাম্বার ওয়ান শাকিব খান”। তারপর রাজমনী সিনেমা হলে গিয়ে দেখেও আসলাম ছবিটা।
যা হোক এবার ছবির কাহিনিতে চলে আসি। তার আগে একটি কথা বলে নেয়া দরকার, এই ছবি সম্পর্কে উইকিপিডিয়াতে যে তথ্য পাওয়া গেছে তা হল এই, ছবিটি বাংকক এ চিত্রায়িত, কমেডি মুভি এসব। ছবি দেখার পর একটু খটকা লাগলো। ছবির কিছু কিছু দৃশ্য ব্যাংককে চিত্রায়িত,ঠিক আছে। তবে এ টাকার অপচয় ছাড়া কিছুই নয়।
যেমন নায়িকাকে নিয়ে ভিলেন তার বাসায় নিয়ে গেল, ছবির কখনোই মনে হয়নি যে ভিলেন এর বাসা বাংকক,কিন্তু নায়িকা বাসা থেকে দৌড়ে পালাল এবং নায়কের কাছে গিয়ে পৌঁছাল এবং জায়গাটা ব্যাংকক। ব্যাপারটা এমন যেন ঢাকা আর ব্যাংকক পাশাপাশি দুটো এলাকা। আর কমেডি ? হ্যাঁ, পরিচালক যে ছবি বানিয়েছেন তা চলচ্চিত্রবোদ্ধা বা যারা মোটামুটি ছবি দেখে থাকেন তাদের জন্য ভালই কমেডির উদ্রেক করেছে। যা হোক ছবির কাহিনিতে প্রবেশ করি। ছবি শুরু হয় একসময়কার জনপ্রিয় নায়িকা নূতনের পর্দায় আগমনের মাধ্যমে ।
তিনি চাকরের বৌয়ের হাতে চাকরকে চড় মারিয়ে শুরুতেই বুঝিয়ে দিলেন তার মাথা কত গরম!! যা হোক, নূতনের মেয়ে আমাদের প্রিয় নায়িকা অপু বিশ্বাস। বাথ টাব থেকে এই ছবিতে তার প্রবেশ। যাই হোক তার মা নিয়মিত তার ওজন পরীক্ষা করেন। এটা একটা ভাল দিক। বাংলা ছবির নায়িকাদের ওজন নিয়ে আমাদের যে কৌতুহল তার কিছুটা এর দ্বারা নিবৃত হয়।
তবে নূতন মোটেও খুশি হননি, তিনি চান তার মেয়ের ফিগার হবে স্লিম অথচ তার ওজন কিনা ৬৭কেজি। অবশ্য এর জন্য দোষ দেওয়া হয় নায়িকার বাবা আলী রাজকে। তিনি আইসক্রিম আর কোল্ডড্রিংক্স খাইয়ে মেয়ের এত বড় সর্বনাশ করছেন। যা হোক নূতনের ইন্ডাস্ট্রির শ্রমিকরা আন্দোলন করে। তাদের নেতাকে গুন্ডা দিয়ে খুন করানোর ব্যবস্থা করানো হয়।
যেই মুহর্তে তার মৃত্যু প্রায় হয়েই যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় শাকিব খান এসে উপস্থিত। তারপর আর কী! গুন্ডাদের মেরে বাবা মা’র নাম ভুলিয়ে দিল। আর যাবার সময় তার পরিচয়টিও দিয়ে দিল,”god is one,life is one & I am number one, SHAKIB KHAN”। যা হোক, নায়ক নায়িকার বাড়িতে কাজের লোকের কাজ নেয়। সেখানে সে বলে সে সব কাজ পারে।
নায়িকাকে সে গান শিখিয়ে গানের প্রতিযোগিতায় ফার্স্ট বানিয়ে দেয়। বিশাল বস্তা একাই বহন করতে পারে(অবশ্য বাংলা ছবির নায়ক হতে হলে এ গুণটি থাকা একান্ত জরুরি!!)! নায়িকা নায়কের প্রেমে পরে। এক্সময় সকল বাধা ভেঙ্গে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে থাকে।
এবার ছবির কিছু অসঙ্গতি এবং উল্লেখযোগ্য ব্যাপার তুলে ধরি,
১.প্রথম মারামারির দৃশ্যে শাকিব খানের পিঠে আগুন লেগে যায়, শাকিবের মারামারি করতে তাতে কোন অসুবিধাই হয়নি। এক ফাঁকে তিনি নিজের গায়ে পানি ঢেলে সেই পানি নিভিয়েও ফেলেন।
তার শরীর ভিজে গেল। কিন্তু কিছক্ষন পরই দেখ গেল নায়ক শুকনো জামা কাপড় পরে মারামারি করছেন।
২.নায়িকা কোর্ট ম্যারেজ করার জন্য নায়ক তথা তাদের বাড়ির কাজের লোক শাকিব খানকে নিয়ে উকিলের কাছে যান। কিন্তু শাকিব তা করবে না। অতঃপর নায়িকা আত্মহত্যার ভয় দেখায়।
নায়ক তখন বিয়ে করতে রাজি হয়। তারপরই একটা গানের দৃশ্য। আর এরপর তারা আর বিয়ে করল না। কেন করলেন না,তা পরিচালকই জানেন!!
৩.সম্ভবত এফডিসির ভিতর নায়ক মারামারি করছেন। কিন্তু ক্যামেরা এক আঙ্গেল থেকে ধরলে দেখা যাচ্ছে মারামারি হচ্ছে একটি গলির মুখে,কিন্তু একটু পরই দেখা গেল সেটা হয়ে গেল ফ্যান্টাসি কিংডম বা ওয়ান্ডারল্যান্ড টাইপের কোন একটা জায়গা।
৪.শ্রমিকদের বেতন ঠিকমত দেয় না বলে নায়িকা মা’র সাথে তর্ক করে। অথচ গরিবের প্রতি যে নায়িকার এত ভালবাসা, সেই কিনা হাসতে হাসতে ড্রাইভ করতে করতে রাস্তার ফেরিওয়ালাদের জিনিসপত্র উল্টে দিতে থাকলো হাসিমুখে।
৫.শাকিবকে ছোটবেলায় অপুর নানা গুন্ডা দিয়ে খুন করাতে যায়। কিন্তু তার বাবা বাঁধা দিতে গেলে তাকে খুন করা হয়,এরপর শাকিবের মা এলে তাকেও খুন করা হয় কিন্তু এরপর শাকিবের দাদা এলে তাকে আর খুন না করে সে তাকে ধাক্কা দিয়ে পালাতে যায়। দাদাকে কেন সে খুন করল না কে জানে!! আমার এক বন্ধু তখন বলল দাদাকে মেরে ফেললে শাকিবকে অতীত শোনাতো কে?? ভাল যুক্তি!! পরিচালকের মাথায় বুদ্ধি আছে বলতে হবে!! বলিহারি!!
৬.অপু বিশ্বাস বিশাল বড়লোকের মেয়ে, অথচ পড়ে কোন এক ডিগ্রী কলেজে।
৭.শাকিবকে ভালবাসে যে মেয়েটি,খুশি, তাকে বলছে যে,যদি তার হৃদয়টিকে দুই ভাগ করা যেত তাহলে এক ভাগ পেত রোজ(অপু) আরেক ভাগ পেত খুশি। সত্যিই নায়কের হৃদয় অনেক বড়!!
………………….
এরকম আরো হাজারো অসঙ্গতি রয়েছে এই ছবিতে, যেমন ডিগ্রী কলেজে দুই বছর পড়ার পরও নায়িকা প্রাপ্তবয়স্ক হতে পারেনি, অথচ সে ঠিকই কোর্টম্যারেজ করতে গিয়েছিল এবং কাগজ পত্রও ঠিকঠাক ছিল। শুধু স্বাক্ষর করা বাকি ছিল। আবার এই দেখা যাচ্ছে ঘটনা ঘটছে ঢাকায়,হঠাৎই তা হয়ে গেল বিদেশের কোন শহর(সম্ভবত ব্যাংকক)। আবার নায়িকা যখনই বিপদে পড়ছে তখনই কোত্থেকে যেন ভেল্কিবাজির মত নায়ক এসে উপস্থিত হয়ে পরছে আর নায়িকাকে উদ্ধার করছে(অবশ্য এটা প্রায় বাংলা ছবিতে দেখা যায়)।
যাহোক, এসব নিয়ে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। এই ছবি দেখে একটি প্রশ্ন মনে উদয় হয়েছে আর তা হল,”পরিচালক কি সব দর্শককেই বোকা ভাবেন নাকি তিনি নিজেই বোকা?” পরিচালকের কাছে সবিনয় নিবেদন থাকবে,ভাই দয়া করে আর ছবি বানাবেন না(যদিও জানি এই কথা বলা অনর্থক)। আপনার এখনও অনেক শেখার বাকি। আর শেখা শেষ হলেও যদি ছবি বানাতে চান তাহলে দয়া করে কোন ভাল গল্প নির্বাচন করবেন। আপনাদের মত পরিচালকদের জন্যই বাংলা ছবির এই দুর্দশা।
এই শিল্পকে নষ্ট করার কোন অধিকার আপনাদের নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।