টিপু সুলতান, কালীগঞ্জ (ঝিনাইদহ)
শত শত বছরের শোষকগোষ্ঠী ইংরেজদের পতন ঘটেছে বহু আগেই। তবে তাদের শোষণের নানা স্মৃতি চিহ্ন, অবশিষ্ট আজও বহন করে চলছে এদেশের বিভিন্ন এলাকা। এসব এলাকার মধ্যে ঝিনাইদহ অঞ্চল অন্যতম। সেই নীলকরদের অত্যাচারের কাহিনী আজও ভোলেনি মানুষ। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঝিনাইদহের মাটি চাষাবাদ তথা নীলচাষের জন্য তত্কালীন সর্বাধিক উপযুক্ত ছিল।
ফলে এখানে প্রত্যক্ষভাবে আগমন ঘটে ইংরেজদের। বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলে নীলকুঠি। আর আজও সেই নীল চাষের স্বাক্ষ্য বহন করছে বরা এনায়েতপুর, নগরবাথান, মধুপুর, ঝিনাইদহ, হাজরাতলা, কলোমনখালী, কালীগঞ্জ, শিকারপুর, শৈলকূপার বিজুলিয়া, হরিণাকুণ্ডুর জোড়াদহ, ধুলিয়া, ধাইনা, সোনাতনপুর, মহেশপুরের নদী তীরবর্তী এলাকা ও কোটচাঁদপুরের বিভিন্ন জায়গা। এসব এলাকায় রয়েছে নীলচাষের সাঁওতাল সল্ফপ্রদায়সহ আদিবাসী। সেসব শ্রমিকগোষ্ঠী ও কুঠির ধবংসাবশেষ।
নীল চাষে ইংরেজ নীলকর সাহেবদের মধ্যে যাদের নাম জানা যায় তাদের মধ্যে মধুপুরের নীল কুঠির কুঠিয়াল টিসিটুইডি, কোটচাঁদপুরের নীল কুঠিয়াল সিনোলব ম্যাকলিউড, ডাল্বল, ব্রিজবেন, নিউ হাউজ সাহেবদের নাম উল্লেখযোগ্য। নীল চাষের সুবিধার্থে ইংরেজরা এ অঞ্চলের রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটায়। কলকাতা থেকে ট্রেনে চুয়াডাঙ্গা ও চুয়াডাঙ্গা থেকে ঝিনাইদহ সড়ক উন্নতি ও পাকাকরণ করা হয়। নীলকর সাহেবরা বেশিরভাগ সময় এ অঞ্চলে ঘোড়ায় যাতায়াত ও চলাফেরা করত।
ব্যাপক কষ্টদায়ক ও নির্যাতনমূলক নীলচাষ করতে কৃষকরা একপর্যায়ে অনাগ্রহ প্রকাশ করে।
১৮৬০ সালের দিকে এ অঞ্চলে নীলচাষের বিরুদ্ধে নির্যাতিত কৃষকরা বিদ্রোহ করে। লঞ্চযোগে সফরের সময় হাজার হাজার কৃষক ইংরেজ ছোট লাট গ্রান্ট সাহেবকে কুমার ও কালী নদীতে ঘেরাও করে এবং নীলচাষ বন্ধের প্রতিশ্রুতি আদায় করে। সরকার ১৮৬০ সালেই নীল কমিশন গঠন করতে বাধ্য হয়। কিন্তু কয়েকবছর যেতে না যেতেই নীলকর সাহেবেরা নির্যাতনমূলক চাষ আবারও শুরু করে। ১৮৮৯ সালে শৈলকূপা উপজেলার বিজুলিয়া নীলকুঠির আশপাশের ৪৮টি গ্রামের কৃষক একত্রিত হয়ে নীলচাষ বন্ধ করে দেয় এবং নীলকুঠি আক্রমণ করে।
এ সময় বিজুলিয়া কুঠির অধ্যক্ষ ছিলেন ডাল্বল সাহেব।
নীলচাষের জন্য নীলকর সাহেবেরা এ অঞ্চলে অনেকগুলো যৌথ ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্ট্থাপন করেছিল। এসব প্রতিষ্ঠানকে বলা হতো কনসার্ন। হাজরাপুর বা পোড়াহাটি কনসার্নের অধীনস্থ ১৪ টি নীলকুঠির অধিকারে জমির পরিমাণ ছিল ১৬ হাজার বিঘা। আর হরিণাকুণ্ডুর জোড়াদহ কনসার্নের অধীনস্থ ৮টি কুঠির অধিকারভুক্ত ভূমির পরিমাণ ছিল ৯ হাজার ৪০০ বিঘা।
জোড়াদহ কুঠির ম্যানেজার ছিলে ম্যাকুলোয়ার।
ন্যায্য মহৃল্য না দেয়া ও বাধ্যতামূলক নীলচাষ করানোর প্রতিবাদে এ অঞ্চলে বিভিন্ন সময় নীল চাষ করতে স্থানীয় লোকজন অনাগ্রহ প্রকল্প ও বিদ্রোহ করতে থাকলে চতুর নীলকররা আদিবাসীসহ ভারতের বিহার প্রদেশের ছোট নাগপুর ও বিভিন্ন স্থানের সাঁওতাল সম্প্রদায়ভুক্ত অধিবাসীদের এনে শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন নীলকুঠিতে নিয়ে আসে। এরা বুনো ও বাগদী শ্রেণীভুক্ত। যেখানে নীল কুঠি ছিল সেখানেই এই বুনো ও বাগদীদের বসতি এখনো লক্ষ্য করা যায়। নগর বাথান, শৈলকূপার বিজুলিয়া, চাকলা, ছালাভরাসহ অন্যান্য কুঠি এলাকাতে এই সম্প্রদায় তখন হতে বসবাস করে আসছে।
বুনোরা দীর্ঘদিন ধরে এদেশে বসবাস করলেও এদের আচার-আচরণ, হালচাল, সামাজিক কর্মপদ্ধতি, উচ্চারণ ভঙ্গি ও জীবণযাত্রার বৈশিষ্ট্য প্রমাণ করে এরা স্থানীয় নয়। এদের মধ্যে এক শ্রেণী মাছ ধরে জীবিকা-নির্বাহ করে অপর শ্রেণী গাছ কাটা, মাটি কাটা ও শ্রমিকের কাজ করে। কঠিন ও পরিশ্রমী কাজ করতে এরা শারীরিকভাবে অসুবিধা বোধ করে না। এদের অনেকেই সাপ নিয়ে জাপান খেলা করে। মেয়ে পুরুষ উভয়েই সমান ভাবে কাজ করতে পারে।
একটি অংশ সর্দার হিসাবে পরিচিত। বাদুর, দুড়ো, কাছিম, এদের প্রিয় খাদ্য।
বাঙালি হিন্দুদের মতো আচার-আচরণ করলেও সামাজিক ও কর্মপদ্ধতির দিক থেকে হিন্দুর সঙ্গে এদের বেশ পার্থক্য রয়েছে। খাটো খোট্টা চেহারার বুনোরা সহজে রোগ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয় না এবং হলেও সহজে ডাক্তারের কাছে যায় না। ঝাড় ফাঁক, গাছের ডাল, বাকল ও শিকড় দিয়ে দেশীয় পদ্ধতি নানা অবহেলা আর বঞ্চনার শিকারে আজ বিলুপ্তির পথে।
এরা কালের স্বাক্ষী হয়ে আছে ইংরেজদের সেই নীলচাষ আর নীলকুঠির সঙ্গে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।