জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান, সাবেক ফল রাষ্ট্রপতি পল্লীবন্ধু হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ ও জাতীয় পার্টি
বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষ এবং আজকের প্রেক্ষাপট---- হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ
‘তেলের শিশি ভাঙ্গলো বলে খুকুর পরে রাগ করো, তোমরা যেসব ধেঁড়ে-বুড়ো বাংলা ভেঙ্গে ভাগ করো’- আজ থেকে একশ’ বছর আগে এই ছড়াটি লেখা হয়েছিলো। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ছড়া। বাংলার মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন এবং স্বাধিকার অর্জনের দ্বার উন্মুক্ত হয়েছিলো যে বঙ্গভঙ্গের মাধ্যমে, সেই মূর্ত প্রতীক বেশিদিন ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। ছড়া লেখকরাই জয়যুক্ত হয়েছেন। ভাঙ্গা বঙ্গ জোড়া লেগেছে।
তবে জোড়া লাগার দাগটি মুছে যায়নি। বঙ্গভঙ্গ বাংলার মুসলমানদের জীবনে এমন এক গুরুত্ববহ ঘটনা যা তাদের চরম বিপর্যয় মোকাবেলা করে স্বাবলম্বনের শিক্ষা দিয়েছে। বঙ্গভঙ্গের ঘটনাপ্রবাহ তাদের শিখিয়ে দিয়েছে- জাতীয় জীবনে টিকে থাকতে হলে শক্তি সাহস ঐক্য সংহতি অর্জন করে আত্ম-নির্ভরশীল হতে হবে।
১৯০৫ থেকে ২০০৫। মাঝখানে শতবর্ষের ব্যবধান।
প্রায় পুরো একটি শতাব্দীর দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে নতুন আর একটি শতাব্দীর সূচনালগ্ন এখন। অনেক উত্থান-পতন-বিবর্তন ঘটে গেছে এর মধ্যে। মহাপ্রলয়ের বিশ্বযুদ্ধ দেখতে হয়েছে, বৃটিশ আর পশ্চিমা পাঞ্জাবিদের বিতাড়িত করে দু’বার স্বাধীনতার স্বাদ গ্রহণ করতে হয়েছে আমাদের। এখন প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করছি আমরা। ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ বৃটিশ শাসনাধীনের মধ্যেও বঙ্গের মুসলমানেরা আশার আলো দেখেছিলো।
১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে সিরাজের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার সূর্যই কেবল অস্তমিত হয়নি, এই ভূখণ্ডে সাড়ে ৫শ’ বছরের মুসলিম শাসনেরও অবসান ঘটেছে। ১২০০ খৃস্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজী বঙ্গদেশ জয় করে এখানে মুসলিম শাসনের গোড়াপত্তন করেছিলেন। সেই শাসনক্ষমতা হাতছাড়া হয়ে যায় ১৭৫৭ সালে। শুরু হয় পরাধীন জীবন। বৃটিশ শাসনাধীনে মুসলমানরাই নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়েছে বেশি।
বৃটিশরা এই উপমহাদেশের শাসনদণ্ড মুসলমানদের হাত থেকেই কেড়ে নিয়েছে। এই উপমহাদেশের হিন্দুরা বৃটিশদের অধীনে থেকেও তারা অধিকার সচেতন হয়ে নিজেদের ভিত মজবুত করতে থাকে। তারা মুসলিম শাসনাধীন থেকে বৃটিশদের শাসনাধীনে চলে গেছে। ফলে মুসলমানদের মতো যন্ত্রণা তাদের মধ্যে ছিলো না। মুসলমানরা ক্ষমতা হারানোর যন্ত্রণা এবং নিজেদের গোঁড়ামির কারণে হিন্দুদের চাইতে আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়তে থাকে।
যন্ত্রণায় দগ্ধ হতে হতে যখন কিছুটা সচেতন হয়ে উঠেছিলো তখন মুসলমানদের সামনে বঙ্গভঙ্গের মতো যুগান-কারী ঘটনাটি সমাগত হয়। সেই সময়কার মুসলিম নেতৃবৃন্দ এই প্রস্তাবকে সানন্দচিত্তে গ্রহণ করেন। আমি মনে করি বঙ্গদেশের মুসলমানদের সেটাই ছিলো প্রথম সবচেয়ে দূরদর্শী রাজনৈতিক পদক্ষেপ। স্যার সলিমুল্লাহ ছিলেন বঙ্গভঙ্গের জোরালো সমর্থক। তিনি যথার্থই অনুধাবন করেছিলেন যে, হিন্দু প্রভাবিত কোলকাতার ওপর নির্ভরশীল থাকলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা কখনোই অগ্রসর হতে পারবে না।
আজ শতবর্ষ পরে সেই ঐতিহাসিক বঙ্গভঙ্গ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে ওই সময়কার প্রেক্ষাপট নিয়ে কিছু কথা বলতেই হয়। সেই সময়ের বঙ্গভঙ্গ ছিলো বাংলার মুসলমানদের স্বার্থের অনুকূলে। তাই বলে বৃটিশরা যে মুসলমানদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত- নিয়েছিলো- তা নয়। তাদের উদ্দেশ্য ছিলো বৃটিশবিরোধী আন্দোলনকে দুর্বল করে দেয়া। তখন ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা ও রাজনৈতিক চেতনার বিকাশ এবং ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে যে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করেছিলো, তা রোধ করার জন্য বৃটিশরা বঙ্গভঙ্গের পরিকল্পনা করে।
মূল উদ্দেশ্য ছিলো কোলকাতা-কেন্দ্রিক আন্দেলন দুর্বল করা। অবিভক্ত বঙ্গে বৃটিশবিরোধী কার্যকলাপ দানা বেঁধে উঠতে থাকলে শাসকরা হিন্দু-মুসলিম বিভেদ সৃষ্টির একটা পথ খুঁজছিলো আগে থেকেই। সেই উদ্দেশ্যকে সফল করতেই তারা বাংলাকে দুই ভাগে ভাগ করে। বৃটিশদের উদ্দেশ্য অসৎ হলেও বিষয়টি চলে যায় মুসলমানদের অনুকূলে। শাসকরা যুক্তি দেখান যে, উপমহাদেশের মধ্যে অবিভক্ত বাংলার আয়তন সবচেয়ে বড়।
তখন এর আয়তন ছিলো প্রায় ২ লাখ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ছিলো ৭ কোটি ৮৫ লাখ। এতো বড় এবং জনবহুল প্রদেশ শাসন করা কষ্টকর ব্যাপার। অপরদিকে সেই তুলনায় আসাম এতো ছোট ছিলো যে, এটাকে একটি প্রদেশ হিসেবে শাসন করার যুক্তি ছিলো না। একইভাবে বিহার ও উড়িষ্যার আয়তনও বাংলার তুলনায় অনেক ছোট ছিলো।
তাই প্রশাসনিক সুবিধার যুক্তি দিয়ে বৃটিশরা বাংলাকে দুই অংশে বিভক্ত করে। বাংলার পূর্বাঞ্চলের ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিভাগ এবং আসাম নিয়ে গঠিত হয় একটি নতুন প্রদেশ। বাংলার অবশিষ্ট অংশ এবং বিহার-উড়িষ্যাকে নিয়ে গঠিত হয় অপর প্রদেশ। ১৯০৫ সালের ১৫ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গ সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয়। ঢাকা হয় পূর্ববঙ্গের রাজধানী।
তখন এই নতুন প্রদেশের আয়তন ছিলো ১ লাখ ছয় হাজার ছশ’ পঞ্চাশ বর্গমাইল। লোকসংখ্যা ছিলো তিন কোটি দশ লাখ। অধিবাসীদের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিলো মুসলমান। এই নতুন প্রদেশের প্রথম গভর্নর নিযুক্ত হয়েছিলেন স্যার র্যাস্পফিল্ড ফুলার। যার নামানুসারে ঢাকায় একটি সড়ক রয়েছে।
ভারতে নিযুক্ত বৃটিশ গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জন বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক দায়িত্বটি পালন করেছিলেন। এটা ছিলো তার শাসনামলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা। ইতিহাসে লর্ড কার্জন বড় জায়গাটি দখল করে রেখেছেন এই বঙ্গভঙ্গের সুবাদে। বাংলার মুসলমানেরা বিভিন্ন কারণে সেদিন বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান-কে সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। কারণ তখন মুসলমান নেতারা অনুধাবন করেছিলেন যে, নয়া প্রদেশের শাসন ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে নিজেদের প্রভাব বৃদ্ধি করা যাবে।
নিজেদের ঐক্য ও সংহতি জোরদার হবে। অবহেলিত পূর্ব বাংলার উন্নয়ন ও অগ্রগতি হবে। শিক্ষার বিস্তার ঘটবে। সে সময়ে বাংলার শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্য, অফিস-আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সবকিছু ছিলো কোলকাতাকেন্দ্রিক। এবং সেখানে ছিলো হিন্দুদের একচ্ছত্র আধিপত্য।
পূর্ববঙ্গের অধিকাংশ জমিদার বাস করতেন কোলকাতায়। তারা প্রজাদের কল্যাণে মনোযোগী ছিলেন না। প্রজাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে খাজনা আদায় করে কোলকাতায় বিলাসী জীবন যাপন করতেন। যেসব মুসলমান জমিদার ছিলেন তাদের প্রায় সকলেই একই পন্থা অবলম্বন করতেন। পূর্ববঙ্গের মুসলমান নাগরিকরাই বেশি অবহেলিত থাকতো।
বঙ্গভঙ্গের ফলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা অথনৈতিক উন্নতি অর্জন এবং শিক্ষা-দীক্ষায় এগিয়ে যাবার সুযোগ লাভ করে। এই সময়ে মুসলমানেরা হারানো গৌরব উদ্ধারের চেষ্টা করতে থাকে। তাদের দীর্ঘদিনের আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণ হতে শুরু করে। ঢাকাকে কেন্দ্র করে সচিবালয়, পরিষদ ভবন, সরকারি অফিস- আদালত, ব্যবসা কেন্দ্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠতে থাকে। পূর্ব বাংলার মুসলমানরা নতুন আশায় বুক বেঁধে জেগে উঠতে থাকে।
অপরদিকে গর্জে ওঠে কোলকাতাকেন্দ্রিক স্বার্থান্বেষী হিন্দুরা। বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্তে- কংগ্রেস ও বাংলার অন্যান্য হিন্দু নেতার মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এদের মধ্যে কোলকাতাকেন্দ্রিক আইনজীবীরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে ওঠেন। বঙ্গভঙ্গে তাদের পেশাগত আয়ে বিঘ্ন সৃষ্টি হবে বলে আইনজীবীরা বেশি প্রতিবাদী হন। কারণ তখন বঙ্গবঙ্গের ফলে মামলা-মোকদ্দমায় উচ্চতর বিচারের জন্য সারা বাংলার মানুষকে আর কোলকাতায় যেতে হয় না।
তাই উকিল সমপ্রদায় বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন জোরদার করে তোলে। কোলকাতাকেন্দ্রিক ব্যবসায়ী মহলও তাদের সাথী হয়। আমার শাসনামলেও এ রকম এক ঘটনার অবতারণা হয়েছিলো। আমি বিচার ব্যবস্থাকে সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেয়ার জন্য যখন হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চ রাজধানীর বাইরে চারটি বিভাগীয় শহরে স্থাপন করেছিলাম- তখন ঢাকার লব্ধ প্রতিষ্ঠিত আইনজীবীরা তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। তারা মনে করেছিলেন- এতে তাদের পেশাগত আয়ের গতি বাধাগ্রস্ত হবে।
শেষ পর্যন্ত- সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমার সে সিদ্ধান্ত- বাতিল হয়ে যায়। বিষয়টি নিয়ে আমি আর অগ্রসর হইনি। সংসদে আইন পাস করে আমার সিদ্ধান্ত- হয়তো বহাল রাখতে পারতাম, কিন্তু বিচার বিভাগের প্রতি সম্মান দেখিয়ে আমি সে পথে যাইনি। যা হোক, বঙ্গভঙ্গের কথাতেই ফিরে আসি। তখন বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন এতোটা তীব্র আকার ধারণ করেছিলো যে, বৃটিশ সরকার নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে।
আন্দোলনকারীরা বঙ্গভঙ্গকে মাতৃভূমির অঙ্গচ্ছেদ বলে বর্ণনা করেন। স্বাধীনতার আন্দোলনকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্র বলে এই পদক্ষেপকে বর্ণনা করা হয়। বাংলার সর্বত্র বৃটিশ পণ্য বর্জনের স্বদেশী আন্দোলন শুরু হয়। সে সময়ে এ দেশে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের সূচনা ঘটে। এদিকে এই আন্দোলনকে প্রতিহত করতে মুসলমানদের ব্যবহার করা হয় বলে হিন্দু নেতারা বৃটিশদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে থাকে।
মুসলমানরা নিজেদের স্বার্থে বঙ্গভঙ্গ-রদ আন্দোলনের বিরোধিতা করতে থাকে। ফলে বাংলায় দুই সমপ্রদায়ের মধ্যে এখান থেকেই তিক্ততার জন্ম নেয়। বৃটিশদের ওই উদ্দেশ্যটি শেষ পর্যন্ত- সফল হয়। বাংলার বিভিন্ন এলাকায় হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধতে থাকে।
শেষ পর্যন্ত- বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে কোলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দুদের আন্দোলনেরই জয় হয়।
হিন্দু বিক্ষোভের কাছে বৃটিশ সরকার নতিস্বীকার করে। তখন ভারত শাসন করছিলেন লর্ড হার্ডিঞ্জ। যার নামানুসারে হার্ডিঞ্জ ব্রিজটি নির্মিত হয়েছে। তার সময়ে বৃটিশ রাজা পঞ্চম জর্জ ভারত সফরে আসেন। ১৯১১ সালের ১২ ডিসেম্বর দিল্লির দরবারে রাজা বঙ্গভঙ্গ রদ করার ঘোষণা দেন।
এ সিদ্ধান্তে- পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে। তাদের মধ্যে যে আশার আলো জ্বলে উঠেছিলো তা তিরোহিত হয়। তবে এ ঘটনা মুসলমানদের জন্য বয়ে আনে সুদূরপ্রসারী ফল। তারই প্রতিক্রিয়ায় আজকের বাংলাদেশের অভ্যুদয়। মুসলমানদের মধ্যে জাগ্রত হয় স্বাতন্ত্র্যবোধ।
বঙ্গভঙ্গের সুফল ভোগের কথা তারা কখনোই ভুলে যেতে পারেনি। বঙ্গভঙ্গের প্রেক্ষাপটে গঠিত হয় মুসলমানদের নিজস্ব রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম- মুসলিম লীগ। বঙ্গভঙ্গ রদ করার ফলে মুসলমানদের মধ্যে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিলো তা প্রশমিত করতেই ১৯১৬ সালে লক্ষ্ণৌ চুক্তির ভিত্তিতে মুসলমানদের পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার সুযোগ দেয়া হয়। পূর্ববঙ্গবাসীর ক্ষোভ দূর করার জন্য ১৯২১ সালে বৃটিশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার প্রতীক বঙ্গভঙ্গ সেদিন রদ হলেও পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে যে স্বাতন্ত্র্যবোধ জাগ্রত হয়েছিলো- তারই ধারাবাহিকতায় বাংলা আর অবিভক্ত থাকতে পারেনি।
বৃটিশরা দুই সমপ্রদায়ের মানুষের মধ্যে যে দেয়াল তুলে দিয়েছিলো- সেখান থেকে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়া আর সম্ভব ছিলো না।
বাংলার মানুষ অতীতে শাসনক্ষমতা নিয়ে অতো মাথা ঘামায়নি। একনাগাড়ে সাড়ে ৫শ’ বছর মুসলমানরা দেশ শাসন করেছে। কখনো হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা-হাঙ্গামা হয়নি। বৃটিশ যে বিভেদের বিষ ঢুকিয়ে দিয়েছিলো- তাতে দুই সমপ্রদায়ের মানুষের জন্য পৃথক পৃথক দেশ গঠন অনিবার্য হয়ে পড়েছিলো।
এখন আমরা স্বাধীন দেশের বাসিন্দা। আমাদের ভাষাভাষী আর একটি জনগোষ্ঠী রয়েছে ভারতের অন্তর্গত একটি রাজ্যের মর্যাদা নিয়ে। উভয় খণ্ডেই হিন্দু-মুসলমান সহাবস্থানে আছে। দুই বাংলাতেই কোনো সামপ্রদায়িক সংঘাত নেই। তবে শাসনতান্ত্রিক দিক দিয়ে বাংলাভাষীরা যে দুই অংশে বিভক্ত আছে- এটাই উত্তম।
আজ বঙ্গভঙ্গের শতবর্ষ পরে ইতিহাস মন্থন করতে গিয়ে একটি কথাই বারে বারে মনে হয়- সেদিন যদি বঙ্গভঙ্গ না হতো কিংবা বঙ্গভঙ্গের পরে তা যদি রদ না হতো, তাহলে বাংলার আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ এখন কেমন থাকতো। যদি বঙ্গভঙ্গ না হতো তাহলে কোলকাতার আধিপত্যে পূর্ববঙ্গ কি সময়মতো জাগ্রত হতে পারতো? নিশ্চয়ই না। আবার যদি বঙ্গভঙ্গ রদ না হতো, তাহলে মুসলমানরা হয়তো তাদের সংগ্রামী চেতনার বিকাশ ঘটাতে পারতো না। সে সময় পূর্ববঙ্গের মানুষকে খুশি করার জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছিলো। বঙ্গভঙ্গ শিক্ষা দিয়ে গেছে- প্রশাসনিক সংস্কার কোনো দেশে বা অঞ্চলে দ্রুত বৈপ্লবিক পরিবর্তন বয়ে আনে।
সংস্কার কর্মসূচিতে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয় অবহেলিত সেক্টর। বঙ্গভঙ্গের কারণে যে নতুন প্রদেশ গড়ে উঠেছিলো- তার পরিপ্রেক্ষিতেই ঢাকাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছিলো। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল। মাত্র ছয় বছর সময়। এ সময়ের মধ্যে ঢাকার যতোটা উন্নয়ন হয়েছিলো, তার আগে গোটা বৃটিশ শাসনামলে তা হয়নি।
সংস্কারের উদাহরণ হিসেবে আমি নিজের গৃহীত পদক্ষেপের কথাও বলতে পারি।
আমি ক্ষমতা গ্রহণের পর প্রশাসনিক পদক্ষেপ হিসেবে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করেছিলাম। ফলে নতুন জেলাসমূহকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে যোগাযোগ ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেভাবে সেখানে দ্রুত উন্নতিও হতে থাকে। কিন্তু তখনও আমি বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছিলাম।
বৃহত্তর জেলার যে মহলটি ব্যবসায়িক ও পেশাগত সুবিধাহানির আশঙ্কা করেছিলো- তারা মহকুমাকে জেলায় রূপান্তর করাটা ভালোভাবে গ্রহণ করেনি। তবে আঞ্চলিক স্বার্থ মুখ্য হয়ে পড়ায় বিরোধিতাকারীরা সোচ্চার হবার সুযোগ পায়নি। তবে তীব্র সমালোচনা ও প্রতিবাদের মুখোমুখি হয়েছিলাম বৃটিশ আমলের থানা ব্যবস্থাকে রহিত করে যখন উপজেলা কায়েম করেছিলাম। বঙ্গভঙ্গ রদ আন্দোলনের মতো তীব্র আন্দোলন শুরু হয়েছিলো উপজেলা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। তবে জনস্বার্থমূলক সংস্কারের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন টিকে না।
উপজেলা চালু করলাম। দেশবাসী সানন্দে উপজেলা ব্যবসস্থা গ্রহণ করলো। এই ব্যবস্থার ফলে ঘুমন্ত- বাংলাদেশ জাগ্রত হলো, অবহেলা-অনাদরে পড়ে থাকা ৬৮ হাজার গ্রাম উন্নয়ন সমৃদ্ধির ছোঁয়ায় নতুন সাজে সেজে উঠলো। হাজার বছর ধরে যে মানুষরা বংশপরম্পরায় যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে বঞ্চিত হয়েছে কিংবা আধুনিক যুগের সাথে পরিচিত হতে পারেনি, যারা কখনো পাকা রাস্তায় হাঁটতে পারেনি, যারা গাড়ি-ঘোড়া দেখেনি, বিদ্যুৎ কাকে বলে বুঝতো না, সেই মানুষরা উপজেলা প্রবর্তনের ফলে এসব চিনেছে, জেনেছে এবং ভোগ করেছে। বঙ্গভঙ্গের ফলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলার পূর্বাঞ্চল যেমন উন্নয়ন-সমৃদ্ধির পথে পা দিয়েছিলো, ঠিক তেমনি।
সেই বঙ্গভঙ্গ স্বার্থান্বেষীদের আন্দোলনের ফলে যেমন রদ হয়েছিলো, যুগান্তকারী উপজেলা ব্যবস্থাও একবার রদ করা হয়েছে। তবে উপজেলার বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে আবার তা প্রবর্তিত হয়েছে। যদিও তা পূর্ণাঙ্গ রূপ এখনো লাভ করেনি।
১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের পেছনে বৃটিশ সরকারের আসল উদ্দেশ্য যা-ই থাক না কেনো, সেই প্রশাসনিক সংস্কারটি যে এই ভূখণ্ডের মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বার্থের একান্ত অনুকূলে গিয়েছিলো- তা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। এর ফলে বৃটিশবিরোধী আন্দোলন হয়তো কিছুটা অন্যদিকে মোড় নিয়েছিলো।
কিন্তু একটি বিরাট অঞ্চলের মুসলমান জনগোষ্ঠী অধিকার সচেতন হতে পেরেছে। বৃটিশদের বিরুদ্ধে শুধু হিন্দুরাই আন্দোলন করেনি, মুসলমানরা সমান তালেই সংগ্রাম করেছে। বরং বৃটিশদের হাতে মুসলিম শাসনের অবসান ঘটার কারণে তারাই বেশি সোচ্চার ছিলো স্বাধীনতার পক্ষে। তবে ওই সময়ে বঙ্গভঙ্গ ছিলো বাংলার মুসলমানদের জন্য আশীর্বাদ। বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে বৃটিশদের উদ্দেশ্য যা-ই থাক না কেনো, ঢাকাকে কেন্দ্র করে একটি নতুন প্রদেশ গঠনের ব্যাপারে তাদের যুক্তি ছিলো অকাট্য।
তারা দেখিয়েছিলো, প্রায় আট কোটি জনসংখ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলকে একটি প্রদেশের অধীনে সুষ্ঠু শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। গোটা প্রদেশে সুষম উন্নয়নের জন্যও নতুন প্রদেশ গঠন জরুরি ছিলো। শিক্ষার বিস্তার, যোগাযোগ ব্যবসস্থার উন্নতি, অবকাঠামোগত সমৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক দিক বিবেচনায় সেই বাংলাকে ভাগ করে একটি নতুন প্রদেশ গঠন ছিলো এক যুগান্তকারী ঘটনা। বাংলার মুসলমানদের স্বার্থের সোপান রচিত হয়েছিলো ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন প্রদেশ গঠনের মাধ্যমে।
ইতিহাসের সিঁড়ি বেয়ে সেই ঢাকা আজ আমাদের স্বাধীন দেশের গর্বের রাজধানী।
আজ আমরা এক জাতি- এক ভাষা এবং স্বতন্ত্র সংস্কৃতির ধারক-বাহকের পরিচয় বহন করে চলেছি। জনগোষ্ঠীর ৯০ ভাগই মুসলমান। অন্য ধর্মের মানুষরা এখানে স্বীয় ধর্ম-কর্মের পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে ধর্মীয় সৌহার্দ্যের মধ্যে বসবাস করছে। সমস্যা যা আছে তা সকল নাগরিক সমানভাবে ভোগ করে। প্রধান সমস্যা প্রশাসনিক।
বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের দেশের মধ্যে এখন লোকসংখ্যা ১৪ কোটির ওপরে। দেশে দুর্নীতি, অপরাধপ্রবণতা এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি চরম পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। এ অবস্থায় আমাদের দেশের প্রশাসনিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। সে উপলব্ধি থেকেই আমি বাংলাদেশে প্রশাসনিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রস্তাব দিয়েছি।
আমি একান্ত ভাবে বিশ্বাস করি- দেশে সুষ্ঠু শাসন ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ ঘটাতে, জনগণের শান্তি, নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করতে প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের কোনো বিকল্প নেই। আজ হোক আর কাল হোক- প্রয়োজনের তাগিদেই প্রাদেশিক ব্যবস্থা একদিন প্রবর্তন করতেই হবে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বৃটিশরা উপলব্ধি করেছিলো যে, ৭ কোটি ৮৫ লাখ মানুষের অঞ্চলে একটি প্রদেশের মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। অথচ তখন এই জনগোষ্ঠী ২ লাখ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বাস করতো। পরাধীনতা ছিলো- কিন্তু মানুষের নিরাপত্তার অভাব ছিলো না।
তারপরও জনসংখ্যার বিবেচনায় প্রদেশ গঠনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছিলো। সে সময়কার মাত্র ছয় বছরের প্রাদেশিক শাসনের সুযোগের ধারাবাহিকতায় আজ আমরা একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশের নাগরিক হবার গৌরব অর্জন করেছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।