দুঃখ পেয়েও যেসব মেয়েরা কাঁদতে পারেনা তাদের কেন জানি আমার মেয়ে বলেই মনে হয় না. চোখভরা টলটলে জলকে, মুখ নীচু করে, যে ফোঁটাফোঁটা অভিমান ঝরে পড়ে, তা বোধহয় চেঁচিয়ে, বুক পিটিয়ে কি মুখ ঝামটিয়ে বোঝান যায় না বা বোঝাও যায় না।
বোধ হওয়ার পর থেকেই এরকম একখানি নিষ্পাপ, অভিমানি, সরল মুখ যে আমায় আষ্ঠে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে। সব চাইতে ভাল, সব চাইতে সুন্দর, সবার সেরা জিনিসটিই তার চাই.এ বাড়ীতে এটাই সবাই জানে এবং এটাই সবাই মানে। একমাত্র মেয়ে, প্রথম সন্তান, তারও ওপর আবার মেয়ে। এ বাড়ীর সুখ আর কদিনই বা।
একদিনতো চলেই যাবে পরের ঘরে। মা-বাবার এটাই একমাত্র চিন্তা। হয়ত দরিদ্র পিতা-মাতার ভূষণও এটাই। আমিতো আছিই, আমিতো থাকবই।
মা-বাবা দু ভাই-বোন নিয়ে ছোট্ট সুখী সংসার।
মাত্র দু বছরের ব্যবধান। পিঠোপিঠিই বলা চলে। ভাব ভালবাসার অভাব নেই। সেই তুলনায় ঝগড়া মারামারিটা একটু কমই। একজনের আকাশ ছোঁওয়া আব্দারে নাকাল বাবা মা, ছোট ভাইটির বেলায় তাই আবেগের রাশ টেনে ধরেছেন।
বাড়ী শুদ্ধু সকলের প্রথম ও প্রধান লক্ষ্যই ঐ একজন। সর্ব্বদা আহ্লাদে টই-টুম্বুর তাদের আদরের দুলালী। তবুও থেকে থেকেই কেন যে তার এত মন খারাপ হয়? ছেলেবেলার বায়না আদরে, আদরে, ধাপেধাপে ক্রমশঃ বেড়েই চলেছে। ও যেন কোনদিন আর বড়ই হবে ন.
( দুই )
প্রকৃতির নিয়মে ক্রমশঃ বড় হচ্ছি , জটিল হচ্ছি, কঠিন হচ্ছি। হারিয়ে যাচ্ছে, হারিয়ে যাচ্ছে আমার ছেলে বেলা।
সময় কোথায়? এত ব্যস্ত জীবন। সামনেই বাবার অবসর, দিদির বিয়ে , আমার পড়াশোনা। একটু একটু করে দায়িত্ব কাঁধে চাপছে। আমি পাল্টে যাচ্ছি, পাল্টে ফেলছি নিজেকে।
দিদি কিন্তু যেমনটি ছিল, তেমনটিই রয়ে গেল।
ও বড় স্নেহমুখী- বড় সোহাগী- বড় সুখী। ও আমার দিদি নয়। ও যেন, রঙীন পালক দিয়ে মোড়া আমার ছোট্ট একটি বোন। মনেতো পড়ে না, কখনও, কোনদিনও তেমন আঘাত করেছি বলে। মা-বাবার মুখেও অবশ্য বহুবার শুনেছি আমার এই গুন-পনার কথা।
কি করব? ও যে একটুতেই কেঁদে ফেলত। কে বলবে, আমার চাইতে বছর দুয়েকের বড়। বরং যত দিন যেতে লাগল, পুরুষের বাড়ন্ত গঠনে, ওকে কাঁধের কাছে ফেলে, যতই মাথা উঁচিয়েছি, ও ততই ছোট্টটি হয়ে গেছে। আকৃতিতে, প্রকৃতিতে, আব্দারে, খুনসুটিতে আমার ছোট বোনটিই সেজে রইল।
কত মজার মজার কথা যে, তার মাথায় তৈরী হত।
একদিন বলে কিনা, জানিস ভাই, আমার ক্লাসের সবাই ভাবে, তুই আমার দাদা। কি মজা বল। অবাক চোখে তাকিয়ে ভাবি, এত বয়সেও কত সহজেই কত মজা খুঁজে পায়। আর আমরা? জ্যাঠা বালকেরা? মজা খুঁজে খুঁজেও পাই না। ভাবনা হয়, ভাবনা হয়।
সারাজীবন এই একভাগ মজা দিয়ে ও তিন ভাগ দুঃখকে জয় করতে পারবে তো?
( তিন )
কিছু চাইলে দিদি সেটা পাবে না এ অসম্ভব। এটা ও কল্পনাই করতে পারে না। তার ঠিক উল্টোটাই আমি। কোন চাহিদাই নেই। যা পাই তাইতো যথেষ্ট।
প্রতিবার জন্ম-দিনের বহু আগে থেকেই দিদির জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যেত। বাবা কি দেবে, মা কি দেবে। আবার আমায়ও এসে বলত, -ভাই তুই আমায় কিছু দিবি না?---
মা যদি হেসে বলত, --সে কি কথা, ও কি চাকরী করে ও আবার কি দেবে?-- ওমনি মুখটা ভার করে খুব আদুরে আদুরে গলায় বলত,--দেখলি ভাই, মা কেমন করে উঠল? এ জন্যই আমার খুব দুঃখ হয়----
একটু পরেই আদুরে পুষির মত আমার কাছটিতে ঘেঁষে ফিসফিসিয়ে বলত --ভাই আমার জমান পয়সা দিয়ে আমরা দুজনে আইসক্রিম কিনে খাব কেমন। -----`ওর কাকুতি মাখান মিনতি দেখে মনে হত, আমরা বড় গরীব তাই না? অমন জগদ্ধাত্রীর মত দিদিকে আমাদের মাঝে ঠিক যেন মানায় না। এখানে ও যেন ঠিক আঁটে না।
ওর হওয়া উচিৎ ছিল,
------রাজ-নন্দিনী------
--"ঠিক আছে, ঠিক আছে, ও তুই না চাইলেও আমি দিতাম। --`এইটুকু একটা জিনিসের জন্য কেউ যে এত খুশী হতে পারে, আমি আর কারুককে দেখিনি। এমনকি পাশের বাড়ীর ঠাকুমাকেও গিয়ে বলত, --" ও ঠাকুমা, কালতো আমার জন্মদিন, তুমি আমায় কি দেবে বললে না তো?-`
ঠাকুমাও রসিকতা করে বলতেন- সত্যিইতো, কি দেওয়া যায় বলতো?-
-"তুমি? তুমি আমার জন্যে বেশ বেশী করে খয়ের দিয়ে একটা পান ছেঁচে নিয়ে যেও কেমন। সবার শেষে ওটা খেয়ে ঠোঁট রাঙাব। তখন আমায় কেমন দেখাবে বলতো ,ঠাকুমা?----`আচ্ছা, এটাকে কি কোন চাহিদা বলা যায়? আসলে এ হোল সযত্নে, অপরের হৃদয়ে, সাজিয়ে-গুছিয়ে নিজেকে তুলে রাখার এক মহৎ শিল্প।
এক বিশেষ প্রক্রিয়া। এক বিশেষ গুন। কজনাই বা পারে? আর কেই বা দেবে এই শিল্পের মূল্য? এত যে টানাপোড়েনের সংসার, দিদির যেন কোন ভ্রূক্ষেপই নেই। সর্ব্বক্ষন কেমন খুশিতে মেতে থাকে, মাতিয়ে রাখে। ভালবাসা ছাড়া যেন কিছুই চেনে না।
ভালবাসতে জানে, পেতেও জানে। সদাই উচ্ছল, প্রান চন্চল, এক আনন্দময়ী।
কিন্তু এত নরম তলতুলে মন যে , একটুতেই বড় ব্যাথাও পায়। মা-বাবাও চিন্তিত। কে তাঁদের মেয়ের অমন তরতাজা মনের খোঁজ রাখবে? কেই বা করবে এত তোয়াজ?
বাবা ডাকে পাগলী মা, ক্ষেপি মা, সোনা মা।
মা ডাকে, পুতলী, ক্ষীরের-পুতুল, নুনের-পুতুল, তূলোর-পুতুল। এক কথায় ও আমাদের সংসারের প্রান-ভ্রোমরা।
( চার )
আমি যখন কলেজে ঢুকলাম, ঠিক সেই সময়ই দিদির বিয়ে হয়ে গেল। জামাই-বাবুও ভালই। তবে দিদির তুলনায় একটু রাশভারী ।
সত্যি বলতে কি ওরকম --মন-- সর্বস্ব মানুষ আর কজনাই বা হয়? তাছাড়া ছেলেদের অত মায়াবী হলে ঠিক মানায়ও না। হলে অবশ্য ক্ষতি ছিল না। তবে পুরুষের একমাত্র সম্বল পৌরুষত্ব তাতে কিন্চিত ছোট হয়ে যায় নাকি?
নতুন এক কাজ হয়েছে, কদিন পর পরই কলেজ ফেরার পথে দেখা করে আসি। মা-বাবাও চায়, আর দিদি তো চায়ই। আমার অবশ্য লাভের ওপর লাভ।
নতুন কুটুম বলে কথা। খুব ভাল ভাল টিফিন মেলে। ভাল-মন্দ খাই আর ওর নিত্য নতুন আজুরী আজুরী সব সমস্যার সমাধান করি।
-"জানিস ভাই, কাল না, তুলতুলির সঙ্গে মোড়ের মাথায় দেখা হয়েছিল, আমি ওর দিকে চেয়ে হাসলাম, ও, কেমন করে মুখটা ফিরিয়ে নিল। কেন রে? আমি না খুব দুঃখ পেয়েছি।
-`-----আমি সড়াৎ করে চেয়ারটা ঘুরিয়ে নি টেবিলের সামনে। তারপর খুব গম্ভীরভাবে, পেপার ওয়েটটা দিয়ে ঠুকঠুক করে বলি, ঠিক আছে, ঠিক আছে নেক্সট প্রসিড, দুই নম্নর দুঃখ।
--"যাঃ, তুই ইয়ার্কি মারছিস--`
--"আরে না না , বিশ্বাস কর, বিশ্বাস কর ,ইয়ার্কি নয়, মোটেই ইয়ার্কি নয়। মা বারবার বলে দিয়েছে রোজ তোর সব কথা মন দিয়ে শুনে যেতে। --এতেই একেবারে খুশিতে গলে যায়।
সেদিন গিয়ে দেখি, থমথমে মুখ, আমায় দেখে লাললাল চোখে হাসছে।
--"জানিস ভাই, আজ ওকে বললাম, অফিস না গিয়ে আমায় একটু বই মেলায় নিয়ে যেতে, তা ও পাত্তাই দিল না। আরো বলে কিনা, বই-মেলায় গিয়ে তুমি কোন দেশ উদ্ধার করবে?----কেনরে, বাবু বুঝি আমাদের প্রত্যেকবার বই-মেলায় নিয়ে যেত না?----`এতবড় অপমান মানুষের শরীরে সহ্য হয়? আর বোধ হয় চাপতে পারে না। পেছন ফিরে গোমরাতে থাকে।
-"আমি আর এখানে থাকবই না।
আজই , এক্ষুনি তোর সাথে চলে যাব। -`
বুঝি মানিনির মানে প্রচন্ড লেগেছে। তাই শুরু হয় আমার চিকিৎসা,--------এইরে আমাদের পাগলী, এবারে ক্ষেপেছে, -"জামাই বাবু তো ঠিকই বলেছে। অফিস কামাই করে কেউ বই-মেলায় যায়? ও-তো ছুটির দিনও যাওয়া যায়, অফিস থেকে ফিরেও যাওয়া যায়। --`নিমেষেই ঝলমলিয়ে হেসে উঠে , ঘুরে দাঁড়ায়।
-"হ্যাঁরে, তখন অবশ্য খুবই রাগ হয়েছিল। কিন্তু এখন ভাবছি, না গিয়ে ভালই হয়েছে। গেলেতো তোর সাথেও দেখা হোত না, কি বল?-
আচ্ছা ও এতো ছেলেমানুষ কেন? ও তো আমার চাইতেও বড়। এমন অবুঝ মন নিয়ে ও কোথায় দাঁড়াবে? ইদানিং দিদির জন্য সত্যিই আমার বড় ভয় হয়। কারুককে বলতেও পারি না।
আর কাকেই বা বলব? মা-বাবা তো এমনিতেই সর্বক্ষন ভয়ে কাঁটা হয়ে আছে।
আমি অবশ্য পরোয়া করিনা। কেন? এত ভয়েরই বা কি আছে? ওরা আমার দিদিকে রীতিমত বাড়ী বয়ে এসে পছন্দ করে যেচে নিয়ে গেছে। ওদের অর্থ আছে, আমাদেরও সন্মান আছে।
ওদের অহঙ্কার আছে, আমাদেরও আভিজাত্য আছে।
আমার বাবা একজন স্কুল শিক্ষক, মাও একটি ছোট পত্রিকা সম্পাদনা করেন। আই অলসো উড বি এন এম। বি।
তা বললে হবে কি? চিরকালীন তোষামোদে অভ্যস্ত উচ্চবিত্ত, তাদের উচ্চাশন ঠেকাবে কে? নাঃ, নাঃ কেউ ঠেকাতে পারে না। তবুও মেটে কি লিপ্সা? আর্থিক স্বচ্ছলতাই ডেকে আনে, আত্মিক দৈন্যতাকে।
( পাঁচ )
নানান কাজে ব্যাস্ত থাকায় বেশ কিছুদিন যেতে পারিনি। মা-বাবা তো অত বড়লোকের বাড়ী যেতেই ভয় পায়। তাই ঘুরে ফিরে সেই আমাকেই যেতে হয়। যাই একবার ঢুঁ মেরে আসি। আমার অবশ্য ভালই লাগে।
জানি রেগে একেবারে টং হয়ে আছে। তা আমার ওপর তো আবার বেশীক্ষন রেগে থাকলেও চলে না। ইনিয়ে-বিনিয়ে শুরু হয় তার সেই নানারকম দুঃখ পাওয়া নালিশ।
-জানিস ভাই, তোর জামাই-বাবুটা না যেন কেমন। সব সময় কেমন একটা গুরু গুরু ভাব।
অত সুন্দর করে খাওয়ার গুছিয়ে দিলাম, গপাগপ খেয়ে গেল। ভালতো বললই না, একবার মুখ তুলেও চাইল না। একদম ভাল্ লাগে না। দিদির এধরনের কথায় আমারও হাসি পায়। কিন্তু হাসলেতো চলবে না।
তাই পরান কাকার মত নাকি সুরে চিঁ চিঁ করে বলি, তাহলে বুঝি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলতে হবে --"ও ক্ষেঁপি খুঁব ভাঁল হঁয়েছে। খুঁব ভাঁল হঁয়েছে। -`
মূহূর্তেই দুঃখ ভুলে গিয়ে গুমগুম করে পিঠে কিল মারে। এইটুকুতেই যে এত খুশি, তাকে মানিয়ে চলাটা কি খুবই কঠিন? নাকি এ মেনে নেওয়াতেও সন্মানহানি?
বুঝি, বুঝি সমস্যা শুরু হয়ে গেছে, হবেই। কেউ ঠেকাতে পারবে না।
এমন অসমান পথে চলতে ঠোক্কর তো খাবেই। তারও ওপর সে যদি হয় আনপড়।
অনুমান করতে কষ্ট হয় না, বর্ষার নরম বুকে যে সমস্যার বীজ ছড়িয়ে পড়েছে তা অতি সহজেই অঙ্কুরোদ্গমন হবে। মাটি ফুঁড়ে বীজের সেই ভরা দেহ, মানুষকে কি শুধু জ্বালানিই দেবে না ছায়াও দেবে? নাকি কোন কাঠুরের আঘাতে একদিন ভূমিতে লুটিয়ে পড়বে?
বিপরীত, সম্পূর্ন বিপরীত মেরুর দুই বাসিন্দা। একজন মানুষকে মানুষ বলেই গন্য করে না।
ভাবখানা এমন যে "একমেবাদ্বিতীয়ম্ `-------------
আশে-পাশে কেউই তার উপযুক্ত নয়। শ্রদ্ধা করার মত, সন্মান দেখাবার মত। ভালবাসার মত একটিও মানুষ আছে কি?
তারই পাশে আর একজন? যে কিনা একা একা নিঃশ্বাস নিতেও বুঝি বা ভয় পায়। তাই কি? ঘনঘোর আকাশ কালো করা সেই মেঘলা রাতে,
বাতাসের করূণ আর্তনাদে, বজ্রের হুঙ্কারে, বিদ্যুতের ঝলকানিতে,
দুটি টলটলে চোখ আকাশ থেকে বৃষ্টি হয়ে নেবে এল তৃষ্ণার্ত ধরিত্রির বুকে ! স্খলিত পাতার মত, পাখী উড়ে গেলেও, একটি পালকও কি তার পড়ে থাকে না?
হারিয়ে গেল-------------হারিয়ে গেল
না,না, হারিয়ে গেল নয়, হারিয়ে গেল নয়--------------
বোধহয় মিলিয়ে গেল। ---------
না কি সরিয়ে দিল?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।