আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ফ্যাশনদুরস্ত মন ও পণ্যদাসত্বের শেকল



হায় হ্যান্ডসাম.. হায় হ্যান্ডসাম... পেলব-মৃসণ কমনীয় ত্বক চিরকাল শুধু নারীর অহঙ্কার হয়ে থাকবে তা কী করে হয়! ছেলেপক্ষ এসে দেখেশুনে পছন্দ করে শুধু মেয়েদেরকেই বিয়ে করে নিয়ে যাবে- তাই বা আর কতদিন মানা যায়! মেয়েরা যদি ছেলেদের মতো কর্পোরেট হাউসে উচ্চপদে চাকরি করতে পারে, ব্যসত্ম শহরে পেশাদারি দক্ষতায় গাড়ি চালাতে পারে-তাহলে ছেলেরা চর্চার মাধ্যমে তাদের ত্বককে কোমল-মৃসণ করতে পারবে না কেন? কন্যাযাত্রী এসে কেন ছেলেদের বিয়ে করে নিয়ে যেতে পারবে না। সত্যিই তো। এমন করে তো কখনও ভাবা হয়নি। ভাবনার দরকারও নেই। পুরুষ মনের এ গোপন আকুতি উপলব্ধি করার জন্য দরদি বন্ধু ইউনিলিভার তো রয়েছে।

প্রাথমিক পাঠ হিসেবে আপাতত অবশ্য খুব বেশি কিছু করার দরকার নেই। রোদের অতিবেগুনী রশ্মি থেকে শুধুমাত্র ত্বকের জেল্লাটুকু বাঁচাতে পারলেই হলো। কিন্তু কী করে ! চিনত্মা নেই। আছে ‘মেন্জ অ্যাকটিভ’। ক্রিম সদৃশ বস্তুটির ভেতরে লুকিয়ে আছে প্রবল প্রতাপশালী রোদের বিরম্নদ্ধে জেহাদ করার অস্ত্র।

ফলে সারাদিন রোদে ঘোরাঘুরি করলেও ত্বক এতটুকু মলিন হবে না। শুধু বাইরে বেরম্ননোর আগে মেনজ অ্যাকটিভের প্রলেপ দিলেই হলো। আর ফিরে এসে মুখে উপটান মেখে কিছুক্ষণ পর ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিতে হবে। আর এভাবে আপনি ক্রমেই হয়ে উঠতে পারবেন বহু নারীর কাঙিড়্গত সুন্দর পুরম্নষ। ফলে মেয়েপক্ষ আপনাকে দেখতে এসে পছন্দ করে বিয়ে করে নিয়ে যাবে।

সারাদিন রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটিয়ে রাতে শোবার আগে বেডরম্নমের বড় আয়নায় পরখ করে নিতে পারবেন ত্বকের কতটুকু ক্ষতি হলো। সুন্দর মুখশ্রী ও ঘরকন্যার কাজের মাধ্যমে আপনি হয়ে উঠবেন এক আদর্শ ‘গৃহবর’। এলো খুশির ঈদ ও মন রমজানের ওই রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ/আপনাকে তুই বিলিয়ে দে-না আসমানি তাকিদ... সাম্যবাদী কবি নজরম্নলের এই মরমি উপলব্ধির সাথে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। ঈদ আনন্দের অংশীদার প্রতিটি মুসলমানের প্রতি সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্বের বন্ধন দৃঢ় করতে স্রষ্টার যে বিধান- তা শাশ্বত। যদিও আত্মকেন্দ্রিকতায় আচ্ছন্ন আমাদের যাপিত জীবনে এর প্রতিফলন নেই বললেই চলে।

ঈদ ঘিরে সারা দেশজুড়ে সমাজের সব শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে উদ্দীপনার যে স্রোত বইছে উৎসবের আনন্দ সাগরে তা একাকার হয়ে যাবে শাওয়ালের প্রথম দিনে। তবে আনন্দের রেশ ধরে রাখার চেষ্টা চলবে আরও কয়েকদিন। আর এ আনন্দকে শানদার করতে সারা মাস ধরে কত পরিকল্পনা! কী পোশাক কেনা যায়। কত দামি ও বাহারি ডিজাইনের পোশাক কিনে ফ্যাশনদুরসিত্ম আর কৌলিন্য প্রকাশের প্রতিযোগিতায় এগিয়ে যাওয়া যায়- সে চেষ্টার কোনো বিরাম নেই। পরম উৎসবের দিনে ‘কঠিন ফ্যাশনে’ বন্ধুদের তাক লাগিয়ে দেয়ার প্রবণতার কাছে টাকা যেন নস্যি।

আর মানুষের এই প্রদর্শনপ্রিয়তার কারণে ধুপধুনো-পান সুপারির অর্ঘ দিয়ে লক্ষ্মীকে আমন্ত্রণ জানানো লাগে না। দড়্গিণ আমেরিকার ড়্গীণকটি অথচ স্ফিত wbZ‡¤^i নর্তকী-গায়িকা শাকিরার নামটি স্মরণ করিয়ে দিলেই ভরে উঠছে দোকানের ক্যাশবাক্স। সামিনা মিনা ও..ও..ওয়াক্কা ওয়াক্কা ও-ও... aš^šÍwi সবক ও প্যাকেটজাত আনন্দ চার্লস ডারউইনের বিবর্তনবাদের অসারতা বহু আগেই প্রমাণিত হয়েছে। তার জায়গায় জীবনের বস্নু প্রিন্ট জিনেটিক কোড বিশেস্নষণেই মেধা খাটাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা। বানর থেকে মানুষের উৎপত্তির তত্ত্ব এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না।

কিন্তু বানরের অনুকরণপ্রিয় ¯^fvewU কিভাবে যেন মানুষের মধ্যে সংক্রমিত হয়েছে। এটির চর্চা হচ্ছে mvo¤^‡i-†mvrmv‡n| কথা-বার্তা, আচার-আচরণ, ফ্যাশন-সংস্কৃতিসহ সার্বিক জীবনাচারেই লড়্গ্য করা যাচ্ছে এর সুগভীর প্রভাব। তাই তো তরম্নণদের মধ্যে ‘মাঙ্কি প্যান্ট’ পরে ফ্যাশনের আদর্শ হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতা চলে। ঈদ বাজারে হিন্দি সিনেমা, সিরিয়াল ও অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নামে মাসাককালি, কাশিকা, ক্যাটরিনা, মাদ্রাজি কোটা, শিবম, ভরসা, সানিয়া মির্জা, শাকিরা নামের পোশাক কেনার আগ্রহ দেখলে সহজেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শুধু কি পোশাক।

হাতের মেহেদি, কানের দুল, চুলের ক্লিপ, নাকের নথ থেকে শুরম্ন করে পায়ের জুতো পর্যনত্ম সবই চলছে ভিনদেশী নানা নামে। আর এ সুযোগে বহুজাতিক কোম্পানি থেকে gd¯^‡ji কসমেটিকস দোকানদার-সবাই হাতিয়ে নিচ্ছে অঢেল মুনাফা। অদৃশ্য রক্তড়্গরণ ঈদ শুধু উৎসবই নয়; শিশুদের জন্য এটি বায়নাক্কা পূরণের সুযোগও বটে। প্রতিটি মা-বাবা তাদের সনত্মানদের জন্য সাধ্যমতো কেনাকাটা করে থাকেন। চেষ্টা করেন সনত্মানের আবদার পূরণের।

কিন্তু এই দুর্মূল্যের বাজারে প্রাত্যহিক জীবনের চাহিদা মিটিয়ে ক’জনই বা তা পারেন। আকরাম আলীও মেয়ের আবদার রাখতে পারছিলেন না। সরকারি অফিসের তৃতীয় শ্রেণীর এ কর্মচারীকে পাঁচজনের সংসার চালাতে হয়। ঈদ উপলড়্গে তাদের সবার জন্য জামাকাপড় ও অন্যান্য পণ্য কিনতে গিয়ে তিনি হাঁপিয়ে উঠছিলেন। হাল ফ্যাশনে অনুরক্ত তার উঠতি বয়সের মেয়েটি অতি দামি এক পোশাক পছন্দ করে বসলো।

যা কেনার সামর্থ আকরাম আলীর ছিল না। শহরের ব্যসত্ম বিপণী কেন্দ্রের সামনে অসমর্থ-অড়্গম পিতার চড়-থাপ্পড়ে চোখের জলে ভাসে মেয়েটি। তা দেখে উপস্থিত লোকজনের আবেগও যেন উথলে উঠতে চায়। এ কেমন পাষন্ড পিতা। সনত্মানকে পোশাক কিনে দেয়ার পরিবর্তে জনসমড়্গে মারপিট! কিন্তু হায়! বিজ্ঞাপনের গোলক ধাঁধাঁর শিকার অসহায় পিতার হৃদয়ের রক্তড়্গরণটুকু কে দেখে।

পণ্যদাসত্বের শেকল Av‡gwiKv-gy¤^vB থেকে আমদানি করা ফ্যাশনের সবক সাদরে গ্রহণ করছে বেশিরভাগ মানুষ। ¯^KxqZv, মৌলিকত্ব ও wbR¯^Zv বিসর্জনের গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসানের তৃপ্তিতে বুঁদ হয়ে আছে গৃহিনী থেকে কেজি শ্রেণীর শিশুটিও। কার কী প্রয়োজন, আর কাকে কী মানাবে তা আর ভোক্তার ইচ্ছাধীন নেই। কোম্পানির বিজ্ঞাপন নির্ধারণ করছে চাহিদা, রম্নচি ও ব্যক্তিত্ব। ব্যক্তিমানুষের জীবনবোধ এখন কোম্পানি রঙিন মোড়কে বাজারজাত করছে।

বেনিয়া শ্রেণীর এই ফেরেববাজি সহজাত। পণ্যের বাজার সম্প্রসারণে তারা নানা কৌশলের আশ্রয় নিয়ে থাকে। কিন্তু বিপত্তি হচ্ছে সাধারণ মানুষকে নিয়ে। বহুজাতিক কোম্পানির চটকদার বিজ্ঞাপনে মোহাবিষ্ট মানুষের কাছে পণ্যের প্রয়োজনীয়তা বা গুণগত মানের চেয়ে এর নামই বড়। ফলে নিজ ধর্ম ও সংস্কৃতির বাতাবরণে যে জীবনাচার বহু শতাব্দি ধরে গড়ে উঠেছে তা ঠুনকো মনে হয়।

একটি সমৃদ্ধ জাতিসত্তার উত্তরাধিকার হয়েও ভিনদেশী পণ্যের (যদি তা আমাদের সংস্কৃতির বিপরীতও হয়) ভোক্তা হিসেবে নিজেকে জাহির করাই যেন প্রগতিশীলতা। প্রকৃত প্রসত্মাবে ধ্যানে-জ্ঞানে, মেধায়-মননে নিজেকে সমৃদ্ধ করতে না পারলে এক ধরনের শূন্যতার সৃষ্টি হয়। সচেতন মনে তা কখনও ধরা দেয় না। আর আত্মউপলব্ধির দৈন্যের কারণে হীনমন্যতা থেকে উৎসারিত সেই দীনতা কিছুতেই ঢাকা যায় না। আর তখনই প্রয়োজন হয় খোলসের।

যে কারণে অনেক গৃহবধূর দখলে ৩শ’টি শাড়ি দেখা যায়। ২০ জোড়া জুতা থাকতেও নিউমার্কেটের শো-রম্নমে একটু ঢুঁ না মারলে মন উসখুস করে। রঙিন পোশাকের আবরণে, দামি পারফিউমের খোঁয়ারিতে আচ্ছন্ন থেকে আমিত্বকে আর একটু উসকে দেয়া হয়। মুখ্যত সাজ-পোশাক আর বিলাস-ব্যাসনের ভেতর দিয়ে ক্রমেই পণ্যদাসত্বের শেকলে বাধা পড়ছে সমাজের প্রায় সবশ্রেণীর মানুষ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.