কারাভোগ শুরু হওয়ার আগেই উষ্ণ ফুলেল সংবর্ধনায় সিক্ত হলেন উদ্যমী ও তরুণ এই সাংবাদিক। এক সত্যনিষ্ঠ সাংবাদিকের জেলযাত্রা। সত্য প্রকাশের দায়ে সুপ্রিমকোর্টের দণ্ডপ্রাপ্ত আমার দেশ পত্রিকার বিশেষ প্রতিনিধি অলিউল্লাহ নোমান আজ নতুন এক ইতিহাসের অংশ। গতকাল জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু হয় তার জেলযাত্রা।
বর্ষীয়ান সাংবাদিক আতাউস সামাদ, বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহারসহ শত শত সাংবাদিক আর আইনজীবী ছিলেন তার যাত্রাপথের সঙ্গী।
সহযোদ্ধাদের শুভেচ্ছা ও প্রেরণায় উদ্দীপিত হয়ে কারাভোগের জন্য সাড়ম্বর এ যাত্রার ঘটনা এ দেশে বিরল।
সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে অকুতোভয় এক কলমসৈনিকের এই কারাবরণ। এই কারাবরণ গৌরব ও অহঙ্কারের। তাই তো এ দণ্ড ভয় দেখাতে পারেনি সাংবাদিকদের, বললেন বর্ষীয়ান সাংবাদিক আতাউস সামাদ। দণ্ড দেয়া এ রায়ে ইনসাফ হয়নি বলে মন্তব্য করেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার।
আর অলিউল্লাহ নোমানের পক্ষ থেকে তার সহকর্মীদের উদ্দেশে আহ্বান ছিল একটাই—সত্য প্রকাশে এগিয়ে আসুন, সত্য প্রকাশ করে কারাবরণ গৌরবের।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটক। অঝোরে ঝরছিল ভাদ্রের বৃষ্টি। সেই বৃষ্টি উপেক্ষা করে হাজির হয়েছেন শত শত সাংবাদিক আর আইনজীবী। দু’দিকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ফুলের পাপড়ি ছিটিয়েছেন সহকর্মী সাংবাদিকরা।
এ এক অন্যরকম দৃশ্য। এমন দৃশ্য অতীতে বাংলাদেশে আর কেউ কখনও দেখেনি।
অলিউল্লাহ নোমানের জন্য এ ছিল এক পরম পাওয়া। কারাবরণ, তারপরও মুখে হাসি, চোখে তৃপ্তির ছোঁয়া। সাংবাদিকতা জগতের দিকপাল আতাউস সামাদ, বিশিষ্ট কলামিস্ট ও বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার, বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের বিএফইউজে সভাপতি রুহুল আমিন গাজী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ বাকের হোসাইন, আমার দেশ পত্রিকার উপ-সম্পাদক সৈয়দ আবদাল আহমদ, অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার, ব্যারিস্টার নাসির উদ্দিন অসীম, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম সজল, অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা সোমা, অ্যাডভোকেট আজমল হোসেন বাচ্চু, ফটো জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মীর আহাম্মদ মীরু অলিউল্লাহ নোমানকে নিয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের প্রধান ফটকের ভেতরে প্রবেশ করেন।
ডেপুটি জেলার এমরান হোসেন সেখানে তাকে গ্রহণ করেন।
সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে অলিউল্লাহ নোমানকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক সপ্তাহের কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দেয়া হয়েছে ৬ মাসের কারাদণ্ড ও ১ লাখ টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক মাসের কারাদণ্ড। বাংলাদেশে সাংবাদিকতার ইতিহাসে এ এক নজিরবিহীন ঘটনা। আদালত অবমাননার অভিযোগে অতীতে সরাসরি আপিল বিভাগ থেকে এ ধরনের দণ্ড দেয়ার ঘটনা আর ঘটেনি।
তাই তো এ রায় নিয়ে শুরু হয়েছে ব্যাপক আলোচনা। প্রশ্ন উঠেছে কীভাবে দেয়া হলো এ গুরুদণ্ড। সাংবাদিক আতাউস সামাদ তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, অলিউল্লাহ নোমান বেশ কিছুদিন ধরে সুপ্রিমকোর্টের বিভিন্ন মামলার বিষয়ে রিপোর্ট করে আসছেন। তার রিপোর্টিংয়ের মান উন্নত। তার রিপোর্টিংয়ে কতগুলো সত্য প্রকাশ পাওয়ায় সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন, আদালত তাকে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন, আমরা এখনও আদালতের পূর্ণ রায় পায়নি।
কাজেই আমরা বুঝতে পারছি না রিপোর্টিংয়ের কোন প্রকাশভঙ্গির কারণে আদালত মনোক্ষুণ্ন হয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করতে চাই, আদালত কখনও বলবেন না যে সত্য প্রকাশ করা যাবে না। তিনি বলেন, আমার দেশ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মাহমুদুর রহমানের ৬ মাস এবং অলিউল্লাহ নোমানের এক মাসের কারাদণ্ডকে আমরা গুরুদণ্ড বলে মনে করি। আইনজীবীরা বলছেন, পেনাল কোডের একটি ধারাতেই কেবল ৬ মাসের কারাদণ্ড দেয়া যেতে পারে। আমি জানি না আইনি প্রক্রিয়ায় কী আছে।
যদি সম্ভব হয় আপিল বিভাগের উচিত এ রায় পুনর্বিবেচনা করে এ দণ্ড হয় পুরোপুরি মওকুফ করা অথবা কমিয়ে দেয়া। তিনি আরও বলেন, আপিল বিভাগের এ দণ্ড সাংবাদিকদের এবং যারা আইন সম্পর্কে সচেতন তাদের ভয় দেখাতে পারেনি। এ রায় নিয়ে এখন দেশজুড়ে আলোচনা হচ্ছে। রায়ের পর এ নিয়ে অন্তত সাত/আটটি লেখা বেরিয়েছে এবং তিনজন সাবেক বিচারপতি তাদের মতামত দিয়েছেন এ বিষয়ের ওপর। এ পরিস্থিতিতে উচ্চ আদালতের মনে রাখা উচিত, শুধু ন্যায়বিচার দিলেই হবে না, ন্যায়বিচার হয়েছে তা নিশ্চিত করে দেখাতে হবে।
আর তা যদি তারা না দেখাতে পারেন, তাহলে তারা মানুষের মন জয় করতে পারবেন না। আর মানুষের মন যদি তারা জয় করতে না পারেন, তাহলে আদালতের আর কোনো ক্ষমতা থাকে না। আদালতের নির্বাহী কোনো ক্ষমতা নেই। আদালতের ক্ষমতা হলো জনগণের সমর্থন।
আদালতের এ রায় ইনসাফ হয়নি বলে মনে করেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ফরহাদ মজহার।
জেলগেটে অলিউল্লাহ নোমানকে সাহস দিতে গিয়ে তিনি তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, আপনি যদি কোনো কথাই সমাজে না বলতে পারেন, তাহলে নীরব প্রতিবাদ করাই শ্রেয়। আজ আমরা এ জেলগেটে দাঁড়িয়ে নীরব প্রতিবাদই করছি। মাহমুদুর রহমান ও অলিউল্লাহ নোমানকে যে গুরুদণ্ড দেয়া হয়েছে, সেখানে কোনো ইনসাফ হয়নি। মানুষের অধিকার রক্ষার দায়িত্ব আদালতের। আমি মনে করি, আদালত এ রায়কে পুনঃমূল্যায়ন করবেন।
এখানে আপিল করার কোনো সুযোগ নেই। এ রায় যদি এ অবস্থায় থেকে যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হবে। একই সঙ্গে সংবাদপত্রের ভূমিকা এবং আদালতের ভারসাম্য ব্যাহত হবে। এটা কারও জন্য মঙ্গলজনক নয়। চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা দেয়ার কাজ আদালতের।
অলিউল্লাহ নোমানকে অভিনন্দন জানিয়ে রুহুল আমিন গাজী বলেন, সত্য প্রকাশ করে তিনি আজ সাংবাদিকদের সাহসের প্রতীক। পুরো সাংবাদিক সমাজ এখন তার সঙ্গে। আদালতের এ রায়ের পক্ষে একটি কথাও কেউ লেখেননি। তিনি বলেন, বাংলাদেশের সাংবাদিক সমাজ সত্য প্রকাশে কখনোই পিছপা হবে না।
কেন্দ্রীয় কারাগারের উদ্দেশে রওনা হওয়ার আগে অলিউল্লাহ নোমান তার প্রতিক্রিয়া জানিয়ে সহকর্মী সাংবাদিকদের উদ্দেশে বলেন, আমি চেষ্টা করেছি আমার রিপোর্টিংয়ের মাধ্যমে উচ্চ আদালতের ভাবমর্যাদা রক্ষায় সেখানকার অনিয়মগুলো তুলে ধরার।
আমার রিপোর্টের সপক্ষে প্রয়োজনীয় তথ্যাবলি আদালতে উপস্থাপন করেছি। আদালত বলেছেন তারা সত্য-মিথ্যা যাচাই করতে বসেননি, আদালত অবমাননা হয়েছে কিনা তা দেখার জন্য বসেছেন। আমি মনে করি, আদালতের উচিত রায়ে সত্য-মিথ্যার বিষয়টিও দেখা। আমি আদালতের রায় মেনে নিয়েছি। আমার এ কারাবরণ গৌরবের।
সহকর্মীদের প্রতি আমার আহ্বান, সত্য প্রকাশে সবাই এগিয়ে আসুন।
তথ্যসূত্র : দৈনিক আমারদেশ : ২৬.০৮.২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।