ব্ল্যাঙ্ক
একেকটা দিন শেষ হয়ে গেলে আলস্যজড়ানো মস্তিষ্কে একটুখানি নাড়া দিয়ে যাপিত দিনের হিসেব মেলানোর চেষ্টা করি আজকাল। আলস্যের চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছুতে পৌঁছুতে চিন্তার রেখাগুলিতেও আলস্য ছড়িয়ে গেছে ভাইরাসের মত। কিছু ভাবতে গেলেই অলস মস্তিষ্ক কোষগুলি আয়েশী আর আহ্লাদী বেড়ালের মত চিন্তার রাশ টেনে ধরে বলতে শুরু করে - কি হবে অত ভেবে? সময়টা আসলেই দেখা যাবে! কিন্তু সেই সময়টা শেষ পর্যন্ত চুপিসারে সিঁধকাটা চোরের মত কোথা দিয়ে আসে আর আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে কোথায় পালিয়ে যায় ভেবে ওঠার আগেই দেখি সময়ের ধাক্কা খেয়ে জীবনের একটা ধাপ পেরিয়ে আরেকটা ধাপে দাঁড়িয়ে আছি। শুধু হিসেবগুলো মিলিয়ে নেয়া হয়না তার কাছ থেকে। কঠোর বাস্তবতার আপাত অভেদ্য শক্ত কংক্রিটের ওপর দাঁড়িয়ে আমি নিস্পৃহ চোখে দেখতে পাই - কিছু প্রতিশ্রুতিশীল সময় আমার শিথীল হাতের মুঠো থেকে অবলীলায় বেরিয়ে যাচ্ছে বালুকণার মত অথচ তাদের তাড়া করার শক্তি বা প্রয়াস দুটোতেই আমি জড়; সাংঘাতিকভাবে নিশ্চল।
স্পৃহার অভাবকেই যদি নাম দেয়া হয় নিস্পৃহতা তবে যে কেউ চাইলেই সেখানে রাজা উজিরের আসনে বসিয়ে দিতে পারে আমাকে। সকল আপাত জীবন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নিস্পৃহতা বা উদাসীনতার অনুযোগে জীবনে কতবার কাঠগড়ার মুখোমুখী হতে হয়েছে কিংবা করতে হয়েছে ইতস্ততঃ জবাবদিহির চেষ্টা তার হিসেব কষাটা এখন বাতুলতাই মনে হয়। কেননা সেই হিসেব তো জীবনভর চলতেই থাকবে যদি না অলৌকিক কোনো জাদুর কাঠির সংস্পর্শে সহসাই ভিন্ন মানুষে রুপান্তরিত হই। তবে নিস্পৃহতার অতি সামান্য কিছু সুবিধাজনক দিককে পাশ কাটিয়ে তার ক্ষতিকর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াগুলোই নগ্নভাবে চোখের সামনে এসে দাঁড়িয়েছে বারবার। আর কেমন অদ্ভুতভাবে নেচে নেচে আমায় ভেংচি কেটেছে।
যেন আমি কোনো ভীনদেশী সার্কাসের ক্লাউন অথবা নাম না জানা কোনো ভিনগ্রহী প্রাণী।
সেটা নিয়ে সত্যিকার অর্থে খেদ ছিল না কোনকালেই। তবু অবচেতনে আমি তাকে ক্ষমা করতে পারি না কেননা তার জন্যেই হয়তবা স্বপ্ন দেখাই শেখা হয়ে উঠলনা আমার এখন অবধি। শুধু সময়ের পাল্লায় জীবনের সব হিসেব নিকেশকে মুঠো মুঠো করে ছেড়ে দিয়ে দিব্যি আশ্বস্ত ভঙ্গিতে বসে আছি আগাগোড়া নির্ভাবনার বর্মে মোড়ানো রোবটমানবের মত; স্থির,শীতল,অনুভূতিজড় ও স্বপ্নহীন।
এতদিন পর এসে এখন মাঝে মাঝে ভাবতে গেলে অবাক লাগে কেন কখনোই জীবনকে নিয়ে কোনো স্বপ্ন দেখা হয়নি আমার।
আমরা সময়কে কঠিন বাক্যচ্ছটার শ্লেষে কাঠগড়ায় দাঁড় করাই,নগরের যান্ত্রিকতায় মোড়ানো বিষাক্ত কৃত্রিম বায়ুকে তীব্র অভিশাপে দংশন করে তার রিক্ত দেয়ালে আঁচড় কাটি সহস্রবার। তবু এই মৃত শহরের মানুষগুলোর মনের কোনো এক কোণে স্বপ্ন বেঁচে আছে আজও- অস্বীকার করতে পারবে না কেউ। বারো তের হাত নিয়ন বাতির নিচে নির্দয় এই যন্ত্র-শহরের কুয়াশা ভেজা রাজপথে যেই টোকাই শিশুটি ছালা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে - তার চোখেও স্বপ্ন আছে - কোনো একদিন রাজপথ ছেড়ে আপন আবাস খুঁজে নেবার। শুধু আমার চোখ কেন এমন স্বপ্নহীন জানতে গেলে ভাবনাগুলো সুতোর মত কুন্ডুলী পাকিয়ে জড়িয়ে আসে আর ঢং ঢং করে মাথার ভেতর ঘন্টা নেড়ে বলে - স্বপ্ন দেখার যোগ্যতা তোমার কই? আমি তাকে বোঝাতেই পারি না, হায়রে! স্বপ্ন দেখতেও যোগ্যতার প্রয়োজন বুঝি? শুধু ক্ষমতা থাকা চাই!
সেই ক্ষমতাটাই বা কই?
সেই ছেলেবেলা থেকে না জানি কতবার এই প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয়েছে - বড় হয়ে কি হতে চাও? প্রতিবারই কেমন বোকার মত মুখ করে দ্বিধান্বিত ভঙ্গিতে শেষমেষ ইতস্ততঃ জবাব দিতে হয়েছে, "দেখা যাক কি হই। এখনো তো সেটা ভাবিনি।
" প্রশ্নকর্তা ঈষৎ সন্দেহপ্রবণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ভদ্রতাজ্ঞান নিয়েই সংশয়াবিষ্ট হয়ে উঠেছে শেষ অবধি। আর আমি যেকোনো অজুহাতে সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছি। কি হতে চাই সেই প্রশ্নের উত্তর আজ অবধি জানা হয়নি।
কিশোর বয়সে অতি আবেগের বশে একটা স্বপ্নই দেখা হয়েছিল শুধু- খুব নিবিড়ভাবে। কিন্তু কৈশোরের গন্ধ গা থেকে মুছে যাবার আগেই চার দেয়ালের কংক্রিটে স্বপ্নটা আছাড় খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়েছিল অসহায়ভাবে আর অলীক কোনো এক অতিকল্পনার মত দূরে সরে যেতে যেতে অবশেষে উধাও হয়ে গেছে আমার চিন্তাজগতের পরিধি থেকে।
ওটার কথা মনে হলেই মাঝে মাঝে নিজেকে খুব অপরাধী লাগে। কেমন করে আমরা এই নির্ঝন্ঝাট স্বার্থপর ভেজিটেবল আর সুবিধাবাদী জীবনযাপনে অভ্যস্ত হলাম? কেন আমাদের স্বপ্নগুলিও শেষ পর্যন্ত গ্ল্যামারাস কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ততোধিক গ্ল্যামারাস কোনো বিষয়ে ডিগ্রী লাভের মাধ্যমে অভিজাত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরিজীবনে প্রবেশ অথবা আরো বেশি উচ্চশিক্ষার স্পৃহায় উচ্চ ডিগ্রী অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ?
ওরকম করে স্বপ্ন দেখায় অভ্যস্ত হয়ে উঠতে পারিনি কখনো। ভাবতে ইচ্ছে হয়নি নামের শেষে কতগুলো ডিগ্রী লাগালে পরে সমাজের মানদন্ডে সম্মানের পাল্লাটা বেশ ভারী হয়ে উঠবে আমার। অথবা কোন অভিজাত প্রতিষ্ঠানে কত টাকা বেতনের চাকুরী মিললে সকলের কাছ থেকে পিতামাতার সুযোগ্য সন্তানের স্বীকৃতি লাভ হয়ে উঠবে। বারবার কেবলই মনে হয়েছে, এটাও কি কোনো স্বপ্ন দেখার মতন বিষয়? স্বপ্ন হবে উদ্দাম, যেখানে আমি আমার মত করে মাথা তুলে দাঁড়াব- সবার থেকে অনন্য হয়ে।
হয়তবা এটাই অক্ষমতা। এই অক্ষমতাই আজ অবধি জানতে দিল না - শেষমেষ জীবনে কি হতে চাই। ঠেলাগাড়ির মত সময়ের পিঠে চড়ে চড়ে সম্পূর্ণ উদাসীনভাবে জীবনের এক-তৃতীয়াংশ সময় কাটিয়ে ফেলার পর আজ এসে ভাবছি, বাকি জীবনটাও ঠিক এভাবেই চলে যাবে হয়ত। সময় আমাকে বরাবরের মত ফাঁকি দিয়ে খুব আলতোভাবে জীবনের একটা ধাপ শেষে তুলে নিয়ে ফেলে দেবে আরেক ধাপে। আমি দৃষ্টিহীন জড়ের মত অনুসরণ করে যাব তাকে, কোনো প্রশ্ন করব না।
স্বপ্ন দেখাও কোনদিন হয়ে উঠবে না আর। সুতরাং প্রশ্নও আসবে না তাকে বাস্তবে রূপদান করার।
আমাদের ঘটনাবিহীন,নিস্তরঙ্গ,নিরাপদ শামুকজীবন এইভাবে কেটে যাবে স্বপ্নহীনতার খেদে........স্বপ্নকে ধারণ করতে না পারার অক্ষমতায় অথবা অযোগ্যতায়.............
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।