জাদুনগরের কড়চা
উইম্বলডন শেষ হয়ে গেলো মাত্র, এবার বিশ্বকাপ ফুটবলের ডামাডোলে পড়ে উইম্বলডন নিয়ে আগ্রহ আরও কম। অথচ দুই দিনে ১১ ঘন্টারও বেশি সময় ধরে খেলা বিশ্বরেকর্ড করা ম্যারাথন ম্যাচটি হয়ে গেলো এবারেই।
টেনিস খেলাটা অবশ্য আমার বেশি পছন্দ না, গলফের মতো এটাও বেশ এলিটিস্ট খেলা। ফুটবলের সুবিধাটা এখানেই, কিচ্ছু লাগে না, কেবল একটা বল থাকলেই হলো, অথবা বলের মতো কিছু একটা। আমার বাবাদের সময়ে গ্রামে সেই বলটাও থাকতো না, কিন্ত সমস্যা হয়নি তাতে, বলের বদলে জাম্বুরা দিয়ে দিব্যি খেলা চলেছে।
সে তুলনায় টেনিস খেলতে গেলে সরঞ্জাম লাগে বিস্তর।
হয়তোবা একারণেই টেনিস খেলাতে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো পিছিয়ে আছে অনেক। ১০০ কোটি মানুষের দেশ ভারত থেকে টেনিসে ভালো ফল করা খেলোয়াড় বেরিয়েছে তাই বেশ অল্পই। এই অল্প কয়েকজনের মধ্যে হয়তোবা সবচেয়ে ভালো ফল করেছিলেন লিয়ান্ডার পেইজ আর মহেশ ভূপতির জুটি। টেনিসে একক সাফল্যগুলোই বেশি খবরে আসে, কিন্তু লিয়ান্ডার পেইজ ১৯৯৯ হতে ২০১০ অবধি ১২টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ডাবলস ফাইনালে গেছেন, আর ৬বার শিরোপা জিতেছেন।
মিক্সড ডাবলসে গেছেন ১০টি ফাইনালে, জিতেছেন ৫ টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম শিরোপা।
পেইজ ট্র্যাজেডির নায়ক নন, কিন্তু টেনিসের জগতে কোনো কোনো খেলোয়াড়কে যেন তাই মনে হয়। টেনিসের সবচেয়ে আরাধ্য শিরোপা উইম্বল্ডন, তা জেতার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা থাকে সব তারকার। এই ক্ষেত্রে ট্র্যাজেডির নায়ক হিসাবে বলতে হবে ইভান লেন্ডলকেই, আশির দশকের বিশ্ব সেরা টেনিস তারকা হয়েও জিততে পারেননি তিনি উইম্বলডনে একবারও।
এরকম ট্র্যাজিক হিরো অবশ্য ফুটবলে আছে গাদায় গাদায়।
মেসির কান্না হয়তো সবার চোখে পড়েছে ২০১০ বিশ্বকাপ থেকে আর্জেন্টিনার বিদায় লগ্নে, কিন্তু এমনও অনেক বিশ্বসেরা খেলোয়াড় ছিলেন, যাঁরা বিশ্বকাপ জেতা তো দূরের কথা, বিশ্বকাপে খেলারই সুযোগ পাননি। ঘানা এবার বিশ্বকাপে খেলেছে বটে, কিন্তু ঘানার কালজয়ী ফুটবলার আবেদি পেলে আশির দশকে ক্লাব ফুটবলে চরম সাফল্য পেলেও সেসময়ে ঘানা বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায়নি। ১৯৯১ হতে ৯৩ পর্যন্ত পর পর ৩ বছর আবেদি পেলে আফ্রিকার সেরা ফুটবলার হয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বকাপ রয়ে গেছে ধরা ছোয়ার বাইরেই। অবশ্য এবারের বিশ্বকাপে আবেদি পেলের দুই ছেলে ঘানার জাতীয় দলে খেলার সুযোগ পেয়েছে। আবেদির চেয়েও দুর্ভাগ্যবান বলতে হবে জর্জ উইয়াহ-কে।
১৯৯৫ সালে উইয়াহ একই সাথে ফিফার বিশ্বের সেরা ফুটবলার, ইউরোপের সেরা ফুটবলার, ও আফ্রিকার সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পান। কিন্তু বিধি বাম, উইয়াহর দেশ লাইবেরিয়াও বিশ্বকাপে আসতে পারেনি, ফলে ফিফার বিশ্বসেরা ফুটবলারদের মধ্যে উইয়াহ্ই একমাত্র খেলোয়াড়, যিনি বিশ্বকাপে খেলেননি।
তবে ফুটবলে ট্র্যাজেডির নায়ক বলতে হলে সবার উপরে যাঁর নাম আসবে, তিনি হলেন জর্জ বেস্ট। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ১১ বছর খেলেছেন বেস্ট, এর মধ্যে ৬ বছর দলের সর্বোচ্চ গোলদাতা ছিলেন, জিতেছেন ইউরোপের সেরা সব কাপ। কিন্তু তাঁর ক্যারিয়ারের সেরা সময়ে তাঁর দেশ উত্তর আয়ারল্যান্ড বিশ্বকাপে সুযোগ পায়নি।
ট্র্যাজেডির নায়কদের মতোই জর্জ বেস্টের ক্যারিয়ার আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে এসেছে, মদে আসক্তি তাঁর দেহকে আস্তে আস্তে ধ্বংস করে দিয়েছে, ২০০৫ সালেই অকালে প্রয়াণ হয় বেস্টের।
---
ট্র্যাজেডির নায়ক ভাবলে অবশ্য আমার মনে পড়ে মহাভারতের কর্ণ আর রামায়ণের রাবণের কথা। কর্ণের পুরো জীবনটাই ট্র্যাজেডি – জন্মের সময়েই কুমারী মা কুন্তি জলে ভাসিয়ে দিয়েছিলেন কর্ণকে, তাঁর ভাইরা রাজ পরিবারে বড় হলেও কর্ণ মানুষ হয়েছেন রাজবাড়ির রথচালকের ঘরে। দুর্যোধনের বন্ধুত্ব আর তাকে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছেন আজীবন, দল পালটে পাণ্ডবদের সাথে যোগ দেননি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের কূটবুদ্ধিতে অর্জুন কায়দা করে হত্যা করেণ কর্ণকে, ষষ্ঠ পাণ্ডবের জীবনাবসান হয় এভাবেই।
পৌরাণিক এসব চরিত্র নিয়ে সিনেমা হচ্ছে ইদানিং, হালের বলিউডের রাজনীতি সিনেমাটি অনেকটা কর্ণেরই কাহিনী। বাংলাদেশের মিডিয়াতে পৌরাণিক কিছু নিয়ে ইদানিং আর কিছু বানানো হয় না, যদিও এক সময় রহিম-বাদশা-রূপবান অথবা এরকম কাহিনী নিয়ে সিনেমা হয়েছে, আর যাত্রা পালা তো হয়েছে বটেই। বাংলার যাত্রাশিল্প মরে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, সরকারী কালাকানুনের চাপে পড়ে লোকনাট্য হারাতে বসেছে। বিটিভিতে এক সময় নিয়ম করে বছরে প্রায় দু’বার দেখানো হতো। একবার হতো দুর্গা পুজার সময়ে, অমল বোস দুর্দান্ত অভিনয় করতেন অসুরের চরিত্রে।
বহুকাল বিটিভি দেখিনি, এখনো দুর্গাপুজার সময়ে যাত্রাভিনয় দেখানো হয় কি না জানিনা। অথবা হীরামণের সেই লোককাহিনীগুলো, বিটিভিতে প্রতি সপ্তাহে দেখানো হতো যা আশির দশকে।
যাত্রার প্রখ্যাত শিল্পী অমলেন্দু বিশ্বাসের অনেক অভিনয় দেখেছি একসময়ে, অমলেন্দুর একটা বাঁধা চরিত্র ছিলো ট্র্যাজেডির আরেক নায়ক মাইকেল মধুসূদন দত্ত। দেড়শ বছর কেটে গেছে, কিন্তু এখনো মাইকেলের কবিতাগুলো, তাঁর সনেটগুলো পড়ে অবাক হয়ে যাই, কী প্রচণ্ড চমৎকার সুর ফুটে উঠেছে অমিত্রাক্ষর ছন্দে। সাগরদাড়ির জমিদার পরিবারের ছেলে মাইকেল বিখ্যাত কবি হবার জন্য এক সময় জাত, ধর্ম, ভাষা, দেশ – সব ত্যাগ করে বিদেশে গিয়েছেন, কিন্তু এক সময় কপোতাক্ষের কথা তাঁর মনে পড়েছে, দেশের ভাষা ত্যাগ করে বিদেশে যাবার ভ্রান্তি বুঝতে পেরেছেন।
মেঘনাদ বধ কাব্যে মাইকেল ট্র্যাজেডির নায়ক হিসাবে রাক্ষসপতি রাবণকে তুলে ধরেছেন, চিরাচরিত সাহিত্যের ভিলেন রাবণের ব্যতিক্রমধর্মী বিশ্লেষণ করেছেন এই মহাকাব্যে। মাইকেলের লেখায় তাই রাবণ অনেকটা ট্র্যাজিক হিরো। হয়তো বা মাইকেলের নিজের জীবনের ট্র্যাজেডিগুলো রূপকের মাধ্যমে এসেছে। মধু কবির জীবনের শেষ অংশটাও কেটেছে দারিদ্রে, কপর্দকশূন্য মাইকেল মারা যান ১৮৭৩ সালে, কলকাতার লোয়ার সার্কুলার রোডের গোরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন মধু কবি।
ট্র্যাজেডির নায়ক মধু কবির পরম্পরা অবশ্য রয়ে গেছে, দ্বিতীয় স্ত্রী হেনরিয়েটার ঘরে তাঁর দুই সন্তান – নেপোলিওন ও শর্মিষ্ঠা।
কয়েক পুরুষ পরে মধুসূদনের নাতি মাইকেল দত্তনের ঘরে জন্মান জেনিফার দত্তন, ভারতের হয়ে ১৯৭২ সালের মিউনিখ অলিম্পিকে বাস্কেটবল দলে অংশ নেন। ১৯৭৩ সালে তাঁর ঘর আলো করে আসে এক পুত্র সন্তান। মধু কবির ট্র্যাজেডি অবশ্য তাঁর এই নাতিকে স্পর্শ করেনি, ক্রীড়াঙ্গনে আন্তর্জাতিক সাফল্য লাভ করেন মধু কবির এই বংশধর। আর, তার নাম?
লিয়ান্ডার পেইজ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।