পেশায় নাবিক নেশায় যাযাবর
“মেরিন একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা” এই ব্যপারে কোন সন্দেহ নেই। স্বপ্নীল ক্যারিয়ার মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং অনেককেই নেশার মত টানে। ইয়ং জেনারেশন সব সময় নতুন কিছু খোঁজে , চায় আধুনিকতার ছোঁয়া। সেই সাথে এমন একটা ক্যারিয়ার যা তাকে অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং সমাজে একটা সম্মানজনক স্থান দিবে। নীল পানির রোমাঞ্চকর সাগরকে শাসন করার পাশাপাশি ভাল আয় রোজগার , সেই সাথে বিনা পয়সায় বিশ্ব ভ্রমণ।
আমার মনে হয় না পৃথিবীর অন্য কোন পেশায় এমন সুযোগ আছে ।
ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ার হয়ে যেকোনো বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে প্রতিষ্ঠিত হতে ৯ থেকে ১০ বছর সময় লাগে। কিন্তু মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং বা নটিক্যাল অফিসার হিসাবে যে কেউ মাত্র ৫ বছরে ভাল আয় রোজগার শুরু করতে পারবে। ( দুই বছর মেরিন একাডেমীতে প্রি-সি ট্রেনিং , ২ বছর শিক্ষা নবিশ হিসাবে চাকরি এবং এক বছরের প্রিপারেটরি কোর্স/ স্পেশাল সর্ট কোর্স / এবং সার্টিফিকেট অফ কম্পেটেন্সি পরীক্ষা)। যদি সিস্টেম লসের কারনে ৬ বা সারে ৬ বছরও লাগে তাহলেও একজন জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার বা অফিসার হিসাবে আপনি যথেষ্ট বেতন পাবেন যা অন্য কোন পেশায় সম্ভব নয়।
তাই আমার মতে উদ্যোমী এবং বুদ্ধিদীপ্ত তরুণদের জন্য এটা একটা আদর্শ পেশা ।
এখানে আর একটা কথা উল্লেখ না করলেই নয় “ বাংলাদেশী মেরিনারা অন্যান্য উন্নত দেশের কর্মকর্তাদের সমান বেতন পায়”। অর্থাৎ একজন ব্রিটিশ নাগরিক জাহাজে যে বেতন পাবে ঐ কোম্পানির একই রেংকে আমাদের মেরিনারও সেই বেতন পায়। আর যারা দেশের বাইরে সেটেল হতে চান বৈধ ভাবে এবং নিজের পেশার কাজ করতে চান বিদেশে গিয়ে। তারাও এই পেশায় সহজেই আসতে পারবেন।
কারন মেরিনারদের জন্য কানাডা , অস্ট্রেলিয়া , সিঙ্গাপুর , ইংল্যান্ডে প্রচুর চাকরি আছে এবং মেরিনারদের মাইগ্রেশন নিয়ম কানুন অনেক সহজ।
আন্তর্জাতিক ভাবে মেরিনাদের একটা ঘটিত সব সময় ছিল এবং এখনও আছে। মেরিনাদের বাজারে সবচেয়ে ভাল ভাবে এগিয়ে আছে ভারত , ফিলিপাইন , কোরিয়া , ইন্দোনেশিয়া এবং হাটিহাটি পা পা করে অনেক দূর এগিয়ে গেছে বার্মা। আর ঝড়ো বেগে এই মার্কেটে হানা দিচ্ছে “চীন”। এসব দেশে মেরিন পড়াশুনার জন্য প্রচুর ইন্সটিটিউট আছে।
সেই দিক থেকে আমরা অনেক পিছিয়েছিলাম । দুই/তিন বছর আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে মেরিন পড়াশুনার জন্য একমাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল “বাংলাদেশ মেরিন একাডেমী, চিটাগং”। তাছাড়া মেরিন ফিশারিজ একাডেমী থেকে পাশ করেও মেরিনে আসার একটা উপায় ছিল। সেই সাথে ইন্টার পাশ করে সরাসরি জাহাজে উঠে অনেক দিন সি টাইম করেও অনেকে এই লাইনে এসেছেন। (কিন্তু এখন আইএমও এর নতুন নিয়ম অনুযায়ী প্রি-সি ট্রেনিং না নিয়ে কেউ জাহাজে উঠতে পারবে না।
তাই এই পথটি এখন বন্ধ)
গত তিন চার বছরে মেরিন একাডেমীর ক্যাডেট রিক্রুট অনেক বাড়ান হয়েছে(আগে এটা ছিল বছরে মাত্র ৬০জন)। সেই সাথে নতুন আর পাঁচটি সরকারি মেরিন একাডেমী করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত একটির কাজ শুরু করা হয়েছে। সেই সাথে সরকারি ভাবে ঢাকা/ চিটাগং এ ১৫ টির মত বেসরকারি মেরিন ট্রেনিং ইন্সটিটিউট পরিচালনার অনুমতি দেয়া হয়েছে। অনেক গুলো ইতিমধ্যে ভাল ভাবেই কাজ শুরু করেছে।
অনেক ক্যাডেট রিক্রুট করে ট্রেনিং শুরু হয়েছে।
বিদেশে ক্রমবর্ধমান চাহিদা এবং অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জনের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও কেন আমরা প্রাইভেট মেরিন ট্রেনিং ইন্সটিটিউট এবং মেরিন একাডেমীতে ক্যাডেট সংখ্যা বাড়ান নিয়ে খুশী নই ?
এই প্রশ্নের উত্তরটা খুব জরুরী । এর উত্তর আমি না দিয়ে যদি সরকারি ভাবে চিন্তা করা হত তাহলে অনেকভাল হত। আমি দুই ভাগে প্রশ্নের উত্তর দিতে চাই—
প্রথম ভাগঃ যখন সারা বিশ্বে মেরিন অফিসার বাড়ানোর জন্য বড় বড় কোম্পানি বিভন্ন দেশের মেরিন ইন্সটিটিউটের সাথে ক্যাডেট নেয়ার জন্য চুক্তি বদ্ধ হচ্ছিল তখন আমাদের ক্যাডেট তৈরির সংখ্যা ছিল মাত্র ৬০ জন। অনেক কোম্পানি তখন বাংলাদেশে এসেছিল ক্যাডেট নেয়ার জন্য।
আমাদের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের দূরদর্শিতা হীনতার জন্য এগুলো হাতছাড়া হয়ে যায়। এসব কোম্পানি ভারত , ফিলিপাইন, বার্মা এবং চায়নায় দীর্ঘ মেয়াদী বিনিয়োগ করেছে ক্যাডেট তৈরির জন্য। এরা স্থায়ী ট্রেনিং সেন্টার তৈরি করে একটা নিয়ম নীতির মধ্যে ক্যাডেট নিয়োগ করে তাদের আধুনিক ট্রেনিং দিচ্ছে। ট্রেনিং এর খরচ এবং ট্রেনিং শেষে শিক্ষা নবিস হিসাবে নিয়োগ এবং পরীক্ষার যাবতীয় খরচ ঐ সব কোম্পানি দিয়ে থাকে। যেহেতু ক্যাডেট নিয়োগের বাজার একবার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে , একটি নতুন বাজার আমাদের সৃষ্টি করতে হবে।
এবং এটাই এখন নতুন চ্যালেঞ্জ।
এখন আমাদের তৈরি অফিসারদের বিদেশে অনেক চাহিদা থাকলেও ক্যাডেটদের কোন চাহিদা নেই। তাহলে এই ক্যাডেটরা কিভাবে তাদের শিক্ষানবিশ হিসাবে ট্রেনিং পিরিয়ড শেষ করবে???
আর একটা কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখ্য “ শিক্ষা নবিশ হিসাবে জাহাজে চাকরি না করে, কেউ কম্পিটেন্সি পরীক্ষা দিতে পারবে না। এবং নুন্যতম ১২ মাস থেকে শুরু করে ২৪ মাস পর্যন্ত শিক্ষা নবিশ হিসাবে চাকরি করার পর কিছু পরীক্ষায় পাশ করেই জুনিয়ার ইঞ্জিনিয়ার/অফিসার (ক্লাস থ্রি সার্টিফিকেট) সার্টিফাইড হওয়া যায়। তার আগ পর্যন্ত নয়।
দ্বিতীয় ভাগঃ আমাদের প্রাইভেট ইন্সটিটিউট গুলো অনেকটা প্রাইভেট ইউনির আদলে তৈরি হয়েছে। মুল কারন অনেক ব্যবসায়ী এখানে অনেক মুনাফা পাওয়া যাবে বলে তাদের মত তৈরি করেছে। অনেক ইন্সটিটিউটে নেই ভাল ইনসট্রাক্টর , হাতে কলামে শেখার মত ভাল যন্ত্রপাতি । কিন্তু আছে খুব ভাল মার্কেটিং টীম। প্রথমেই তারা মিথ্যা তথ্য দিয়ে ক্যাডেট রিক্রুট করেছে।
যেমন “পাঁচ বছরে ক্যাপ্টেন / চীফ ইঞ্জিনিয়ার হয়ে হাজার হাজার ডলার ইনকাম করুন” অথচ পাঁচ বছরের মাথায় অনেকেই প্রাথমিক সনদ পাবে না । ( দুই বছর মেরিন একাডেমীতে প্রি-সি ট্রেনিং , ২ বছর শিক্ষা নবিশ হিসাবে চাকরি এবং এক বছরের প্রিপারেটরি কোর্স/ স্পেশাল সর্ট কোর্স / এবং সার্টিফিকেট অফ কম্পেটেন্সি পরীক্ষা)। এর ফলে অনেকে বিভ্রান্ত হবে। বিশেষ করে অভিভাবকরা। সেই সাথে তারা কিভাবে শিক্ষানবিশ হিসাবে জাহাজে উঠবে তা নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নাই।
সরকারি মেরিন একাডেমী সহ অনেক ক্যাডেট এখন চাকরীর জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে।
তার উপর শুধু ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে চালিত এসব প্রতিষ্ঠান প্রথম ব্যাচ গুলোতে কোন রকম ষ্ট্যাণ্ডার্ড টেস্ট ছাড়াই রিক্রুট করা হয়েছে ক্যাডেটদের । জাহাজে অনেক টাকা বেতন দেয়া হ্য়-এই কথা যেমন সত্য , তেমনি এই বেতন যে উশুল করা হবে সেই কথাটাও আমাদের ভুলে গেলে চলবে না। এখানে দরকার উদ্যোমী , বুদ্ধিদীপ্ত , সাহসী এবং শাররিক ভাবে ফিট এবং যেকোন পরিবেশে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে এমন তরুণদের। এটা যে শুধু প্রতিষ্ঠান গুলোর দায়িত্ব তা নয়।
অভিভাবকদেরও উচিৎ ভেবে দেখা, তার সন্তান যথেষ্ট স্মার্ট কিনা জাহাজে যাবার জন্য। তা না হলে ১৪/১৫ লাখ টাকা খরচ করে জাহাজে পাঠানোর পর সে যদি সারভাইভ না করতে পারে । একদিকে যেমন টাকা , সময় নষ্ট অন্য দিকে যে প্রতিষ্ঠান তাকে পাঠাল তাদের এবং দেশের রেপুটেশন নষ্ট হবে। বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীর একটি ব্যাচের দুই জন ক্যাডেট ফেরত আসায় পরবর্তী তিনটা ব্যাচের মারাত্নক সমস্যা হয়েছিল চাকরী পেতে।
( অটঃ একটি প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান থেকে এক অভিভাবক তার সন্তানকে ২ মাস ক্লাস করার পর ভর্তি প্রত্যহার করেছে “ক্লাস রুমে এসি নেই” এই কারনে।
আমার জাহাজে আমি এক ক্যাডেট পেয়েছি যে কিনা অনেক খাবার বেছে বেছে খায়, জাহাজ রোল করলে সোজা হয়ে দাড়াতে পারেন না, সারাক্ষন বমি করে । ৭/৮ ঘণ্টা ডিউটি করলে টায়ার্ড হয়ে যায়। এই ধরনের ছেলেরা কোন মতে জাহাজে চাকরীর জন্য উপযোগী নয়”)
তাহলে আমাদের মেরিন ভবিষ্যৎ কি অনুজ্জ্বল ?
না- আমি তা মনে করি না। আপাতত একটা সংকট থাকলেও এটা অতি দ্রুত কেটে যাবে। যখন প্রাইভেট এবং সরকারি মেরিন একাডেমীর অনেক ক্যাডেট জাহাজে উঠতে পারবে না তখন একটা না একটা উপায় বেরিয়ে আসবে।
সেটা সরকারি ভাবে হোক কিংবা বেসরকারি কিংবা ব্যক্তিগত। এর বড় উদাহরণ আমারা। আমাদের সমসাময়িক তিনটি ব্যচে শিক্ষানবিশ হিসাবে চাকরীতে খুব সমস্যা হয়েছিল । তবে এর পড়ে এমনও হয়েছে মেরিন একাডেমী থেকে বের হবার আগেই অনেকে দুই/ তিনটা করে চাকরীর অফার পেয়েছিল।
আমি আশা করব সরকার এবং ব্যাক্তিগত ভাবে যারা মেরিন ইন্সটিটিউট করেছেন তারা সম্মেলিত ভাবে এগিয়ে এসে এই একমাত্র সমস্যার সমাধান করবে।
তাহলে বিদেশী রেমিটেন্স অর্জনে মেরিনাররা একটা বিশাল অবদান রাখতে পারবে। এবং দেশে আর মেরিন ইন্সটিটিউট হবে। সেই সাথে সরকার একটা নির্দিষ্ট নীতিমালা তৈরি করবে প্রাইভেট ইন্সটিটিউট গুলো চালানোর জন্য এবং ক্যাডেট রিক্রুটের একটা আদর্শ গাইড লাইন থাকবে। ( এসব শুধু থাকলেই হবে না , তা মেনে চলতে হবে এবং মনে রাখতে হবে আমাদের এই নব্য ইঞ্জিনিয়ার/অফিসারদের কেউ দেশি পরিমণ্ডলে চাকরী করবে না। সবাইকে বিদেশীদের সাথে কম্পিটিশন করে চাকরী করতে হবে।
)
বাংলাদেশে সব গুলো প্রাইভেট ইন্সটিটিউটের ঠিকানা আপাতত আমার কাছে নেই। যোগাড় করার চেষ্টা করছি। পরের পোষ্টে বাংলাদেশ মেরিন একাডেমীসহ অন্যান্য প্রাইভেটে ভর্তির যোগ্যতা , নিয়ম কানুন , যোগাযোগের উপায় নিয়ে লিখব।
আর একটা প্রশ্ন “ কোন প্রাইভেট ইন্সটিটিউট সবচেয়ে ভাল?” আমাকে জিজ্ঞাসা করবেন না। এটার উত্তর আমি দিতে পারব না ।
তবে আমার নিচের পোস্ট টা আপনাদের একটা গাইড লাইন দিতে পারবে।
মেরিন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়বেন !!! কোথাও ভর্তি হবার আগে কিছু জেনে নিন !!
লেখাটা মূলত এবার যারা এইস এস সি পরীক্ষা দিচ্ছে তাদের জন্য উৎসর্গ করা হল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।