যে মুখ নিয়ত পালায়......। । এক দেশে ছিল এক রাজা। রাজার নাম হাদারাম। সিংহাসনে বসার আগে তিনি নাম নিলেন মহারাজাধিরাজ হাদারাম সিংহ।
রাজা হাদারাম সিংহের মন্ত্রীর নাম গদারাম।
মন্ত্রী গদারামের বিচিত্র শখ ছিল। তিনি সবসময় হাতে গদা নিয়ে ঘুরতেন। শিশুকালে নাকী তিনি এই গদা দিয়ে ই খেলাধুলা করেছেন। রাজা হাদারাম একদিন মন্ত্রীকে ডেকে বললেন, মন্ত্রী মহাশয় আমার রাজ্যে এত পাখি কেন? আপনি তাড়াতাড়ি খোজখবর নেন তো এত পাখি কোথা থেকে আসে?এই দেশে করেই বা কি?
মন্ত্রী গদারাম বিরাট চিন্তায় পড়ে গেলেন।
পাখি তিনি এমনিই দেখতে পারেন না। তার পাখি নিয়ে এলার্জি আছে। তিনি রাজ্যের সভাকবি মহাপন্ডিত মটুরামের শরণাপন্ন হলেন। মটুরাম তখন রাজকীয় খাবার নিয়ে মশগুল ছিলেন। এই মটুরামের বিশেষত্ব হচ্ছে যতটা সময় তিনি পড়ালেখায় ব্যয় করেন তার চেয়ে বেশী সময় তিনি খাবারের পিছনে ব্যয় করেন।
তার আবার মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি ঝোক বেশী।
মন্ত্রী গদারাম গিয়ে দেখলেন মটুরাম একের পর এক সন্দেশ মুখের ভিতর চালান দিচ্ছেন। আর মাঝে মাঝে তার পেটে হাত বুলাচ্ছেন। গদারাম কাছে গিয়ে বললেন, মহাপন্ডিত মটুরাম, আপনার কাছে একটা বিষয় জানতে এসেছি। আমাদের রাজ্যে যে এতসব পাখি এগুলো সারাদিন কি করে? এদের দিয়ে আমাদের কি উপকার হয়?
মটুরাম মন্ত্রী গদারামের দিকে তাকিয়ে বললেন, বলেন কি মন্ত্রীমশাই! আপনার মত লোক এই সামান্য বিষয় ও জানেন না।
ছি ছি। এই রাজ্যে জ্ঞানের সাধনা নেই। আমি সব মূর্খের মাঝে পরে আছি। এজন্যই মাঝে মাঝে ইচ্ছা হয় বিদেশ চলে যাই।
মন্ত্রী গদারাম অন্যকোন সময় হলে রাগ করতেন।
আজ করলেন না। মটুরামের কথার সাথে তাল মিলিয়ে বললেন, ঠিক বলেছেন পন্ডিত মশাই। আমরা মুর্খসূর্খ মানুষ। আপনি আমাদের মহাপন্ডিত মটুরাম আছেন তাই আমরা বেঁচে আছি।
মটুরাম আনন্দিত হয়ে বললেন বেশ বলেছেন।
পাখিদের সম্পর্কে হঠাৎ আপনার এত জানার ইচ্ছা হল কেন?
গদারাম তখন রাজা জানতে চেয়েছেন একথা জানালেন। পন্ডিত মটুরাম এতক্ষনে একটু চিন্তিত হলেন। তারপর মুখে পান্ডিত্যের ভাব এনে বললেন, আসলে এসব পাখিরা আমাদের চাল ডাল তেল নুন এসব খেয়ে আমাদের গরীব করে ফেলছে। তারঅপর এদের বিষ্টায় ভরে যাচ্ছে আমাদের রাজ্য। এসব বিষয়ে অনেক আগে থেকেই আমি চিন্তা করে রেখেছিলাম।
শুধু রাজার আদেশের অপেক্ষায় বসে আছি।
গদারাম প্রশ্নের উত্তর পেয়ে রাজাকে গিয়ে জানালেন। শুনে তো রাজা হাদারাম আগুন হয়ে উঠলেন। পুচকে পাখিদের এত বড় সাহস। সব কটাকে ভেজে খাব।
তিনি সেনাপতি নন্দলাল বীরপুরুষকে ডেকে আনলেন। সেনাপতি নন্দলালের নামের শেষের বীরপুরুষ তার উপাধি। তিনি রবীন্দ্রনাথের বীরপুরুষ কবিতা টা খুব সুন্দর করে আবৃতি করতে পারেন তাই এই উপাধি।
সেনাপতি এসে কুর্নিশ করে বললেন, বাদশাহ সম্রাট হাদারাম সিংহ বান্দা হাজির।
হাদারাম আগুন গরম হয়ে বললেন, সেনাপতি নন্দ ছড়িয়ে পড় চারদিকে, ধরে আন সব বেয়াদব বেত্তমিজ পাখিদের।
পাখিদের মাংস দিয়ে ভোজন হবে। হতচ্ছাড়ারা আমাদের ফসল খেয়েছে এতদিন,এখন ওদের খেয়ে আমরা পেট ভরব।
সেনাপতি নন্দলাল লাফিয়ে উঠে বলল , জ়ো হুকুম বাদশাহ নামদার। শুরু হয়ে যাবে আমাদের কর্ম।
পরদিন থেকে হাদারামের রাজ্যে শুরু হয়ে গেল পাখি নিধন।
সেনাপতি নন্দলাল তার সব সৈন্যসামন্ত হাতিঘোড়া নিয়ে বেরিয়ে পড়বে পাখিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে। সব প্রস্তুতি শেষ। মন্ত্রী গদারাম তার হাতের ছোট গদা টি ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে রাজা হাদারামের সামনে গিয়ে হাজির হল। রাজা তখন মহানন্দেই ছিলেন। তিনি গদারামকে দেখে হাসিমুখে বললেন, কি হে গদারাম।
তোমার মন খারাপ কেন?
মন্ত্রী গদারাম হাতের গদাটা ঘুরাতে ঘুরাতে বললেন, মহারাজ এত বড় যুদ্ধে আপনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন না দেখে মন খারাপ হল। অনেকদিন পর যখন ইতিহাস লেখা হবে তখন মানুষ এই মহান যুদ্ধের সব কৃতিত্ব নন্দলাল কে দিবে। আপনার কথা কেউ বলবে না। এজন্য মন খারাপ।
মন্ত্রীর কথা শুনে রাজার টনক নড়ল।
ঠিক তো। এই মহাযুদ্ধে তার নিজেরই সেনাপতি হওয়া উচিত। তিনি নিজেই যুদ্ধের সেনাপতি হয়ে সব সৈন্যসামন্ত নিয়ে পাখিনিধনে বের হলেন। সাথে তিনশ হাতি আর চারশো ঘোড়া। হাজার হাজার তীড়ন্দাজ আর তলোয়ার যোদ্ধা।
ঢাক ঢোল পিটিয়ে বারোহাজার সৈন্য সহ রাজা হাদারাম খুজতে লাগলেন রাজ্যের অলিতে গলিতে কত পাখি আছে। পাখি দেখা মাত্রই তীর মারা হচ্ছে। তলোয়ার দিয়ে মারার জন্য সৈন্যরা গাছে উঠে যাচ্ছে। পাখির ছোট ছোট বাসা ভেঙে ফেলা হচ্ছে।
সন্ধ্যা নাগাদ প্রায় রাজ্যের সব পাখি ই মারা হয়েছে বলে মনে হল।
কারণ কোথাও কোন পাখি নাই। রাজা হাদারাম সেনাপতি নন্দকে জিজ্ঞেস করলেন, সেনাপতি কয়হাজার মারা পড়ল?
সেনাপতি মুখ কাচুমাচু করে উত্তর দিল, বাদশাহ মাত্র পাচঁটা।
পাচঁটা! হাদারাম আশ্চর্য হয়ে যান। একী করে সম্ভব। তিনি হুংকার দিয়ে উঠলেন, আমি লাখ লাখ পাখি মারার প্ল্যান করে আসলাম আর মাত্র পাচঁটা মেরেছ তোমরা? সবকটাকে গর্দান দেব আজ।
সেনাপতি নন্দলাল বিরস মুখে বলল, হুজুর আমাদের কোন দোষ নেই। পাখিরা আমাদের আসতে দেখেই পাশের রাজ্যে চলে গেছে। আমার মনে হয় এরা ঐ রাজ্যের গুপ্তচর।
হাদারাম কথাটি শুনে রেগে আগুন হলেন আবার। চিৎকার করে বললেন।
তাহলে আক্রমণ কর ওই রাজ্য। যে করেই হোক সব পাখি হত্যা করতে হবে।
হাদারামের সৈন্যরা সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত ছিল। তারঅপর পাশের রাজ্য ছিল অনেক সমৃদ্ধ সুখী এবং শান্তিপ্রিয়। ওই রাজ্যের রাজা হাদারামের খেয়ালী স্বভাবের কারণে লোকজন কষ্ঠে আছে জানতেন।
তাই তিনি আগেই সৈন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন হাদারামের রাজ্য জয়ের।
হাদারাম পাশের রাজ্য আক্রমন করল এবং ওদের সাথে মারাত্মক ভাবে পরাজিত হল। ওই রাজ্যের রাজা ছিলেন খুব বিদ্বান লোক। তিনি বললেন, বাদশাহ হাদারাম যখন পাখিদের মারার জন্য এতবড় যুদ্ধ আয়োজন করল তাই তাকে এখন একটি বড় খাঁচায় বন্দি করে রাখা হবে। সাথে থাকবে কয়েকশ জাতের পাখি।
হাদারামের রাজ্য নতুন রাজার অধীনে যাবার পর সবাই সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগল। আর হাদারাম বন্দি হয়ে থাকল পাখিদের সাথে খাচাঁয়। মটুরাম গদারাম আর নন্দলালের তিনজনকেই শুলে চড়ানো হয়েছিল।
নোট- খালাত ভাই শফিউর রহমানের ডাকনাম দেয়া হয়েছিল মটু। তার মটু নাম স্মরনীয় করে রাখতে এই গল্প লেখছিলাম।
দিয়ালা-১০ এ প্রকাশিত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।