সমাজ পচনস্তরের বিপ্রতীপ মেরুর এই বাসিন্দার পেট চলে শব্দ শ্রমিকের কাজ করে
লেখাটি অনেক আগে একটি পত্রিকার অনুরোধে লিখেছিলাম। আজ শেয়ার করলাম...
.......................................................................................................
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ভবিষ্যত নের্তৃত্ব ও পরাশক্তি সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তার এক ভাষণে ভারতের স্তুতি গেয়েছেন। তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল দ্রুত উন্নয়ন ও নের্তৃত্ব প্রশ্নে সম্ভাব্য পরাশক্তি হিসেবে কেন আপনি ভারতকে বেছে নিলেন? কারণ হিসেবে তিনি দেশটির জনশক্তির কথা উল্লেখ করেন। কেবল সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টই নন চলমান বিশ্ব নের্তৃত্বের পুরোধা থেকে হাল ফ্যাশনের হলিউডও আজ কাঁপছে ভারত জ্বরে। এর প্রধান কারণ, জাতীয় মুনাফার খোলতাইকরণে ভারতের আন্তর্জাতিক সফলতা।
ঘরোয়া তৈজস্ব থেকে ক্রিকেট, পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মানুষ আজ যে কোন ব্যবসায় দেশটির বাণিজ্য মুনাফার ভাগীদার হতে পারে খুব সহজেই। উদার গোলকায়নের মোড়কে গত দুই যুগে ভারত তার বানিজ্য নীতি বদলেছে সাপের খোলসের আদলে। শিথীল ও কঠোর সেই নীতিতে মুছে ফেলা হয়েছে অর্থের রং ও সীমানা। ‘গরিবী হটাও’ সূত্র থেকে আজ ‘গরিব হটাও’ মানসীকতার মুখোশে পরা এই ভারত আজ অন্য এক রাষ্ট্র। বিশ্ব বানিজ্য সংস্থার মতে, এই মুহুর্তে ভারত যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার জনশক্তি প্রত্যাহার করে নিলে তৎক্ষনাত বন্ধ হয়ে যাবে সেদেশের ২৫ শতাংশ কলকারখানা।
আর সেদেশ থেকে ভারতীয় বিনিয়োগ তুলে নিলে ধ্বসে পড়বে মার্কিন অর্থনীতির ভিত্তি। সুতরাং মিস্টার এক্স প্রেসিডেন্ট (ইউএস) তথাস্তু।
উদীয়মান পরাশক্তি হয়ে ওঠার যুদ্ধে ভারতের প্রবৃদ্ধি হার গুরুত্বপূর্ণ ইমেজ হিসেবে কাজ করছে বিশ্বব্যাপী। তবে কখনো বিজেপি কখনো কংগ্রেসের প্রশ্নবোধক ’মুনাফা নীতি’ দেশটিতে আগ্রাসী ‘কর্পোরেট কালচারের’ জন্ম দিয়েছে। সেখানে কেন্দ্রের সাথে প্রান্তের সম্পর্ক তিক্ত হচ্ছে দিন দিন।
উন্নত প্রবৃদ্ধি সত্বেও সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ’ইনক্রেডিবল ইন্ডিয়ায়’ বাড়ছে ধনী গরিবের বৈষম্য। অবশ্য বৈষম্যের এ বিজ রোপিত হয় সত্তরের দশকের গোড়ার দিকে। রাজ্যগুলোতে সেসময় সরকার সুষম উন্নয়ন না করায় ক্রমেই পেছনে পরতে থাকে কিছু রাজ্যের মানুষ। পরে জাতীয় প্রতিনিধিত্বে অনিশ্চয়তা দেখা দিলে কোটা ব্যবস্থার দাবী করে বসে তারা। এ ধারাবাহিকতায় চার দশক পর সশস্ত্র ধারার ’বিদ্রোহ’ ‘হামলা’ ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ও ‘চরমপন্থা’ রাষ্ট্রযন্ত্রটির বুকে জগদ্দল পাথরের মত জেঁকে বসেছে আজ।
সরকারের মতে, সা¤প্রতিক সময়ে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ শক্তি বৃদ্ধি তাদের জন্য কিছুটা মাথা ব্যাথার কারণ হলেও এ বিষয়ে তারা যথেষ্ট তৎপর। বলা বাহুল্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর স্বীকার করে নেয়া এ মাথা ব্যাথার নাম- মাওবাদ।
ভারতে বিচ্ছিন্ন হামলায় সরকারকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে চাপে রেখেছে মাওবাদীরা। এমনকি তারা প্রকাশ্যে দেশটির সরকার উৎখাতের ঘোষণা পর্যন্ত দিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং মাওবাদীদের ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
মনমোহন সিংয়ের এ কথার পরই মাও দমনে মাঠে নামানো হয়েছে পুলিশ, সেনা, বিএসএফ, কোবরা, স্করপিয়নসহ সামরিক ও আধাসামরিক বাহিনী। সমন্বিত পরিকল্পনায় কেন্দ্রিয় ও রাজ্য সরকার মাওদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করছে অপারেশন ‘গ্রীন হান্ট’। পাশাপাশি গ্রীনহান্টের পক্ষে জনমত গড়ে তোলার জন্য গঠন করা হয়েছে জনজাগরণ আহ্বান নামের সংগঠন। যা সাধারণ মানুষের সমর্থন আদায় করবে। অবশ্য সরকারের এ যুদ্ধে মাওদের মদদ দেয়ার পাল্লাটাও বেশ ভারী।
সেদেশের কমিউনিষ্ট শক্তিগুলোর দাবী, সরকার ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ডে উন্নয়নের নামে বহুজাতিক কোম্পানির স্বার্থ রক্ষা করছে।
আর্ন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, অর্থনৈতিক বিশ্বায়নের সাথে সাথে বিশ্বে সন্ত্রাসেরও বিশ্বায়ন ঘটছে। অতি সত্যি কথা। তাই তো, মুনাফার জন্য ভৌগলিক সীমারেখা মিটেয়ে তবেই না বিশ্বায়নের সূত্র আবিস্কার হলো। আর সে সুযোগ এবার সন্ত্রাসীরা নিয়ে নিচ্ছে।
প্রযুক্তির কল্যানে আজ বিশ্বব্যপী তাদের মধ্যে বাড়ছে যোগাযোগ ও লেনদেন।
তাই মাওবাদ প্রশ্নে ভারতের রাজ্যগুলোর পাশাপাশি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমিকা অবশ্যই একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে হিসেবে বাংলাদেশের দক্ষিণ, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের চরমপন্থীদের সাথে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠির সম্পর্ক বাংলাদেশ সরকারের জন্য অবশ্যই দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারে। বিশেষ করে যখন দুদেশের সীমান্ত ব্যবস্থা নিয়ে বরাবরই অভিযোগ রয়েছে দুপক্ষের। তাই মাওবাদ প্রশ্নে বাংলাদেশের ললাটে চিন্তার রেখাটা দীর্ঘস্থায়ী করার সময় এসেছে।
কিন্তু মাওবাদীরা কারা? কী তাদের লক্ষ্য? কেমনইবা তাদের সমরশক্তি? পশ্নগুলোর উত্তর মিলবে ইতিহাসের পাতায় আর বর্তমান মাও কর্মকান্ডে। ইতেহাস স্বাক্ষ্য দেয়- পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার নকশালবাড়িতে ১৯৬৭ সালে এক সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটে। বিদ্রোহে নের্তৃত্ব দেয় কানু স্যান্নাল ও চারু মজুমদার। এ বিদ্রোহকে ভারতের কমিউনিষ্ট আন্দোলনকারীরা বিপ্লব রূপে গ্রহণ করে যা পরবর্তীতে নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত। নকশাল ও মাওবাদীরা এখন একই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ।
নকশাল বিদ্রোহের আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে ভারবর্ষে। এসময় চারু মজুমদার গড়ে তোলে ইন্ডিয়ান কমিউনিষ্ট পার্টি (মার্কস-লেনিন)। ১৯৭২ সালে পুলিশ হেফাজতে চারু মজুমদারের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ভারতের মাও বিদ্রোহ এক পর্ব শেষ করে নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। হাল ধরার অভাবে ভেঙ্গে যায় ইন্ডিয়ান কমিউনিষ্ট পার্টি। তৈরি হয় একাধিক গ্র“প।
নব্বই দশকের পরপর ভারতের কমিউনিষ্ট পার্টিগুলো নিজেদের মধ্যকার বিভেদ মিটিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে। এ ধারায় প্রধানত কাজ করে, পিপলস গ্র“প ও মাওয়িষ্ট কমিউনিষ্ট সেন্টার (এমসিসি)। ২০০৪ সালে ্ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে কমিউনিষ্ট পার্টি অফ ইন্ডিয়া (সিপিআই) নাম ধারণ করে তারা। নকশাল আন্দোলন থেকে উদ্বুদ্ধ সিপিআই তখন থেকেই সমন্বিত শক্তি কাজে লাগাতে থাকে। তাই মাওবাদী কমিউনিষ্ট পার্টির এ আন্দোলন নকশাল আন্দোলন নামে পরিচিত হতে থাকে।
আন্দোলন/হামলা ছড়িয়ে পড়ে ভারতের নতুন নতুন জায়গায়, দখলে আসতে থাকে একের পর এক রাজ্য। সর্বশেষ ২০০৮ সালে পুলিশের অস্ত্র গুদাম লুট করে ২০০ রাইফেল ও লক্ষাধিক রাউন্ড গুলি ছিনিয়ে নিয়ে আরেক দফা শক্তির জানান দেয় মাওবাদীরা।
অপরদিকে এসময় সরকার শান্তিপূর্ণ আলোচনায় না গিয়ে মাও দমনোর জন্য একের পর এক বিশেষ বাহিনীর জন্ম দিয়ে বির্তর্কের সৃষ্টি করে। সর্বশেষ ২০০৯ সালের ৫ আগষ্ট ভারতের পর্লামেন্টে মাওবাদী কমিউনিষ্টদের নিষিদ্ধ করে বিল আনা হয়। বর্তমানে ভারতের ২৮ টির মধ্যে ২০ টি রাজ্যের ৫০০ জেলায় মাওবাদীরা ছড়িয়ে পড়েছে।
আজ বিহার, ঝাড়খন্ড, ছত্তিশগড়, পশ্চিমবঙ্গ, কর্ণাটক ও উড়িষ্যায় প্রতিনিয়ত মাও হামলায় প্রাণ হারাচ্ছে বেসামরিক লোক। অবস্থাদৃষ্টে সমস্যা নিরসনের তুলনায় তা জিইয়ে রাখার মানসীকতা দেখা যাচ্ছে দুপক্ষের মধ্যে। কেননা কোন পক্ষই শান্তি আলোচনায় খুব বেশী আগ্রহী নয় এখনো। অথচ সমস্যা সমাধানে এক টেবিলে বসার বিকল্প নেই। বিতর্ক উতরে আলোচনার টেবিল পর্যন্ত য্ওায়াই বৃহৎ এ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
ভারতের মানবাধিকার কর্মী ও লেখক অরূন্ধতী রায় মাওবাদীদের জীবন খুব কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি তার লেখায় জঙ্গলমহলে বাস করা মাওদের জীবনচরিত তুলে ধরে লিখেছেন- গ্রামগুলো মানুষশুন্য আর জঙ্গলগুলোয় মানুষ ভর্তি। গ্রামের স্কুলগুলো একএকটি সেনা ছাউনি। সে এলাকার অধিবাসীদের অধিকাংশই উপজাতি। অনগ্রসর ও অশিক্ষিত এ মানুষগুলোর সাথে আজ মাওবাদীরা মিলেমিশে একাকার।
তারা খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। সেখানে কমরেডদের সম্বোধন করা হয় ‘দাদা’ নামে। পাহাড়ে জঙ্গলে কাটানো কমরেডদের বড় একটি অংশ এখনো ২০ পেরোয়নি। তারপরও তাদের হাতে উঠে গেছে আগ্নেয়াস্ত্র। এ সমস্যা পুলিশ বা সেনা মোতায়েন করে সমাধান সম্ভব নয়।
পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে। ভারতে মাওবাদ বিকাশের মূল কারণ নীতিনির্ধারকদের লালসা ও বৈষম্য নীতি। ফলে স্থানীয় মানুষের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ কাজে লাগিয়ে মাওরা গরিব ও শোষিত শ্রেণীর সমর্থন আদায় করে নিচ্ছে। তবে জঙ্গলের সীমানাও আজ মাওদের জন্য নিরাপদ নয়। তাই প্রতিনিয়ত চলে তাদের স্থান বদলের ব্যস্ততা।
মাওবাদীরা শক্তি জোরদারের সাথে সাথে বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থার বিরুদ্ধে জঙ্গলের মধ্যেই গঠন করেছে জনতা সরকারের। এ সরকারই মাও সমাজের নিয়ন্ত্রক।
ভারতে মাওবাদীদের শক্ত অবস্থানের কারণ হিসেবে পর্যবেক্ষকরা স্থানীয় জনসমর্থন ও সরকারের নীতিবিরুদ্ধ অবস্থানকে দায়ী করছেন। বলা হচ্ছে স্থানীয় সমর্থনের পাশাপাশি মাওবাদীরা আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু কেন অন্যসব ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’দের তুলনায় মাওরা সরকারের হিট লিষ্টের টপ পজিশনে?
অরুন্ধতী রায় সে গল্প তুলে আনতে চষে বেড়িয়েছেন মাওবাদীদের ঘাঁটি বলে পরিচিত রাজ্যগুলোতে।
বুকার পুরস্কার প্রাপ্ত এই লেখিকার মতে, এ অঞ্চলে লোহা ও আকরিকের খনি আবিস্কৃত হওয়ার পর থেকেই স্থানীয় মানুষের ভূমি অধিগ্রহণ শুরু হয়। এর পরপরই বেড়ে যায় মাওবাদীদের আক্রমন। মাওবাদীদের দাবী সরকার তাদের উৎখাত করে বহুজাতিক কোম্পানির মুনাফা লোটার ব্যবস্থা পোক্ত করতে চাইছে। যার সাথে এ অঞ্চলের দরিদ্র সাধারণ মানুষের কোন সম্পর্ক নেই। আর সরকারের জবাব মাওরা যা বলছে তা সম্পূর্ণ যুক্তি ও সমর্থণহীন।
সরকারের ভাষ্যমতে, মাও অধ্যুষিত এলাকায় তারা উন্নয়ন কাজ করতে আগ্রহী কিন্তু তা ব্যহত হচ্ছে মাওদের কারণে। কেননা তারা আজ রেললাইন উড়িয়ে দিচ্ছে তো কাল সেতু বা রাস্তা। তাই সরকার মাওদের সশস্ত্র আন্দোলনের জবাব দিতে শুরু করে অপারেশন গ্রীণহান্টের মাধ্যমে। স¤প্রতি শুরু হওয়া এ অপারেশনের ফলে পরিস্থিতি বর্তমানে জটিল আকার ধারণ করেছে। ওদিকে মানবাধিকার সংগঠনগুলোর মতে, উৎখাত করা ৫০ টি জেলার মোট অধিবাসীদের ৪১ শতাংশ মানুষ মাওবাদ সমর্থন করে।
নকশাল ব্যানারে দীর্ঘ সময় ধরে চলছে মাওদের এ আন্দোলন।
পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার গ্রামগুলোর কাছাকাছি তৈরি করেছে কাউন্টার টেররিজম এন্ড জঙ্গল ওয়েলফেয়ার কলেজ। এখানে পুলিশকে কমান্ডো প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। বিতর্ক আছে এ অঞ্চলগুলোতে চলা সালওয়া জুদুম বা শুদ্ধি অভিযান নিয়ে। ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত এ মিলিশিয়া সংগঠনের মূল কাজ- মাওবাদীদের নির্মুল করা।
অতীতে এ সংগঠনটি নিয়ে একাধিকবার আঙ্গুল উঠেছে কংগ্রেস সাংসদ মহেন্দ্র কর্মার দিকে। ‘লাশের বদলে লাশ’ অপারেশনে সরকার বর্তমানে পাশে পাচ্ছে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসেবিলিটির নামে এ কাজে টাকা ঢালছে টাটা ও এসারের মত বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।
ভারতের উন্নয়ন ও সম্পদ আহরণ নীতির প্রতিফলন ঘটেছে দেশটির অর্থনৈতিক দর্পনে। শিল্প উন্নয়নে সেখানে টাটা, মিত্তাল, আম্বানীর অবদান কোন সরকারই অস্বীকার করতে পারেনি।
ভারতের বর্তমান জিডিপি ৩৯.১ শতাংশ। অর্ধশতাব্দী পূর্বে যা এক ডিজিটে ছিল। জিডিপি বাড়লেও দেশটিতে দারিদ্যসীমার নিচে বসবাসকারী সংখ্যার পরিবর্তন হয়নি খুব একটা। এখনো ভারতের ৫০শতাংশ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে বসবাস করছে। অর্থ প্রবাহে গতি আসলেও মোট অর্থের অধিকাংশ রয়ে গেছে মুষ্টিমেয় ব্যাক্তির হাতে।
তাই বনেদী ভারতে বর্তমান মাথাপিছু আয় ৫৮,৪৯৪ রূপি।
অর্থনীতির সাথে তাল মিলিয়ে অবকাঠামোগত উন্নয়নেও পিছিয়ে আছে দেশটি। ১২০ কোটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতেই হিমশিম খেতে হচ্ছে সেদেশের সরকারকে। সেখানে বিদ্যুৎ সুবিধা পৌঁছেনি অর্ধেকেরও বেশি গ্রামে। নেই শিক্ষা, পানি, চিকিৎসার নিশ্চয়তা।
মোট জনশক্তির অর্ধেকেরও বেশি মানুষের দৈনিক আয় গড়ে ৯০ রূপি।
এ অবস্থায় মাওরাই প্রথম গণতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলে। নিস্পেশিত মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকায় গ্রামগুলোতে মাওদের অবস্থান ধীরে ধীরে পোক্ত হয়। অপরদিকে গত দুই দশকে ধনি শ্রেণী ভারতে ফুলেফেঁপে উঠেছে অধিক হারে। জন্ম হয়েছে নব্য বনিক শ্রেণীর।
সবচেয়ে বড় গণতান্ত্রিক দেশটিতে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সাম্যাজ্যবাদী শক্তি। শ্রেণীশত্র“ খতমের জন্য মাওদের ভাষায় প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান। এলক্ষ্যে জন্ম নেয় পিপলস লিবারেশন গেরিলা আর্মি (পিএলজিএ) ও ক্রান্তিকারী আদিবাসী মহিলা সংগঠন (কামস) এর মত সংগঠন।
অরূন্ধতী রায় বলছেন, ভারতীয় সমাজে শ্রেণীভেদের কারণেই মাওবাদীরা দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। তাই সরকারের শোষণ আর নির্যাতনের চিত্রই এখন মাওবাদীদের সমর্থন আদায়ের প্রধান অস্ত্র।
সরকার অবশ্য বলছে মাও অধ্যুষিত এলাকায় তারা নিয়ন্ত্রণ না নিতে পারলেও সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন কর্মকান্ড পরিচালনা করতে চায় সরকার, তবে তাতে বাধ সাধছে মাওবাদীরা।
স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগতে পারে- সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নে বাধা দিয়ে মাওরা কি নিজেদেরই সর্বনাশই করছে না? তারা কি? স্বেচ্ছায় উন্নয়নের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে চায়? প্রশ্নগুলোর উত্তর উঠে এসেছে সম্প্রতি।
ঝাড়খন্ডের মাওবাদীরা বলছে সরকার এ অঞ্চলের উন্নয়ন করতে চায় বুর্জোয়া শ্রেণীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। যে রাস্তা বা ব্রিজের কথা সরকার বলছে তা এ অঞ্চলের অধিবাসীদের চলাচলের জন্য নয় ঐ রাস্তা তৈরি করা হচ্ছে হচ্ছে ভারী যান চলাচলের উপযোগী করে। সাদা চোখে প্রকল্পগুলোকে সরকারের স্থানীয় উন্নয়ন বলে মনে হলেও আদতে তা এ অঞ্চলের খনিজ সম্পদ লুটের পায়তারা।
মাওদের দাবী তারা স্থানীয় উন্নয়নের বিপক্ষে নয়। তাই তারা উন্নয়ন কর্মী, শিক্ষক বা দেশপ্রেমিক কাউকে হত্যা করছে না। সরকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর কারণে বনভূমি উজার করছে। যার বিপক্ষে তাদের অবস্থান।
মাওদের এমন বক্তব্যের পর নড়েচড়ে বসে বিশ্ববিবেক।
সমর্থণ আদায়ে এ যুক্তি টনিকের মত কাজ করল বিশ্বজুড়ে। জুটে গেল সমবেদক। প্রথমবারের মত মাওদের সমর্থন দিতে পাশে এসে দাড়াল গণমাধ্যম। সাংবাদিকরা সরকারী দপ্তর থেকে ফাঁস করতে থাকল একের পর এক খবর। শোনা গেল খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ছত্তিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খন্ড, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য নিয়ে সরকার বহুজাতিক কোম্পানির সাথে দরকষাকষি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করছে।
ওদিকে উড়িষ্যায় আকরিকের খনি থেকে উত্তোলন শুরু হয়েছে। ভূ-গর্ভস্থ সম্পদ আহরণে সেখানে উজাড় করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ একর বনভূমি। দূষিত করা হয়েছে সেখানকার পানি ও বাতাস। ব্যস ভারত সরকারের নতুন শত্র“ জুটল- পরিবেশবাদী দলগুলো সোচ্চার হলো গাছ কাটার বিরুদ্ধে। সুতরাং তাদের সমর্থনও গেল মাওবাদীদের পক্ষে।
এই যখন অবস্থা তখন কঙ্কায় বক্সাইটের খনির উপর নজর পড়লো বহুজাতিক এক কোম্পানির। তারা চাইলো জঙ্গলে অধিবাসীরা থাকলে খনিজ সম্পদ আহরণ সম্ভব নয়। কাজেই বাকি পানি ঘোলা করতে তারাও কিছুটা অবদান রাখলো। শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভারত সরকারের এ যুদ্ধের পেছনে আবিস্কৃত হয়েছে বহুজাতিক যুক্তি, আগ্রহ ও মুনাফা।
স¤প্রতি দিলি−তে এক সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয় ভারতের সাংবাদিক ও সুশিল সমাজের পক্ষ থেকে।
উদ্দেশ্য- বনভূমিতে কৌশলগত বসতি স্থাপন ও মাওবাদী আন্দোলন। সেখানে সাংবাদিকরা সেনাবাহিনী দিয়ে সরকারের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের বিপক্ষে মত দিয়ে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে যেতে সরকারকে পরামর্শ দিয়েছেন। সরকারের মাও দমন-নির্মূল নীতির সমালোচনা করে তারা বলেন, এর ফলে মাওবাদীরা আরও শক্তিশালী এবং সংগঠিত হচ্ছে। মানবিক কারণে এ সংকট সমাধানের পথ দ্রুত খুঁজে বের করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান সুশিল সমাজের কর্তারা। তাদের তথ্য মতে, মাওবাদীদের মধ্যে এখন নারী সদস্য সংখ্যা ৯০ হাজারেরও বেশি।
এ বিপুল সংখ্যক নারীকে উন্নয়নের মূল ধারায় ফিরিয়ে নিতে সেখানে হামলা বন্ধের দাবী জানান তারা।
ভারতের স্বরাষ্ট্রসচিব জি কে পিল্লাইয়ের দাবী ১৯৭১ সালে নকশাল আন্দোলনের পর মাওবাদীদের হামলায় গত বছর সবচেয়ে বেশি ৯০৮ জন নিহত হয়েছে। এখন পর্যন্ত ভারতজুড়ে মাওবিরোধী অভিযান চালানো হলেও তাদের তেমন একটা ক্ষতি করা যায়নি। মাওবাদীদের কাছে হারানো এলাকাগুলোর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে সরকারের সাত থেকে আট বছর সময় লাগতে পারে। এখন পর্যন্ত যত মাওবাদী মারা গেছে বা গ্রেপ্তার হয়েছে, তা মাওবাদীদের আসল শক্তির ৫ শতাংশও নয়।
মাওবাদীদের আসল বাহিনী এখনো মাঠে নামেনি। তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদী যুদ্ধের জন্য।
মাওদের অভিযান অনেকটাই আর্মড ফোর্সেস বাহিনীর মত। যেমন: হামলার জায়গা সম্পর্কে রেকি, নোট তৈরি করা, আক্রমনের আগে সে বিষয়ে গবেষণা করা, হামলার পর সুরতহাল রিপোর্ট ও বিশে−ষণ ইত্যাদি। এর ফলে লক্ষ্যবস্তুর উপর অতর্কিতে হামলা চালিয়ে দ্রুত সটকে পড়ায় মাওরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত।
যার প্রেক্ষিতে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে সম্মুখযুদ্ধ ও ধরা পড়ার ইতিহাস বিরল। স্থানীয় মানুষের মধ্যে থেকে এরা হামলা চালায় বলে এক্ষেত্রে ইচ্ছা থাকা স্বত্ত্বেও পুলিশ সবসময় তাদের চ্যালেঞ্জও করে না। তাই দিন দিন বাড়ছে খুনের ঘটনা। এক্ষেত্রে মাওরা ভুলবশত সাধারণ মানুষের উপর হামলার কথা স্বীকার করেছে।
মাওবাদীরা ২০৫০ সালের মধ্যে ভারতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উৎখাত করে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা করছে।
মাওদের এ পরিকল্পনায় সাবেক সেনা কর্মকর্তারাও সহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ আছে। বর্তমানে মওরা গড়ে তুলেছে সেনাবাহিনীর ধাঁচে আলাদা বাহিনী। এ যুদ্ধ বন্ধ করতে সরকারকে স্থানীয় অধিবাসীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অধিকার ফিরিয়ে দিতে হবে বলে দাবী করেছে মাওরা। এজন্য তারা সরকারের সাথে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত বলে জানিয়েছে। আর সরকার বলছে, মাওবাদীদের শান্তি আলোচনার প্রস্তাব একটি কৌশল মাত্র।
আলোচনার নামে সময়ক্ষেপনের আড়ালে মাওরা সংগঠনের শক্তি বাড়িয়ে নিতে চাইছে। ঠিক যেমনটা একসময় করেছিল উলফা। তারা যদি সরকারের সঙ্গে আলোচনা করতে চায়, প্রথমেই তাদের সহিংসতা বন্ধ ও অস্ত্রসমর্পন করতে হবে। বিশ্লেষকদের মতে, এক টেবিলে বসে শান্তি আলোচনাই কেবলমাত্র এ সংকট উত্তরণের একমাত্র পথ। এক্ষেত্রে সরকারকে একটু বেশি ছাড় দেয়ার মানসীকতা থাকতে হবে।
উন্নয়ন কর্মকান্ড নিয়ে ভারতের মানবাধিকার ও উন্নয়ন কর্মীদের বক্তব্য দিয়ে লেখার ইতি টানতে চাই। তাদের মতে, ভারতের রিপ্রেজেন্টেটর এখন ‘বলিউড’! যেখানে বলিউডের ক্যামেরা তাক করা হয় না সে অঞ্চল থাকে সবার অলক্ষ্যে। আর ক্যামেরা পৌছার সাথে সাথে রাজস্থানের মরুভূমিও হয়ে ওঠে অনিন্দ্য সুন্দর। বিনিয়োগ বাড়ে জয়পুরের তপ্ত বালিতে। চলে কর্পোরেট আগ্রাসন।
বদলে যায় জীবন সুর। তখন ঘরে রুটি না থকলেও দুঃখ নেই, কিন্তু টেলিভিশেন না থাকার আক্ষেপ মেনে নেয়া যায় না। তাই জঙ্গল থেকে জয়পুর, তেল হোক বা লোহা বিদ্রোহ আজ শুধু অধিকার বা সংস্কারের ঔরশে জন্মে না। গোলকায়নের এ যুগে যুদ্ধ-বিগ্রহের পেছনে রয়েছে মাল্টিন্যাশনাল প্রফিট কালচার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।