আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি বানাইয়াছে কোন মিস্তরি’

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি বানাইয়াছে কোন মিস্তরি’ ------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ আমাদের কলেজে আন্ত ভবন সাংস্কৃতিক প্রতিযোগীতা হতো প্রতি বছর। এই প্রতিযোগীতাটি আমার কাছে খুব এক্সাইটিং ছিলো একদিকে অংশগ্রাহক শিল্পী হিসাবে আরেকদিকে অর্গানাইজার হিসাবে। অংশ নিতো কলেজের তিনটি হাউস হযরত শাহ্জালাল (রঃ) হাউস, সুরমা হাউস ও তিতুমীর হাউস। আমি ছিলাম হযরত শাহ্জালাল (রঃ) হাউসের শিল্পী। আমার মনে আছে একবার একের পর এক বিপদ এসে পড়ছিলো আমাদের হাউসের শিল্পীদের উপর।

একজন হঠাৎ হসপিটালে, তবলা বাদক হাত ভেঙে ফেলেছে, গায়কের ঠান্ডা লেগে গলা ভেঙে গেছে, ইত্যাদি । রিপ্লেস করে করে নতুন শিল্পীদের নিয়ে আমরা প্রতিযোগীতায় অংশ নিলাম। তারপর সেই প্রতিযোগীতায় আমাদের হাউস প্রথম হয়। ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর আমাদের সে কি উল্লাস অনুষ্ঠানের দায়িত্বে থাকা শফিকুল আজম স্যারকে আমরা কাঁধে তুলে নিয়ে নেচেছিলাম। এরপর থেকে আমাদের মনোবল ভীষণ বেড়ে যায়।

প্রতি বছরই টার্গেট করতাম প্রথম হওয়ার জন্য। আমি আগ্রহ বেশী নিতাম আর স্যারতো আছেনই। এই কাজে আমার একটা স্ট্র্যাটেজি ছিলো, আমি প্রতিযোগীতার আগে সাবধানে অন্য হাউসের রিহার্সালগুলো দেখতাম, আর সেখান থেকে বোঝার চেষ্টা করতাম আমাদের কি করণীয়। এরকম একটা প্রতিযোগিতার আগে গেলাম তিতুমীর হাউসের রিহার্সাল দেখতে। গিয়ে দেখে আমার ইমিডিয়েট জুনিয়র ব্যাচের সাইফুল্লাহ্ বেলাল (বর্তমানে পদস্থ সামরিক কর্মকর্তা) মহা উচ্ছাসে নেচে নেচে গাইছে, ‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি বানাইয়াছে কোন মিস্তরি, মন আমার দেহ ঘড়িই ই ই ই ই.......।

’ ঠিক যেন নেচে নেচে গাইছেন আবদুর রহমান বয়াতি। বেলালের সাথে সুর মিলাচ্ছে আরও চার-পাঁচজন, 'মন আমার দেহ ঘড়িই ই ই ই ই.......। ’ স্পষ্ট বুঝতে পারলাম এই দলীয় সঙ্গীতটি জিতে যাবে। দলীয় সঙ্গীতে আমরা পারবো না। কি আর করা! অন্য আইটেমগুলোর উপর নজর দিতে হবে।

মনে মনে ইর্ষা হলো। এতো ভালো গানটা ওরা চুজ করে ফেললো, আমাদের মাথায় এলো না! আহ্হা। যাহোক এখন আর ভেবে কাজ নেই। এখন গানটা শেষ পর্যন্ত শুনি। আবার শুনলাম বেলাল গাইছে, 'একটি চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া জনম ভরি চলিতেছে।

মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে। থাকের একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিলো তার ভিতর ওরে রং বেরংয়ের বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কি সুন্দর। ' হারিয়ে গেলাম লোক সঙ্গীতের ভুবনে আবদুর রহমান বয়াতির সুরে। আবদুর রহমান বয়াতির সাথে প্রথম পরিচয় টেলিভিশনের মাধ্যমে। যতদূর মনে পড়ে উনার বিটিভির প্রথম প্রচারণাটা আমি দেখেছিলাম।

অনুষ্ঠানটির নাম আর মনে নেই। তবে সেই সময় আধুনিক গান আর পপ্ সঙ্গীতের কদর ছিলো বেশী। শহর, বিশেষ করে ঢাকা শহরের লোকজনের লোকসঙ্গীতে আগ্রহ ছিলো কম। বেশীরভাগ সময়ই দেখা যেত লোকসঙ্গীত শুরু হলেই অনেকে টিভি সেটের সামনে থেকে উঠে যেতেন। কিন্তু বয়াতির গানটি যখন শুরু হলো, উনার প্রথম টানটির পরেই আর কেউ উঠলো না।

তার পর লোকগানের সুরের এক অপূর্ব ইন্দ্রজাল তৈরি করলেন তিনি। গভীর আগ্রহ নিয়ে সবাই শুনলেন পুরো গানটি, যেমন সুর, তেমন কথা, তেমনই মধুর বয়াতির কন্ঠ। সবাই পরিচিত হলাম এই অপূর্ব প্রতিভার সাথে। তারপর বহুবার উনার গান শুনেছি। নিজেরাও গেয়েছি।

লোকগানের কথা আসলেই এই গানটির কথাই মনে পড়তো প্রথম। বন্ধু-বান্ধবরা আসর জমানোর জন্য যেসব গান গাইতাম 'দেহ ঘড়ি' গানটি তার মধ্যে থাকতো। বিদেশে যখন গেলাম, অনুষ্ঠান করার সময় ভাবলাম টিপিকাল বাংলাদেশী গান থাকা দরকার। কি কি গান দেয়া যায়। একজন বললেন, "যেই গানই দেন ভাই দেহ ঘড়িটা যেন থাকে।

" অনুষ্ঠানের আগে গেয়ে শোনানো হলো ঐদেশী কো-অর্ডিনেটরকে। ভদ্রমহিলা শুনে বললেন, বাহ্! বেশ সুন্দরতো! আমার একবার সৌভাগ্য হয়েছিলো এই প্রতিভাবান শিল্পীর টিভি সাক্ষাৎকার দেখার। তিনি যা যা বলেছিলেন, তার যতটুকু আমার স্মৃতিতে আছে আমি বলছি। আবদুর রহমান বয়াতিঃ আমি ছোটবেলায় পড়ালেখায় বেশী ভালো ছিলাম না। গানে আমার উৎসাহ ছিলো খুব।

সারাক্ষণ শুধু গান গাইতাম। মাঠে গান গাইতাম, ঘাটে গান গাইতাম, আম গাছে গান গাইতাম, জাম গাছে গান গাইতাম। আমার আববা আমাকে মারতো। কিন্তু আমার মা আমাকে আদর করতো, বলতো, "না আমার ছেলে একদিন বড় গায়ক হবে। " তারপর একজন বয়াতি আমাকে শিষ্য বানাইলেন।

এরপর থেকে আমার শিল্পীজীবন শুরু। কিন্তু তখন টাকা পয়সা বেশী পাইতাম না। একসময় খুব অর্থ কষ্টে পড়ে গেলাম। তখন আমি আর আমার ওয়াইফ পুরি বেচার সিদ্ধান্ত নিলাম। চকি নিয়া একবারে মেইন রোডে চইলা গেছিলাম।

আমার ওয়াইফ পুরি ভাজতো আর আমি বিক্রী করতাম। বহুৎ পরিশ্রম করছি। স্বাধীনতার পর আমার অবস্থা কিছু ফিরতে শুরু করে। বিভিন্ন জেলায় ডাক পরে গান গাওয়ার জন্য। তখন কিছু টাকা পয়সা হাতে আসে।

বিদেশেও অনুষ্ঠান করছি, আমেরিকা, ইংল্যান্ড, দুবাই, এক্কেবারে ফার্স্টে গেছি মস্কো, রাশিয়ায়। দেহতত্ত্ব আর ভাবতত্ত্ব দিয়ে তিনি জীবনের মানে খুঁজেছেন তার গানে আর দরাজ কণ্ঠে। তথাকথিত আধুনিকতা আর অপসংস্কৃতির চাপে দর্শনভিত্তিক গানগুলো আমাদের দেশে দিনে দিনে কমে যাচ্ছে। এই জাতীয় গানের শিল্পীরাও বিদায় নিচ্ছেন। কিন্তু জীবনে দর্শনের প্রয়োজন আছে।

সুরের ভূবনে সেই দর্শন ঝংকৃত হওয়া উচিৎ। আবদুর রহমান বয়াতি আজ আর নেই, এমন প্রতিভা খুব কম মানুষের থাকে, আমরা উনার আত্মার শান্তি কামনা করি। প্রকৃতির নিয়মে আবদুর রহমান বয়াতি বিদায় নিয়েছেন। কিন্তু তার চাহিদা কমে যায়নি। উপরওয়ালার কাছে প্রার্থনা করবো তিনি যেন আমাদের আরো আবদুর রহমান বয়াতি উপহার দেন।


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।