এই সেই ............. ১.
বাংলায় ইংরেজদের শাসনামলে একটি লাভজনক ব্যবসা নীল চাষ। ১৭৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এ দেশে নীল চাষ শুরু করে। তারা চাষিদের জমি কিনে তাতে চাষিদের খাটিয়ে নীল উৎপাদন করত। আবার চাষিদের দাদন দিয়েও নীল চাষে উদবোদ্ধ করত। যে সব চাষি দাদনের মাধ্যমে নীলকর সাহেবদের সাথে চুক্তিবদ্ধ হতো তারা নির্দিষ্ট সময়ে নীল উৎপাদন করে নীলকুঠিতে জমা দিতে না পারলে তাদের তাদের নীলকুঠিতে ধরে এনে তাদের উপর অমানুষিক নির্যাতন চালানো হত।
। নীলকর সাহেবরা তাদের সাথে দাসের মতো আচরণ করত। দাদন দেওয়া মানে যেন তাদের কিনে নেওয়া। তাই কেউ নীলচাষ করতে অপারগতা প্রকাশ করলে সাথে সাথে তার উপর নেমে আসব অকথ্য নির্যাতন। নীলচাষে অত্যধিক লাভ হলেও বাংলার চাষীগন কখনোই সেই লাভের গুড় খেতে পারেননি।
নীল চাষে অত্যধিক লাভের কারণ ছিল স্বপ্ন মজুরী। তখন চাষিদের নামমাত্র মজুরী দেওয়া হত। নীলকর সাহেবরা নীলচাষীদের ন্যায্য পাওনা দিতেও গড়িমসি করত। অনেক সময় ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করতেও কুন্ঠাবোধ করত না।
একসময় ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এদেশ থেকে বিতাড়িত হয়, তাদের হাত ধরে নীলচাষ প্রথাও এদেশ থেকে নির্বাসিত হয়।
২.
বর্তমান সময়ে তৈরি পোষাক শিল্প হলো লাভজনক ব্যবসা। এ শিল্পে অত্যধিক লাভ হওয়ায় অনেকেই এ শিল্পের প্রতি ঝুঁকছেন। পোষাক শিল্পের উন্নতির ফলে সৃষ্টি হয়েছে কর্মসংস্থান, কমেছে বেকারত্ব। অশিক্ষিত বা কম শিক্ষিতরাও এখন চাকরি করে সংসার চালাতে পারছে। এখন দেশের ছোট রাস্তা থেকে বড় রাস্তা, ছোট শহর থেকে বড় শহর সর্বত্রই গজিয়ে উঠেছে অনুমোদিত বা অনুমোদনহীন পোষাক কারখানা।
এ শিল্পেও অত্যধিক লাভের কারণ শ্রমিকদের স্বল্প মজুরী। এদেশে শ্রমিকদের দাম কম হওয়ায় পোষাক তৈরী করতে দাম কম পরে তাই বিদেশী ক্রেতাগণ এদেশ থেকে সল্প দামে পোষাক কিনে নিতে আমাদের দেশে তাদের কাজ দেন। বিদেশী ক্রেতাগণ তাদের প্রতিনিধিদের মাধ্যমে এদেশের বায়িং হাউজগুলোয় যোগাযোগ করে কাজের অর্ডার দেয় এবং পোষাক উনার নিকট পৌছানোর জন্য নির্দিষ্ট সময়সীমা বেধে দেয়। ক্রেতা কিভাবে উনার পোষাক হাতে পেতে চান তাও বলে দেওয়া হয়। উক্ত সময়সীমা মাথায় নিয়ে পোষাক প্রস্ততকারক প্রতিষ্ঠানের কর্ম পরিকল্পনা সাজাতে হয়।
এদেশে পোষাক শিল্প শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরী ধরা হয়েছে ২৫০০ টাকা। সর্বোচ্চ ৪৮০০ টাকা। বর্তমান বাজারমূল্য বিবেচনা করলে এ টাকায় জীবন ধারণ করা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু গার্মেন্টস শ্রমিকদের জীবন থেমে নেই। এখন প্রশ্ন থেকে যায় যদি এ টাকায় জীবন ধারণ অসম্ভব হয় তাহলে তাদের জীবন চলছে কিভাবে? এখানে একটি কথা বলে রাখা উচিত গার্মেন্টস সেক্টরের ঐ শ্রেণীতে দুর্নীতির করে অর্থ উপার্জনের কোন সুযোগ নেই।
গার্মেন্টস শ্রমিকরা জীবনের সব স্বাদ ত্যাগ করেই শুধু জীবন ধারণের জন্যই গার্মেন্টস এ পরে থাকে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী প্রত্যেকের জন্য স্বাভাবিক কর্ম সময় ৮ ঘণ্টা এবং এর পর যা করা হবে তাকে ওভার টাইম বলা হবে এবং এই অতিরিক্ত সময়ে সবাইকে তাদের মুল বেতনের ঘণ্টা হিসেবে দ্বিগুণ বেতন দিতে হবে। তবে দিনে ২ ঘণ্টার বেশী কখনোই অতিরিক্ত কাজ করানো যাবেনা। সপ্তাহে নির্দিষ্ট একদিন সবাইকে ছুটি দিতে হবে। কিন্তু আমাদের পোষাক শিল্প এই নিয়ম মেনে চলে না।
দিনে সর্বোচ্চ ১০ ঘণ্টা কাজের অনুমতি থাকলেও পোষাক শিল্পে কাজ করানো হয় ১৩ থেকে ১৭ ঘণ্টা পর্যন্ত। শ্রমিকদের জন্য ছুটির দিনগুলোতেও ছুটি থাকেনা। কখনো কখনো মাসে ৩০ দিনই তাদের কাজ করতে হয়। শ্রমিকরাও প্রতিবাদ না করে কাজ করে যায়। কারণ তাদের কাজ করতে হবে জীবন বাঁচানোর জন্য।
তারা জানে ৪৮০০ টাকায় কখনোই জীবন চলবেনা, পরিবার বাঁচবে না। তাই পরিবারকে বাঁচাতে, পরিবারে একটু সুখ আনতে রোবটের মত রাতদিন কাজ করে যায়। ওভারটাইমে দ্বিগুণ বেতন দেওয়ার কথা থাকলেও অনেক কোম্পানীই এই নিয়মকে কাঁচকলা দেখিয়ে নিজেদের নিয়ম অনুযায়ী চলে। ফলে দেখা যায় শ্রমিক তার ন্যায্য-মজুরী পায় না।
৩.
গার্মেন্টস শিল্পে ৮০% শ্রমিক নারী।
তাদের সংসার সামলাতে হয়, পতি সেবা করতে হয়। সে সকাল ৮ টায় যখন কারখানায় প্রবেশ করে তখন সে জানেনা কখন বের হতে পারবে। যদি ঐদিন তার ১৩ ঘণ্টা পর্যন্ত থাকতে হয় তাহলে কারখানা থেকে বের হতে হতে ঘড়ির কাটায় বাজবে রাত ১০ টা। রাত ১০টায় অফিস থেকে বের হয়ে সে প্রায় দৌড়াতে দৌড়াতে বাসায় ফিরে। বাসায় ফিরে চুলোয় আগুন ধরিয়েই চাল চাপিয়ে দেয়।
সারাদিন মায়ের পথ পানে চেয়ে থাকা সন্তানকে সময় দেয়। তরকারি কেটে তা আবার চুলোয় চাপায়। নিতে হয় পতির খোঁজ। মোবাইল ফোনে প্রিয়জনদের সাথে সেরে নিতে হয় প্রয়োজনীয় আলাপ। রান্না শেষ হলে সবাইকে নিয়ে খাওয়া দাওয়া সেরে ঘুমাতে যেতে হয়।
এই অল্প সময়টুকুও ঘড়ির কাটা জানান দেয় এখন রাত দুটো। আবার ঘুম ভাঙে ফজরের আজানের আগেই। মাথায় রাখতে হয় অফিস টাইম আটটা। কখনোই অফিসে লেট করা যাবেনা। তিন দিন লেট করলে একদিনের বেতন কাটা যাবে।
তাই চুলায় নাস্তা চাপিয়ে তৈরি হতে হয়। স্বামীকে বিদায় জানাতে হয়, তৈরি করতে হয় বাচ্চার জন্য খাবার। সন্তানকে শান্ত করে দুপুরের খাবার টিফিন বক্সে টুকিয়ে দৌড়তে হয় অফিসের উদ্দেশ্য। মাথা কেবলই ঘুরে বেড়ায় এই বুঝি আটটা বেজে গেল। সকালের নাস্তাটুকু তার করা হয়নি এ চিন্তাও তার মাথায় নেই।
এভাবেই চলে একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের দৈনন্দিন চক্র। এই চক্রে কোন বিরাম নেই। মেশিন চালিত যন্ত্রও হয়ত গার্মেন্টস কর্মীর দৈনন্দিন এই চিত্র দেখে অবাক হবে।
গার্মেন্টসে যারা চাকরী করে থাকে সামাজিকভাবে অনেকেই তাদের হেয় দৃষ্টিতে দেখে। যেন এরা বারবনিতা।
যে সব শ্রমিক গার্মেন্টস শিল্পে প্রবেশ করে তারা সমাজে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েই এই জীবনে আসে। সখের বশে কেউ গার্মেন্টস সেক্টরে কাজ করতে আসেনা।
৪.
গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকরা অপুষ্টির শিকার হন, নিজের চেহারায় যাদের দেখার সাধ্য নেই তারা পুষ্টি দেখবে কিভাবে? পুষ্টিগুন সম্মত খাবারের সন্ধানইবা তাদের কে দিবে?
তাদের নিজের জীবনটুকুই যেন গার্মেন্টস মালিকগণ কিনে নিয়েছেন। তাই পান থেকে চুন খসলেই দেখানো হয় চাকরি-চ্যুতির ভয় অথবা বেতন কেটে নেওয়ার ভয় । গার্মেন্টস শ্রমিকগণও ভয়ে সবসময়ই নিজের ভেতর গুটিয়ে থাকে।
যন্ত্রের মত তারা কেবল হাত গুড়িয়ে পোষাক উৎপাদনে সাহায্য করে যায়। গার্মেন্টস কারখানায় অনেক শ্রমিককেই সারাদিন দাড়িয়ে কাজ করতে হয়। প্রাথমিক অবস্থায় যে শ্রমিক দাড়িয়ে কাজ করে তার পা ফুলে যায় কিন্তু কিছু হাতে অর্থ পাওয়ার আশায় সব পরিশ্রম সয়ে নেয়।
পোষাক কারখানাগুলোয় বিভিন্ন ক্রেতা অডিটের ব্যবস্থা করে থাকেন। যে অডিটে ক্রেতা নিজেই আসেন বা অন্য পক্ষের মাধ্যমে অডিট করিয়ে নেন।
অডিটরগণ অডিটের বিষয়বস্তু হিসেবে দেখেন আন্তর্জাতিক শ্রমআইনসমুহ সঠিক ভাবে মানা হচ্ছে কিনা। অডিটরগণ দেখেন এখানে ১০ ঘণ্টার উপর কাজ করা হয় কিনা, ছুটির দিনের খোলা থাকে কিনা ও অন্যন্য বিষয়বস্তু। কিন্তু তাদের অডিট কেবলই কাগজ-কেন্দ্রিক। কাগজে কলমে ছুটির দিনে কাজ করা হয়না, ১০ ঘণ্টার বেশী কাজ করা হয়না দেখাতে পারলেই অডিট পাশ। কিন্তু বাস্তবতা অডিট টিম কখনোই দেখেননা।
তাদের দৃষ্টিতে কাগজ ঠিক তো সব ঠিক। কাগজ ঠিক মানেই ১০০% কমপ্লায়েন্স ফ্যাক্টরি। তারা বাস্তবতা দেখতে চাননা, যদি চাইতেন তাহলে ছুটির দিনে কারখানা ভিজিট করে সত্যতা যাচাই করতেন, ১০ ঘণ্টার পর কারখানায় এসে ভিজিট করে দেখতেন সত্যই ১০ ঘণ্টার পর কাজ হয় কিনা। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিগুলোয় শ্রমিকদের মিথ্যা বলার ট্রেনিং দেওয়া হয় যেন অডিটর এসে প্রশ্ন করলে সঠিকভাবে মিথ্যাগুলো বলতে পারে। যেন বলতে পারে তাহারা খুব সুখী, ১০ঘন্টার পর ফ্যাক্টরিতে কোন-দিনই থাকে নাই, ছুটির দিনের পরিবারের সাথে সময় দেয়।
সুর্যাস্ত দেখে ছুটির বিকাল কাটায়। কিন্তু শ্রমিকরা সূর্যাস্তের ছবি ব্যতীত কখনোয় বাস্তবে সূর্যাস্ত দেখতে পায় না।
সমাজের বিবেকবানদের উচিত এই শিল্পটি যাদের হাত দিয়ে বড় হয়েছে তাদের দিকে সুনজর দেওয়া। শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি করে ও বিভিন্ন প্রনোদনা দিয়ে তাদের একটি সুন্দর জীবন উপহার দেওয়া। এসব ব্যবস্থা করা উচিত যেন শ্রমিকগণ তাদের পরিবারকে সময় দিতে পারেন, নিজের প্রতিও যত্ন নিতে পারেন।
৫.
লেখার শুরুতে নীলচাষ দিয়ে শুরু করেছিলাম কারণ নীলকর সাহেবদের মানসিকতার সাথে আমি পোষাক শিল্প মালিকদের মানসিকতার মিল খুঁজে পাই। নীলকর সাহেবরা নীল বিক্রি করে অত্যধিক লাভ করলেও নীলচাষীদের প্রাপ্য মজুরী দেয়নি, কিন্তু তাদের রক্ত চুষে নিয়েছে। পোষাক শিল্প মালিক-গনও পোষাক রপ্তানি করে আকাশছোঁয়া প্রাসাদ নির্মাণ করলেও শ্রমিকদের প্রাপ্য সম্মান, প্রাপ্য অধিকার দেয়নি, দেয়নি প্রাপ্য মজুরীও। নীলকর সাহেবগণ নীলচাষীদের করতেন অমানষিক নির্যাতন, পোষাক শিল্পেও শ্রমিকদের নির্যাতন করা হয় তা কথায় কিম্বা কাজে।
যাদের রক্ত পানি করা টাকায় আকাশ ডেকে দিতে চাচ্ছে পোষাক শিল্প মালিকগণ, সেসব শ্রমিকদের কুড়ে ঘর থেকে আকাশ দেখা যায়।
শ্রমিকগণ ভরাট চাঁদের জোছনা দেখে, আমবস্যার আঁধার দেখে কিন্তু সূর্য্যর আলো দেখেনা। সূর্য্যের সাথে তাদের সখ্যতা নেই। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।