শেষ বলে কিছু নেই
আমি তিলমাত্র বিচলিত না হয়ে নিজের মাথার চুলশূন্য চাঁদিতে আঙ্গুল নির্দেশ করে বলি, আপনিও ঠকবেন, আমিও। দুপক্ষের ঠকা মানে আল্টিমেটলি দুপক্ষেরই জিত।
লীলামনি পিউ পিউ করে করে হাসতে থাকে। বলে, তারপরও আপনারা তো পুরুষ মানুষ। পুরুষ মানুষের অনেকদিন...এর পরের অংশ আর বলে না সে।
হঠাৎ ব্রেক কষে। গতিজড়তা থামাতে মুখে আঁচল চাপা দিয়ে শরীর কাঁপিয়ে হাসে। কী বলতে চায় লীলামনি? পুরুষ মানুষের অনেকদিন...তারপর কী? কী থাকে পুরুষ মানুষের অনেকদিন...হায়াৎ না যৌবন? আমি মূলজ অন্ধকারের খুব গভীরে জ্বলতে থাকা অগ্নিশিখার উত্তাপে পুলকিত হই; আহ্লাদে আটখান হয়ে যায়; লীলামনি, এই সব ছলাকলা আমি বুঝি, একদিন দেখবেন তীব্র বাদ্য-বাজনার ভেতরে অস্ফুট স্বরে লজ্জার আগুনে পুড়ে যেতে যেতে বলে ফেলেছেন ‘কবুল’; মনে মনে বলি।
রিক্সায় যেতে যেতে ভাবি, লীলামনির কিছু হয়ে গেলে আমি বনে চলে যাব। ওর ফ্লাটে গিয়ে বেল বাজাই; দরজা খুলতেই সামনে হাস্যজ্জ্বল লীলামনি; আমি হোঁচট খাই।
ও ভাবাবেগের আলোতে জ্বলে উঠে বলে, আপনি! মাই গড, এই অসময়...আমার মত অফিস ফাঁকি দিচ্ছেন নাকি? আজ আমার মন উদাসী হাওয়ায় দুলছে, মনে হচ্ছে পাখি হয়ে উড়ি। উড়বেন নাকি আমার সাথে?
কেন জানি আমি উদ্বেলিত হতে পারি না; আমার পাখি হতে ইচ্ছে করে না এক বিন্দু। বোকা ক্যাবলার মত মিন মিন করে বলি, এভাবে অফিস ফাঁকি দিলে দেখবেন একদিন আপনার খুব শাস্তি হবে। ওপক্ষে হাসির ঘোড়া লাগাম ছেঁড়ে। আরে বাদ দেন তো।
আপনি একটু বসেন, আপনাকে ক্যামন প্যাল লাগছে। আমি স¤প্রতি বাদামের সরবত বানাতে শিখেছি। জাস্ট ফ্যাবুলাস! এখনই বানিয়ে আনছি।
লীলামনি, আমার এখন একদম বাদামের সরবত খেতে ইচ্ছে করছে না। এইটুকু বলে আমি প্রায় দরজা থেকেই ফিরে আসি।
এই মুহূর্তে ওর উপর আমার এমন একটা অনুভূতি হচ্ছে- যাকে অপ্রেম ছাড়া আর কিছুই বলা যাবে না। আমার প্রেমে আজকাল এই এক নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে; প্রেম এবং অপ্রেম। আমি লীলামনিকে ভালোবাসি এবং বাসি না। ভাল বাসতে বাসতে ক্লান্ত হয়ে দেখি, লীলামনি একটা বেলজিয়ামের আয়না হয়ে গেছে; আর তার প্রতিবিম্বে আমার বিশ্রী বয়স্ক চেহারা; সাঁই সাঁই করে ক্রোধ আসে, ক্রোধ জমে; আমি হাতের কাছে যা পাই ছুড়ে মারি আয়নায়; আয়না ভেঙে খানখান হয়ে ঝরে পড়ে; অবাক কাণ্ড! আবার একটি আয়না আসে সামনে; আমি আবার ঢিল ছুড়ি; ভেঙে খানখান আয়না; জেগে ওঠে তৃতীয় স্তর; বুঝে গেছি নারী হচ্ছে বহুস্তরবিশিষ্ট আয়না, যাকে ভেঙে শেষ করা যায় না। ...তবু লীলামনি, আমি আপনাকে জয় করব- প্রেমে এবং অপ্রেমে।
আমি অফিসে ফিরে আসি।
কিন্তু কাজে মন বসে না; মাথায় আমার মৃত পতঙ্গ। দেশের বাড়িতে মোবাইল করি, মা বলেন, খোকা তুই কবে বিয়ে করবি? লাইন কেটে দিই। আশ্চর্য কোথাও কোন অঘটন ঘটে নি, অথচ আমার একটি প্রিয় পতঙ্গ অপঘাতে মারা গেল; আস্তে আস্তে আমার চিন্তার ডাইমেনশন পাল্টে যায়; ব্যাপারটা এমন দঁড়ায় যেন এই মুহূর্তে কোন অঘটন ঘটা দরকার, না হলে আমার প্রিয় পতঙ্গের সম্মান রক্ষা হয় না। বিশ্বাস করুন, আমি ভয়ংকর ধরনের পতঙ্গ প্রেমিক- একেবারে শৈশব থেকে।
শুনেছি বাচ্চারা নাকি অসাবধানে কীটপতঙ্গ ধরে খেয়ে ফেলে অথবা তাদের হত্যা করে আনন্দ পায়; কিন্তু মায়ের মুখে শুনেছি আমি শৈশবেও কখনও পতঙ্গ হত্যা করি নি; কৈশোরের অনেকটা সময় আমার কেটেছে ধানক্ষেতের আইলের উপর বসে দুটো ফড়িং এর আলাপচারিতা শুনে; আমি ওদের ভাষা পর্যন্ত বুঝি...।
অফিস ছুটি হলে আমি আনমনে পথ হাঁটতে থাকি, উদ্দেশ্যহীন। লীলামনিকে দেখতে ইচ্ছে করে, প্রেম ফিরে আসে, অপ্রেম দূরে হটে যায়; বুকের মধ্যে জটিল গণিত, অংক মেলে না। হঠাৎ পেছন থেকে একটা সিএনজি বেবিট্যাক্সি এসে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয় আমাকে। আমি স্বস্তি পাই, আমার প্রিয় পতঙ্গের সম্মান রক্ষা হয়।
বিনিময়ে আমার ডান বগলের তলে পাকাপাকি জায়গা করে নেয় এক নিষ্ঠুর নিয়তি; নিয়তির নাম ক্র্যাচ।
আগামি কিস্তিতে সমাপ্য...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।