৭১ এর চেতনা বুকে জ্বলছে অবিরত
সাংবাদিকতার পথ কখনও মসৃণ ছিলো না। বিপদসঙ্কুল পথ ধরেই কলম-সৈনিকেরা তাদের নিষ্ঠা, একাগ্রতা এবং অধ্যাবসায় দিয়ে তুলে ধরেছেন জনমানুষের কথা। প্রায় আড়াইশ বছর ধরে বিকশিত হওয়া সংবাদপত্র শিল্প এগোচ্ছে তার নিজস্ব গতিতে, এবং পা রাখছে নতুন নতুন সম্ভাবনার দিকে। পাঠক চাহিদা এবং যুগের দাবিতেই প্রচলিত সংবাদ-কাঠামো বাঁক নিচ্ছে নতুন ধরনে। ফলে বিকল্প সাংবাদিকতার রূপকল্প অনুসন্ধানের প্রয়োজন পড়ছে।
জনমানুষের তথ্য-চাহিদার ওপর নির্ভর করে সাংবাদিকতার দর্শন অথবা রূপকল্প অনুসন্ধানের প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। এই বিকল্প ধারার সাংবাদিকতা অর্থাৎ জনসাংবাদিকতার চর্চা যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম বলে ধরা হয়। কিন্তু সাংবাদিকতার ইতিহাস নিবিড় পর্যবেক্ষণে দেখা যায়_ যুক্তরাষ্ট্রে জনসাংবাদিকতার দর্শন শুরু হবার অনেক আগেই বাংলাদেশে কাঙাল হরিনাথ ও মোনাজাতউদ্দিনের সাংবাদিকতার চর্চার মাধ্যমে প্রকৃত অর্থে জনসাংবাদিকতার অন্তর্লক্ষণ এবং বহির্লক্ষণ উভয়ই সূচিত হয়। পরবর্তী সময়ে মোনাজাতউদ্দিনের হাতে এসে পূর্ণতা পেতে শুরু করে এদেশে জনসাংবাদিকতার চরিত্র।
আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক কারণে মুখ থুবড়ে পড়া বাঙালি সমাজ নতুন করে আত্মবিকাশের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে উনিশ শতকে।
আর এর যাত্রা কলকাতা মহানগরকেন্দ্রিক হলেও এর হাওয়া এসে লাগে মফস্বলেও। শিক্ষা-দীক্ষা, বোধ, কর্ম-প্রচেষ্টা, সংস্কৃতি চর্চা ও সংবাদ-সাময়িকপত্র প্রকাশনা দেরিতে হলেও গ্রামীণ সমাজের উঠোনে তা ঢুকে পড়ে। গ্রাম ও গ্রামের মানুষদের সংবাদ পরিবেশনের, বিশেষকরে সে সময়ের জমিদারকর্তৃক প্রজা পীড়নের দলিল হিসেবে মফস্বল থেকেও পত্রিকার যাত্রাপথ উন্মোচিত হয়। যার হাত দিয়ে এর যাত্রা শুরু হয় তিনি হলেন হরিনাথ মজুমদার অর্থাৎ কাঙাল হরিনাথ (১৮৩৩-১৮৯৬)। সময়ের প্রবহমানতায় গ্রামীণ সাংবাদিকতাকে নতুনরূপে পরিচিত ও বিস্তৃত করে তুলে ধরলেন আরেক প্রথিতযশা সাংবাদিক মোনাজাতউদ্দিন (১৯৪৫-১৯৯৫)।
তার হাতেই গ্রামীণ সাংবাদিকতা বাংলাদেশের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি নির্দিষ্ট আদল পেয়েছে এবং নগরবৃত্তের বাইরে গ্রামীণ ও প্রান্তিক মানুষের জীবন-বিকাশ, জীবিকা, তথ্য এবং প্রয়োজন মেটাতে সাংবাদিকতা যে একটি শক্তিশালী উপায় হতে পারে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে।
বাংলাদেশের সংবাদপত্রগুলোতে মফস্বল সংবাদ বরাবরই থেকেছে উপেক্ষিত। দেশের প্রধান ধারার সংবাদপত্রগুলো মূলত এলিট শ্রেণী, রাজনীতি এবং বাজারের প্রতি পক্ষপাতদুষ্ট। নগরকেন্দ্রিক সংবাদ ছাপিয়ে পত্রিকার পাতায় গ্রামের জীবন-সমস্যা এবং কণ্ঠস্বর খুব কমই প্রতিভাষিত হয়। কিন্তু মোনাজাতউদ্দিনের চিন্তা ও চেতনা ছিল গ্রামকেন্দ্রিক।
তিনি গ্রামের মানুষের সমস্যা সমাধান এবং স্বপ্ন নির্মাণকল্পে তার সাংবাদিকতার স্বকীয়তা প্রতিষ্ঠা করেন।
মোনাজাতউদ্দিন ইস্যু নির্বাচনের ক্ষেত্রে নগরের চেয়ে গ্রামকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। কারণ সব সময়ই অজ্ঞানতা, বঞ্চনা ও নিগ্রহের শিকার হয় গ্রামের মানুষ। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যাঁতাকলে নিষ্পেষিত এসব মানুষেরা চিরকালীন নির্যাতনের শিকার হতে থাকবে। কোনদিনই মুক্তির পথে আসবে না, যদি তারা তাদের অধিকার সম্পর্কে অসচেতন থাকে।
আর এ দায়বোধ থেকেই মোনাজাতউদ্দিন সেইসব মানুষের গাথা শোনাতে হাতে কলম তুলে নিয়েছিলেন। প্রচলিত সাংবাদিকতার ধারা থেকে বাইরে এসে জনমানুষের উপযোগী করে এক বিকল্প ধারার সাংবাদিকতার যাত্রা শুরু করেছিলেন।
গ্রামের মানুষদের হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনাকে তার শিল্পিত হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেয়েছিল খবরের কাগজে। সংবাদ যে শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়, গ্রামের মানুষেরাও যে কাগজের মানুষে পরিণত হতে পারে, তার গুরু দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন মোনাজাতউদ্দিন। সংবাদপত্রগুলো মূলত এলিট শ্রেণীর কথা এবং রাজনীতি অথবা পুঁজি-স্বার্থে বিজ্ঞাপন প্রচারে সবসময়ই সক্রিয় ভূমিকা পালন করে।
মোনাজাতউদ্দিন এই ধারার বাইরে এসে সাংবাদিকতার নতুন ধারা নির্মাণে সচেষ্ট হলেন এবং গড়ে তুললেন সাংবাদিকতার এক নতুন অধ্যায়।
তার পেশা, নেশা দুইই ছিলো গ্রামের পথ-ঘাট ঘুরে ঘুরে সংবাদ সংগ্রহ করা। তিনি মানুষের পাঁজরের হাড়ের খবর তুলে আনতেন। নির্যাতিত মানুষের জীবনের দুঃখগাথা ছিলো তার সংবাদের বড় অংশ। তিনি সবসময়ই সুবিধা বঞ্চিত নিরন্ন মানুষের সংবাদকে বেশি প্রাধান্য দিতেন।
খবরের পেছনের খবরকে তিনি তুলে ধরতেন বিচক্ষণতায়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।